দুজন পাশাপাশি আর মনে মনে জানি দুজনেরই মনের অনুভূতি। তবুও কেন যেন এ
অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা হয় না। বলা হয় না 'ভালোবাসি'। দূরত্বের সমস্যা
নয়, দ্বিধাই আমাদের অনেককেই এমন নির্বাক করে রাখে। অথচ একটু সাহস করে মনের
কথাটুকু বলে ফেললেই ছুঁয়ে ফেলা যায় ভালোবাসার রং। এ নিয়ে লিখেছেন প্রাঞ্জল
সেলিম মানুষ যখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে জানত না, তখন পৃথিবীতে
ভালোবাসার অভাব ছিল না। আজ পৃথিবীতে ভালোবাসার বড় অভাব। যেন তাই আজ একটি
বিশেষ দিবসকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় ভালোবাসার গুণগান। কিন্তু ব্যাপারটা
কি আসলে তাই? অনেকে বলবেন না, ভালোবাসা আসলে একটি মানবিক অনুভূতি এবং
আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোনো মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী
বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। তবুও ভালোবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে
ভাগ করা যায়। আবেগধর্মী ভালোবাসা সাধারণত গভীর হয়, বিশেষ কারও সাথে নিজের
সকল মানবীয় অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, যেকোনো
ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ প্রায় সময় খুবই আনন্দদায়ক হতে
পারে। আর এই অতি আনন্দদায়ক অনুভূতিই হলো ভালোবাসা। এখানে মানবিক আবেগটাই
বেশি গুরুত্ব বহন করে। অনেকেই ভালোবেসে বিয়ে করেন, কিন্তু এই ভালোবাসার
মানুষটিকে ভালোবেসে একটা সামান্য গোলাপ কিনে দেওয়ার কথাও মনে থাকে না
তাদের। বাস্তবতার আড়ালে যেন হারিয়ে যায় সব। অথচ একসময় এই মানুষটারই ছোট
থেকে ছোট ভালোলাগাগুলো ছিল অনেক কিছু। ইউনিভার্সিটি থেকে সব বন্ধুরা
হয়তো কোথাও বাইরে খেতে গেছে। সেখানে সবাই পিজ্জা অর্ডার করল। সবার খাবার
আনা হলে দেখা গেল, সাথে একটা বার্গারও চলে এসেছে। ছেলেটা তার পছন্দের
মানুষটার জন্য আগে থেকেই বার্গার অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, কারণ সে জানত তার
পছন্দের খাবারের কথাটি। আবার দেখা গেল, ছেলেটা তার বন্ধুটির জন্য সারাদিন
তার সাথে রয়েছে, কোনো কাজ করতে তাকে সাহায্য করছে। সেটা কি শুধুই
বন্ধুত্ব নাকি তার থেকেও কিছু বেশি ভালোলাগা। আর বন্ধুরা তো সাথে নেই,
শুধু সে-ই রয়ে গেছে। এই সাথে থাকা তো ভালোবাসার কারণেই। প্রিয় মানুষটার
জন্য কেউ হয়তো ছুটে গেছেন তার পছন্দের ফুলটি কিনে আনার জন্য। কিংবা তাকে
উপহার দিয়েছেন তার প্রিয় কোনো বই। খেয়াল রেখেছেন ভালোলাগার ছোটখাটো
বিষয়গুলোর প্রতি। হয়তো সবাই মিলে গেছেন সিনেমা দেখতে। সবার ভোটে
নির্বাচিত হয়েছে একটা মুভি। হঠাত্ মাঝখান থেকে মেয়েটা বলে উঠল, 'আমি এই
সিনেমা না, অন্যটা দেখব।' সিনেমার নামটায় আর সবাই অবাক না হলেও ছেলেটা অবাক
হয়, ছেলেটার মন একটু দুলে উঠল, কারণ এ-তো তার প্রিয় সিনেমা। মেয়েটা তার
মনের খবর বুঝল কীভাবে! সবাই তার বন্ধু কিন্তু তার মাঝ থেকে মেয়েটাই শুধু
বুঝল তার প্রিয় সিনেমার কথাটা। আবার হয়তো দুই বন্ধু কোথাও যাওয়ার পথে
একসাথে থাকলেও কারও সাথে কারও কথা হয়নি। নিশ্চুপ ছিল দুজনেই। হয়তো কেউই
বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু তারপরও এই নিরবতা মোটেও
অস্বস্তিকর মনে হয়নি তাদের কাছে। বরং এই মৌনতার মাঝেই মিশে ছিল তার মনের
না-বলা কথাটা। সবাই তো বন্ধু। সবার ভালো লাগা, মন্দ লাগার খেয়াল রাখছে
সবাই। কিন্তু এর মধ্যেই বিশেষ দুজনের যেন পরস্পরের প্রতি একটু বেশি নজর।
একজন মুখ না খুলতেই বুঝে যাচ্ছে অপরজন। মেয়েটির বন্ধুদের কাছে ছেলেটি খোঁজ
নিচ্ছে সে কী খেতে ভালোবাসে। ছেলেটির জন্য মার্কেট ঘুরে মেয়েটি খুঁজে বের
করছে বিশেষ একটি টি-শার্ট। কিংবা রাতের বেলায় কেন একজনের ফোন ওয়েটিং
পাওয়া গেল এ নিয়ে আরেকজনের অভিমান। পরীক্ষার আগে কেন ও পড়ছে না, এ নিয়ে
বাড়তি উদ্বেগ। এ কি শুধু বন্ধুত্ব? নাকি বন্ধুত্বটা যে পরের ধাপে যেতে
চলেছে তারই ইঙ্গিত? বুঝে নিতে হবে দুজনকেই। এগুলোর মধ্যেই যেন লুকিয়ে ছিল
পরস্পরের প্রতি না-বলা ভালোবাসাটা। এসব টুকরো মুহূর্তগুলোকে সাথে করেই
একটু একটু করে গড়ে উঠেছে আমাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদটি। আর যদি তাই হবে,
তাহলে বলতে হয় যে ভালোবাসার কোনো সীমা নেই, বয়স নেই। মনের মানুষটিকে
কাছে পেলেই অথবা বিয়ের পরেই বাস্তবতার আড়ালে যে সব মিলিয়ে যাবে, তা ঠিক না।
মনের মানুষটাকে যেকোনো মুহূর্তেই জানিয়ে দেওয়া যায়, না-বলা এই
ভালোবাসার কথাটা। আর তাই আমাদের সবারই উচিত, 'অনেকদিন বলা হয় না
ভালোবাসি' কথাটা বলে আফসোস না করে, এই মুহূর্তেই ভালোবাসার মানুষটিকে
জানিয়ে দেওয়া মনের না বলা কথাটা।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্য দিন