প্রায় পাঁচ বছর হতে চলছে, হ্যাঁ
পাঁচ বছর। কিন্তু রনি আজও ভুলতে পারেনি মেয়েটিকে, আর হয়তো পারবেও না। মানুষ
প্রেমে পরে, আঘাত পায়, ধোঁকা খায়, যোগ্যতার অভাবে বঞ্চিত হয়- আর এক
পর্যায়ে সব ভুলেও যায়। যে ইচ্ছে করে আঘাত দেয়, তাকে ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু
ওকে তো কেউ আঘাত দেয়নি! তাহলে ও নিজেকে বুঝাবে কী করে?
লোপা, হ্যাঁ, সেই মেয়ের নাম লোপা। দেখতে কেমন রনি জানে না, লোপার রূপ দেখার
সৌভাগ্য ওর কোনোদিন হয়নি, তবে ও লোপার চোখ দেখেছে, মায়া আর স্নিগ্ধতায়
ভরা, সদাবনত দুটি চোখ। একটা মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করতে যা দরকার তার
সবকিছুই ছিলো চোখ দুটিতে। রনি সেই চোখ দেখেই ওর প্রেমে পরেছিলো, আজও পরেই
আছে, মুক্তি মেলেনি।
ওরা তখন এস এস সি পরীক্ষার্থী, সজীব স্যার’র বাসায় ব্যাচে পড়তে যেত। রনি,
আর ওর স্কুলের কয়েকটা বন্ধু সাথে অন্য স্কুল থেকে আসা কয়েকটা মেয়ে, লোপা
তাদের একজন।
ব্যাচ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মাঝেই লোপা আর রনি টিচারের কাছে বিশেষ কদর পেতে
শুরু করলো; লোপা ছিলো অঙ্কে সবথেকে ভালো আর রনি ইংরেজিতে। স্বভাবতই তখন
দুজনের প্রতি দুজনের সামান্য আগ্রহ জন্মে। আর ছেলে-মেয়ে মুখোমুখি বসার
সুবাদে তাই চোখাচোখি হতো প্রায়-ই। এভাবেই শুরু হয় রনির দুর্ভাগ্যের।
প্রতিদিন মুখোমুখি বসে চোখাচোখি, টিচারের কাছে, বন্ধুদের কাছে লোপার
প্রশংসা শুনতে শুনতেই রনি লোপার প্রেমে পরে যায়। অল্পবয়সের আবেগী প্রেম,
যেখানে যুক্তি থাকে অনুপস্থিত, ভালোলাগার কারণও থাকে অজানা; কিন্তু আবেগ হয়
তীব্র।
বেশকিছুদিন এভাবেই চলতে থাকে আর রনির অস্থিরতা বাড়তে থাকে, কীভাবে সে
লোপাকে বলবে, কীভাবে তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাবে। মনের কথাগুলো একটা চিঠিতে
লিখে ও লোপাকে দেয়ার জন্য সাথে নিয়ে ঘুরে, কিন্তু সাহসে কুলোতে পারে না,
তাই চিঠিটা থেকে যায় মানিব্যাগের ভাজে।
শেষে একদিন বন্ধু আসিফের পরামর্শে ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডের ভিতরে চিঠিটা রেখে ও
লোপাকে দেয়, যে চিঠিতে ছিলো ওর ভালোবাসার আর মনের গভীরের অনেক কথা। নিজের
মনের একান্ত কথা গুলো লোপাকে বলে ওর আসলে অস্থিরতা কমেনি, বরং জবাব পাওয়ার
অপেক্ষায় সেটা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।
মনের মাঝের চঞ্চলতা নিয়েই ওর ঈদ কেটে যায়, সবসময় একটা অস্থিরতা ভর করে থাকে
ওর উপর। ও ধারণা করছে, লোপা হয়তো ওকে ফেরাবে না, আবার এক-ই সাথে ভয়ও হয়,
