Pages

একলা থাকার উপাখ্যান!


052206_2drawing
ছক কষার খেলা চলে গভীর রাত অবধি। নদীর যাত্রা কি উৎস থেকে গন্তব্যে না গন্তব্য থেকে উৎসে? সূত্র বলছে হিমালয়। সূত্র বলছে পাহাড়ের শরীরে নদী ঠোঁট ছুঁইয়ে ফেরে বারবার। হিমালয় কি নদীর যাত্রাপথ না উৎস? অথবা দু’টোই। নদীর গন্তব্য কি চিরাচরিত সমুদ্র? না এর মধ্যেও কোনো গোপন ছল আছে? এখনো বোঝা যাচ্ছে না। পাহাড়ে পাহাড়ে পলাতক নদী মেঘের অপেক্ষায়। কোনো মেঘ নেই আকাশে।
আমার যাত্রা দু’টি। গন্তব্য দু’টি। ফিরে যেতে চাই শেকড়ের টানে, ফিরে যেতে চাই হৃদয়ের বন্ধনে, আবার; এগিয়ে যেতে চাই জীবন-জীবিকার সন্ধানে। বাইরের পরিস্থিতি উত্তাল। বাসায় বন্দী হয়ে আছি আজ সারাদিন। আর ভাল লাগছে না। তাই সদর দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে, মোবাইল স্যুইচটি অফ করে দিয়ে, ফিরে এলাম আমার আপন সত্তায়। আমার আপন ভুবনে। ভেসে গেলাম ভাবনার অতল গহবরে।
ভাবনাগুলো এলোমেলো। সময় বড়ই অস্থির! ভাবনাগুলোকে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে। সময় আমাকে একলা পেলেই হৃদয় নামক যন্ত্রটাতে আঘাত করে। বুঝতে চায়না যে আমার হৃদয় এমনিতেই বিক্ষত। আমার কাছে আসলে হৃদয়ের অর্ধেকাংশ, বাকী অর্ধাংশ রেখে এসেছি নয় হাজার মাইল দূরের শেকড়। কালের পরিক্রমায় আজ তাই আমার একলা থাকার উপাখ্যান!