যদি ফিরিয়ে দেয়? যদি শুনে ও অন্য কাউকে পছন্দ করে? বা, যদি ওকে পছন্দ না
করে? এভাবেই দিন কাটে, প্রাইভেট ছুটির কারণে দেখা নাই আর কোন ফোন নাম্বারও
রনি জানে না। ও যে লোপাকে পছন্দ করে, সেটা ওর বন্ধুরা বা লোপার বান্ধবীরা
সবাই অনেক আগে থেকেই জানলেও ও কারো কাছে লোপার বাসার কারো নাম্বার চাইতে
লজ্জা পাচ্ছিলো।
বেশ কয়েকদিন পর রনির এক বন্ধু ফোন করে প্রাইভেট ক্লাস শুরু হওয়ার তারিখ
জানায়, আর সাথে একটা খবর দেয়- লোপার বড় বোন নাকি এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।
রনি লোপার সাথে একটু কথা বলার জন্য খুব অস্থির হয়ে যায়। একটু কথা বলবে, ওকে
একটু সান্তনা দিবে। কিন্তু সুযোগ আর হয় না, ও জানতে পারে লোপার সেই বোনের
নাকি তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা আছে, এখন বাচ্চাদের কী করা যায় তাই নিয়ে ওদের
বাসায় ঝামেলা হচ্ছে। আর যার কারণে লোপা পড়তে আসছে না।
শেষে রনি লোপার বান্ধবী রুমানাকে খুব অনুরোধ করে লোপার সাথে একটু যোগাযোগ
করিয়ে দেয়ার জন্য। কয়েকদিন পর রুমানা রনিকে জানায় লোপা নিজেও ওর সাথে দেখা
করতে চায়। তাই পরেরদিন ও যেন গলির মুখে অপেক্ষা করে।
রনি-ই শুধু জানে সেই দিনটা ওর কেমন কেটেছিলো, সারাটা রাত ও ছটফট করছিলো,
ওকে লোপা কী উত্তর দেবে? মেনে নিবে নাকি ফিরিয়ে দেবে? লোপা কি ওর সাথে খুব
খারাপ ব্যবহার করবে? নাকি হাসিমুখে কথা বলবে? এভাবেই ছটফট করতে করতেই দিনটা
কাটে। শেষে বিকেল হয়।
ও গলির মুখে অপেক্ষা করতে করতে একসময় লোপা আসে, খুব সাধারণ ভাবে, বোরকা
পরা, পিঠে ব্যাগ; যেমনটা ও দেখে অভ্যস্ত। এই প্রথম ওরা দুজন একাকী কথা বলার
সুযোগ পাচ্ছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই রনি ঘামতে থাকে, কিছুটা নার্ভাস হয়ে
যায়।
সাধারণ কুশল বিনিময় হয় খুব স্বাভাবিক ভাবেই। এর পর বেশ কিছুক্ষণ দুজন-ই
চুপ। বেশ কিছু সময় পরেই লোপা আচমকা বলে উঠে- আপনি আমাকে ভুলে যান। রনি
প্রথমে ওর কথা বুঝতে পারে না, বলে- বুঝলাম না।
তখন লোপা বলে- বুঝিয়ে দিচ্ছি, তার আগে বলেন আপনার হাতে কি কিছু সময় হবে কথা
শুনার জন্য? আসলে আমি আপনাকে সহজে বলতে পারছি না, হয়তো একটু বেশি-ই কথা
বলে ফেলতে পারি।
রনি বললো- তোমার কথা শুনতেই তো এখানে এলাম, আর তুমি যদি অল্প কথা বলেই চলে
যাও, তাহলে সেটাই হয়তো আমার কাছে বেশি খারাপ লাগবে। তোমার যা বলার ইচ্ছা-
বলো, কথা দিচ্ছি, মনোযোগ দিয়ে শুনবো।
এরপর লোপা যা বলতে থাকে তাতে রনি প্রথমে অবাক হয়, পরে রেগে যায় আর তার পরে ভেঙ্গে পরে...
লোপা বলে- জানেন তো আমার বড় বোন মারা গেছে, তার তিনটা বাচ্চা, খুব-ই ছোট।
আপু মারা যাওয়াতে এখন বাচ্চা গুলোকে সামলানো দুলাভাইয়ের পক্ষে অসম্ভব। এখন
বাচ্চাদের প্রয়োজনেই দুলাভাইকে আবার বিয়ে করতে হবে। বাসায় এটা নিয়ে অনেক
কথা হয়েছে কিন্তু কেউ ভালো কোন সমাধান দিতে পারছে না, কারণ, দুলাভাই এমন
স্ত্রী কোথায় পাবে যে বাচ্চাগুলোকে নিজের সন্তানের মত মানুষ করবে? শেষে
গতকাল সে একটা প্রস্তাব করে- আমি যদি তাকে বিয়ে করি, তাহলে বাচ্চাগুলোর
জন্য ভালো হবে আর আমাদের দুই পরিবারের মাঝেও কোন ঝামেলা থাকবে না। এখন তার
প্রস্তাবে ঘরের সবাই মোটামুটি রাজি আর আমিও এর কোন বিকল্প দেখছি না। কারণ,
বাচ্চাগুলোকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি আর ওরাও তেমনি। তাই আমি মনে করি, ওদের
দিকে তাকিয়েই আমার এটা করা উচিৎ।
একটানা কথা গুলো বলে লোপা থামে, তার চোখ দেখেই রনি বুঝতে পারে সে যেটা বলেছে, চিন্তা করেই বলেছে আর সে এটা করবেই।
তখন রনি বলে- তোমার নিজের কথা ভাববে না? নিজের জীবন বলতেও তো একটা ব্যাপার
আছে। আর আমি-ই বা কী করবো? তুমি জানো আমি তোমাকে কত্ত ভালোবাসি? আমি
সারাদিন তোমাকে ভাবি, ঘুমাতে পারি না, পড়তে পারি না- সারাদিন তোমাকে চোখের
সামনে দেখি। আমি কল্পনাও করতে পারি না যে তোমাকে আমি পাবো না। তুমি বিশ্বাস
করো, আমি থাকতে পারবো না। আমার কথা একটু ভাবো, প্লিজ।
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে ও, ভেজা চোখে লোপার দিকে তাকায় কিছু শোনার জন্য। বেশ
কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে যায়, কেউ কোন কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর লোপা প্রথম
কথা বলে উঠে-
-ভালোবাসা হারানোর কষ্টের কথা বলছেন? কষ্ট কি শুধু আপনার একার হবে? আমার কি কিছুই হবে না?
-মানে?
-মানে হলো, আমিও আপনাকে ভালোবাসি, তবে জানি না সেটা কতটুকু যৌক্তিক, কিন্তু
বাসি। যখন থেকে আমি জানতে পারি আপনি আমায় পছন্দ করেন, তখন থেকেই আমিও
আপনাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি জানি না তার কারণ কী, তবে ভালোবেসে ফেলেছি এটা
সত্য। আপনি যেমন ঘুমাতে পারেননি, আমিও পারিনি, অনেকদিন ধরে আমি শান্তিতে
ঘুমাইনি। শুধু আপনার মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শোনার অপেক্ষায়। বিশ্বাস করবেন
কিনা জানি না, তবুও আপনাকে কিছু দেখাতে চাই।
এ কথা বলে লোপা কাধের ব্যাগ থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বের করে, যার ভিতরে
ছিলো অনেকগুলো খোলা কাগজ আর একটা ডায়েরি। রনি কিছুই বুঝতে পারে না, ফ্যাল
ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
লোপা আবার বলে- এখানে কতগুলো কবিতা আছে, যা আমি লিখেছি, শুধুই নিজের মনের
ভালোবাসা থেকে আর ভালোবাসার মানুষের জন্য। আশা ছিলো, যেদিন তার পাশে থাকবো,
উপহার হিসেবে এগুলো তাকে দেবো, কিন্তু সেই সুযোগ আর হলো না। আর আমার সেই
ভালোবাসার মানুষটি আপনি-ই, অন্য কেউ নয়।
এরপর সব লেখাগুলোকে ও রাস্তায় ছোট্ট করে সাজিয়ে নেয়, তারপর ব্যাগ থেকে একটা
দেশলাই বের করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। রনি বোকার মত তাকিয়ে থাকে, কিছুই
করে না, কিছুই বলে না। শুধু দেখে কাগজগুলো পুড়ে যাচ্ছে আর তার পাশে ওর
ভালোবাসার মানুষটি বসে আছে, সেই মায়াময় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আগুন দেখছে, আর
চোখের পানি ঝরছে, যে পানি ওই আগুন নেভাতে যথেষ্ট নয়, যথেষ্ট নয় রনির মনের
কষ্টটা ধুয়ে দিতেও। কিছুক্ষণ পর আগুন নিভে যায়, লোপা উঠে দাড়ায়। নিজেকে ও
শক্ত করে নিয়েছে। স্বাভাবিক গলায় ও কয়েকটি কথা বলে-
-দেখুন, আমি আপনাকে ভালবেসেছি বা আপনি আমাকে, মানুষ কিন্তু আমরা দুজন। আপনি
আর আমি। তারপরের কথা হলো, আমি বা আপনি যে একজন আর একজনকে পাবোই- এমন
কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। আর ওদিকে তিনটা শিশু;
তিনটা প্রান। আমি একা পারি ওদের তিনজনকে সুখ দিতে, সাথে বাকিদেরকেও, কারণ,
ওদের সুখ-ই যাদের কাছে বড়, এমন মানুষ কিন্তু আমাদের দুই পরিবারে কম নেই।
আমি নিজে না হয় সুখ একটু কম-ই পেলাম, কিন্তু এতগুলো মানুষকে সুখ দেয়াটা কি
কম? আর আপনি যখন আমাকে ভালোবেসেছেন, আমার কথা নিশ্চয়-ই আপনি রাখবেন, তাই
না? তাই আমি শুধু এতটুকুই বলবো, নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন, আমার জন্য আর
আমার তিন সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। আর হয়তো দেখা নাও হতে পারে। আসি।
লোপা চলে যায়, অনেক কিছুই বলতে চায় রনি, কিন্তু কিছুই ও বলতে পারে না। পা ছড়িয়ে রাস্তায় বসে থাকে, আর দৃষ্টি থাকে লোপার পথের দিকে।
কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে ও উঠে দাড়ায়, হঠাৎ ও দেখতে পায়, ছাই হয়ে যাওয়া কবিতা
গুলোর কাছেই একটা প্রায় অক্ষত কাগজ। বাতাসে উড়ে পাশে চলে যাওয়ায় হয়তো
পুড়েনি। ছোট্ট একটা কবিতা লেখা তাতে- তারিখটা দেখা যায় না, পুড়ে
গেছে.........
আপন হবো
সূর্য হয়ে আলো দেবো, পাখির মত গান-
পরী হয়ে করবো রঙিন তোমার সারাক্ষণ,
মেঘ জমিয়ে নামাবো আঁধার, হবো সবুজ বন-
আসবো হয়ে তোমার কাছে নদীর কলতান।
আঁধার রাতে জোছনা হবো, গন্ধরাজের ঘ্রাণ,
শ্রাবন মাসের বৃষ্টি হয়ে করিয়ে দেবো স্নান।
শীতের ভোরে রৌদ্র হবো, শীতল জলের বান,
চৈত্র দিনের ভর দুপুরে জুড়িয়ে দেবো প্রাণ।
চলার পথের সঙ্গী হবো- তোমার আপনজন,
দুঃখ নামের জীবন বাঁধার করবো অবসান।
সুখের না’য়ের বৈঠা হবো, বৈরী সুরের টান,
বধু হয়ে করবো শীতল, তোমার শরীর-মন...।
রনি কথা রেখেছে, নিজের যত্ন নিয়েছে, তবে আরও বেশি করে যত্ন নিয়েছে ওর
মনের ভালোবাসার। এখনো ও ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখে সেই চোখ জোড়া, যেই চোখে ওর
জন্য ভালোবাসা ছিলো, যেই চোখ ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো। ভালবাসাগুলো হয়তো
ওকে দিয়ে যেতে পারেনি, কিন্তু সেই ভালোবাসার সৃষ্টি তো হয়েছিলো ওর জন্যই।
তাই ও কিছুই ভুলেনি, ভুলতে পারবেও না হয়তো কোনোদিন। আর দরকার-ই বা কী ভুলে
যাওয়ার? কচি বয়সের কচি প্রেম, থাকুক না চিরঞ্জীব হয়ে।
রফিক স্যার