তোমাকে পাওয়ার আগে সেদিনও আমিতো একাই ছিলাম। মায়ের আঁচল থেকে বেড়িয়ে একাই তো বিশ্বজয়ের যুদ্ধে নেমেছিলাম। একদিন আমিও সুখনিদ্রা যাপন কারীদের দলেই ছিলাম। আমি ছিলাম কেবলই আমার। কোন দিনইতো বুঝতে পারিনি একা থাকার কি যন্ত্রনা! একটি দিনওতো বিষণ্নতায় কাটেনি আমার। আজ কেন তবে বিষণ্নতা আমার পিছু ছাড়েনা। তাহলে কি আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি একা হয়ে গেলাম তোমাকে পাওয়ার পর?
চাঁদের আলো ছাড়াই আঁধারেও আমি ভালইতো ছিলাম। জ্যোৎস্নাতে শরীর ভেজানোর স্বাদতো জাগেনি কখনো আগে। হঠাৎই তুমি এসে জোৎস্নার পিপাসা শেখালে। হায় জ্যোৎস্না! তুমিতো দু’দিনেই ফিরে গেলে, আমাকে কেন দিয়ে গেলে ছলনার রাত?
মেঘ দেখি, গাছ দেখি, দেখি কচিপাতা। নিয়নের আলো দেখি রাস্তায়। দুপুরের রোদ দেখি, বৃষ্টির সন্ধ্যা। জানালা দিয়ে হাত বাড়াই, দু হাতে মেখে নিই বৃষ্টিজল। রাস্তায় হাঁটলে ছাতা বন্ধ করে দিই, ভিজে যাই.. ভিজে যাই। একা ভিজি, দু’জনেও ভালোবাসি, শাওয়ারের নিচে। তিল দেখি, চেনা হাসি দেখি, দৃষ্টি দেখি। মত্ততা দেখি, ভালোবাসাবাসি দেখি, দুহাতে মেখে নিই জলের মতো। ভরে যাই, ভরে যাই আকুলতায়। পথঘাটও ভেসে যায় জলে, বারান্দায় টব পড়ে থাকে, শ্রাবণ দিনের শেষে দেখি ভরে গেছে ধারাবর্ষণে। এখনও বৃষ্টি শেষ হলে জলবিন্দু চকচক করে ঘাসের গায়ে। কিন্তু আমার মনে কেন খচ্‌ খচ্‌ করে শুধুই যন্ত্রনা?
ক্যালেন্ডার বলছে এটা শীতকাল। অথচ বসন্তের গন্ধে উত্তাল ক্রমাগত পৃথিবীর সমস্ত বন্দর, নাবিক, মাঝিমাল্লা, জলদস্যু। চোখ বন্ধ করলেই কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখি, ফুলে ছেয়ে আছে। দেশের খবরে দেখি; সবাই বসন্ত উৎসবে মেতে আছে। এখানে কোন কৃষ্ণচূড়া গাছ হয়না। তাই বুঝি আমারও কোন বসন্ত নেই। প্রকৃতিও আমার একাকিত্বের জানান দিয়ে যায়। পাখিরা রাতের ঠিকানায় ঘুমিয়ে, একলা কয়েকটা ফোর হুইলার পড়ে আছে নি:ঝুম আলোয়, ওদের সবাই ভুলে গেল? শুধু কয়েকটা ফোর হুইলার, একলা, আমার মতো। আমার ভেবে কান্না পায়।
নিদ্রা দেবী মাঝে মাঝে খুবই প্রসন্ন হন। দেরিতে ঘুম ভাঙে কোনো কোনো দিন।ততক্ষণে সুয্যি আমার সোনালী আভায় আলোকিত হয়ে পরে অন্ধকারে নিমজ্জিত একলা পৃথিবী। জানালার পর্দা সরিয়ে দিই। একফালি রোদ ঝুপ করে এসে বলে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সত্যিই তো, জানালা বন্ধ ছিল। বাইরের রোদ, বৃষ্টি, দু’একটা পাখির কিঁচির-মিচির, এরা তো একলা ছিল সারারাত। এদের কি তাই মনখারাপ? আচ্ছা… এরাও কি আমার কথা ভাবে?
চিনেমাটির পুরোনো প্যাঁচা ছিল একটা, পড়ে গেল হাতে লেগে। নাকটা খসে গেছে, বেরিয়ে গেছে ছাল চামড়া। ওকে কুৎসিত বললেই চলে এখন, কিন্তু ফেলতে পারিনা। কোথায় ফেলব? ডাস্টবিনে? পড়ে থাকবে পুরোনো ঝুলঝাড়ু, দুধের কৌটো, ছেঁড়া ন্যাপকিন আর পুরোনো পাপোশের পাশে? একা একা? কিছু ফেলতে পারিনা। ড্রয়ারে পুরোনো কলমের স্তূপ জমে ওঠে, কারো ঢাকনা নেই, কারো নেই নিব, কারো শুধু ঢাকনাই পড়ে আছে। তোমার পার্সে পড়ে আছে সেলোটেপ দেওয়া ছেঁড়া টাকা, চলেনি কোথাও। গাছ শুকিয়ে ঝরে গেছে গত গ্রীষ্মে, বারান্দায় টব পড়ে আছে। ময়না পুষতে সেই কবে, তার স্মৃতিটুকু নিয়ে খাঁচা আজও ড্রয়িং রুমে।
কিছু ফেলতে পারিনা। ভয় হয়, যদি কেউ আমার মতো একলা হয়ে যায়?
নিজের কথাই ভাবি। একদিন শরীরের আগুন নিভে যাবে, সমস্ত দিনের শেষে টুপ করে সমূদ্রের তীরে ডুবে যাবে সুয্যিমামা। সমূদ্রের ধারে পোড়ো গাছের মতো যদি আমিও কখনও একলা হয়ে যাই?

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন