‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ ‘I Love You এমন কথা যদি কেউ আপনাকে বলে, তবে
বুঝবেন আপনার প্রতি বক্তার একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো বহুদিন থেকেই। কেননা,
চট করে কেউ কাউকে এ কথা বলতে পারে না। বলার আগে বক্তার ভেতরের যে আবেগ কাজ
করে, তা একদিনে জন্মায় নি।’ ভালোবাসা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই
এভাবে বলেন। আবার প্রথম দেখায় প্রেম, অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এটা নিছক
প্রেম না মোহ এটা বিচার করার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে প্রথম
দেখায় প্রেম হয়ে যাওয়ার পর অনেকেই ঘর বেঁধেছে। এটিও সত্য। ভালোবাসতে
কিংবা ভালোবাসা পেতে যে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে এমন কোন ধরাবাঁধা
নিয়ম নেই। একটা ছন্দ পড়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথের, ‘প্রেমের এই ফাঁদ পাতা
ভূবনে/কে কখন ধরা পড়ে কে জানে।’ তাই কখন প্রেমে পড়বেন, এটা বলা দুষ্কর।
এমনটাও কেউ কেউ বলেন ‘দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছরও কেটে
যাওয়ার পরও, একই সাথে বসবাস করেও ভালোবাসি কথাটি শোনার সৌভাগ্য অনেকের
হয় না। যাদের হয় না, তারা দুর্ভাগা। ভালোবাসতে গেলে বা ভালোবাসা পেতে
গেলে গুণের দরকার, এটা চেহারায় পায় না। আবার, একটা প্রবাদ আছে, ‘আগে
দর্শনধারী পরে গুণবিচারি’ এটিও ফেলে দেবার মতো নয়। কেউ যদি কারো চেহারার
সৌন্দর্য দেখে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, তবে তার স্থায়িস্থটা কমই হয় বৈকি।
মান্না দে যদিও গেয়েছেন, ‘ও কেন এতো সুন্দরী হলো/অমনি করে ফিরে
তাকালো/দেখে তো আমি মুগ্ধ হবোই/ আমি তো মানুষ...। কিন্তু কেউ যদি কারো পাশে
থেকে, তার ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তবে তার স্থায়ীত্বটা দীর্ঘ
হয়, এমনটাই দেখা গেছে। কেননা দেহজ সৌন্দর্য একটা সময়ে আর প্রকট থাকে না।
পক্ষান্তরে মনের সৌন্দর্য সবসময়ই আকৃষ্ট করতে পারে। তাই যদি না-ই হতো, তবে
বয়ষ্ক যতো দম্পতি আছেন, তারা একে অন্যকে রেখে পালাতেন। দর্শনধারী এবং
গুণবিচারি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দর্শনধারী এবং তার পাশাপাশি যদি কারো
সুন্দর, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বা গুণ থাকে, সেক্ষেত্রে ভালোবাসাটা অনেক
অনেক দীর্ঘস্থায়ীত্ব লাভ করে। কারো প্রকৃত ভালোবাসা পেতে হলে ব্যক্তির
দৈহিক সৌন্দর্য এবং মনোজগতের সৌন্দর্য দুটোরই দরকার। প্রথমটার প্রতি আকর্ষণ
প্রথম দেখাতেও হয়ে যেতে পারে আবার অনেকটা সময়ও লাগতে পারে। আর মনোজগতের
সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় সহাবস্থানের ফলে। এ দুটো বিষয় যার ভেতর আছে,
তার প্রতি দিনে দিনে ভালোলাগা কাজ করতে থাকে। এ ভালোলাগাগুলো জমতে জমতে
বুকের ভেতরে ভালোরকমভাবে বাসা বেঁধে ফেলে। আর যায় কোথায়! মুখ ফসকে এক
সময় বলে বসে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। তো! ভালোবাসা হয়ে গেলো! এখন!
ভালোবাসা শব্দটির যদি পোস্টমর্টেম করি তো দাঁড়ায়, ভা- ভালোর বসত, ল-
লক্ষ্যের প্রতি আকর্ষণ, বা- বাধা ডিঙানো এবং সা- সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার
সাধনা। অপরদিকে ইংরেজি খঙঠঊ হচ্ছে, এল- লস্ট অব হার্ট, ও- ওশেন অব টিয়ার,
ভি- ভ্যালি অব সরে্যা এবং ই- ইন্ড অব লাইফ। বাংলা পোস্ট মর্টেমটা আমার
আবিষ্কার, ইংরেজিটা ম্যাগাজিনে পড়া। কোন ম্যাগাজিনে পড়েছি মনে না থাকলেও
অন্তত ইংরেজিটার মতো আমি কাউকে নিরুৎসাহিত করি নি এই যা রক্ষে। নইলে
বাংলাদেশে একটা বিশেষ দিনকে পালন করতে তরুণ-তরুণীরা যেভাবে অতি উৎসাহী হয়ে
উঠে, তাদের নিরুৎসাহিত করে শেষতক মার খাবো নাকি! ভালোবাসার বা প্রেমের
পরিণতি কী? আবার কী! প্রেমের পরিণতি হয় মিলন নয়তো বিরহ। ভালোবাসা এমন
মোহনীয় শক্তি, এটা মিলনে যেমন থাকে তেমনি বিরহেও থাকে। শরৎচন্দ্র বলেছেন,
‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলিয়া দেয়।’ ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত
মিলনে গড়ায় এমনটাই সচারাচর ঘটে থাকে। কিন্তু দেহজ ও মনোজ সৌন্দর্যে
আকৃষ্ট হবার পর ভালোবাসার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর মতো দুর্ভাগাও জগতে আছে।
ভালোবাসার অনুভূতি কেমন! এক কথায় বিচিত্র। ‘ভালোবাসি’ কথাটা প্রথমবারের
মতো বলার বা শোনার মুহূর্তে আপনার যে অনুভূতি, এটা আপনি ব্যাখ্যা দিতে
পারবেন না। শ্যামল মিত্র যেমন গেয়েছেন, ‘ভালোবাসো তুমি বলেছো অনেকবার/তবো
সেদিনেরও মতো লাগে নি তো কভূ আর/ সেদিন আমার প্রথম ফাগুন বেলা/মাধবী শাখায়
অনেক ফুলের মেলা/সে ফাগুন আরও এসেছে যে বারেবার...।’ প্রথমবারের মতো
‘ভালোবাসি’ শোনার সাথে সাথে আপনার ভেতরে একটা চনমনে ভাবের জন্ম নিতে পারে।
শব্দের শক্তি আছে। ভালোবাসি শব্দের যে শক্তি এটা আপনার রক্তে একটা নাচন
তুলতে পারে, ঝিমঝিম করে উঠতে পারে সারা দেহ। ভালোবাসি শব্দটার শক্তির আবেশে
আপনি বিবশ হয়ে যেতে পারেন। আপনার অস্তিত্বে কাঁপন তুলতে পারে এ শব্দ।
উলটপালট হয়ে যেতে পারে পরবর্তী জীবন। সুতরাং.... ভালোবাসার কি
শ্রেণিবিন্যাস হয়! একশোবার হয়। ভালোবাসারও আছে রকমফের। সকাম ও নিষ্কাম
প্রেম বা ভালোবাসা। এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। ভালোবাসা সম্পর্কে এতোক্ষণ যে
কথাগুলো বললাম, এটা প্রাপ্ত বয়ষ্ক নর-নারীর স্বাভাবিক প্রণয় বা প্রেম। এ
ভালোবাসার সাথে দেহজ সম্পর্ক থাকবে। যে ভালোবাসা কামের দিকে ধেয়ে যায়,
বুঝতে হবে সেখানে পাশাপাশি দুটি মেরুর অস্তিত্ব আছে, নর এবং নারী। যে
ভালোবাসা সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য, সেখানে কাম থাকবে না। বিশ্ব প্রেমে
পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, কল্যাণ, অগ্রগতি,
করুণা, শ্রদ্ধা, ¯েœহ ইত্যাদির অবস্থানটাই প্রকট থাকে। নিষ্কাম ভালোবাসাটা
ব্যাপক অর্থে প্রকাশ পায়। ¯্রষ্টার প্রতি অবনত মস্তকে যে নিবেদন, এর
পুরোটাই নিষ্কাম। বাবা-মা তার সন্তানকে ভালোবাসেন, ভাই তার বোনকে ভালোবাসে
কিংবা বোন ভাইকে। ছোট বড়কে ভালোবাসে, বড় ছোটকে। এগুলোও নিষ্কাম। ভালোবাসা
বয়স, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রভেদে হয় না। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ১৪
ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে যে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালিত হয়ে আসছে, সেটা আসলে কোন
অর্থে গৃহীত? আমরা দেখছি, এ দিনটিকে একটি বিশেষ বয়সের নর-নারী
অন্যরকমভাবে গ্রহণ করেছে। যেখানে নিছক আনন্দ আর উপভোগ প্রাধান্য পেয়েছে।
মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেলে যা হয়, এখানেও তাই হয়েছে। আমার ভেতরে কৌতুহল
ছিলো, কেন আমরা ভালোবাসা প্রকাশ করতে একটি বিশেষ দিনকে বেছে নেবো! কী আছে
এর পেছনে? এটা কোন ধরনের ভালোবাসা, যে সবাই এ দিনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে? কেন এ
ভ্যালেন্টাইন ডে? কে ছিলো ভ্যালেন্টাইন? কেনইবা ১৪ ফেব্রুয়ারি! এক
ভ্যালেন্টাইন ছিলেন পাদ্রি এবং সেই সাথে চিকিৎসক। পাদ্রি মানে; উনি খ্রিস্ট
ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সে সময় রোমানরা দেব-দেবীর পূজা করতো বিধায় রোমানরা
তখন খ্রিস্টিয়ান ধর্মে বিশ্বাসী ছিল না। তাই ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ২৭০
খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আদেশে ভ্যালেন্টাইন এর
মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তিনি যখন জেলে বন্দী ছিলেন (২৬৯ খ্রিস্টাব্দ) তখন ছোট
ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে ভালবাসার কথা জানিয়ে জেলের জানালা দিয়ে চিঠি ছুড়ে
দিতো। বন্দী অবস্থাতেই জেলার এর অন্ধ মেয়ের চোখের সফল চিকিৎসা করে দৃষ্টি
শক্তি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন এ সাধক। এতে মেয়েটির সাথে তার সখ্যতা গড়ে
উঠে। অনেকের মতে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর নাম অনুসারেই পোপ প্রথম জুলিয়াস
৪৯৬ খ্রিস্টব্দে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস্ ডে হিসেবে ঘোষণা
করেন। কেউ আরো একজন ভ্যালেন্টাইন এর নাম উল্লেখ করেছেন। যিনি রাজার আদেশ
অমান্য করে প্রেম করেছিলেন এবং পরে বিয়ে করেছিলেন। আদেশটা হলো: কোন যুবক
যুবতি বিয়ে করতে পারবে না। কারণ, ঐ সময়ে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস যুদ্ধের
জন্য ভালো সৈন্য সংগ্রহ করতে এ আদেশ করেন। ভ্যালেন্টাইন এ আদেশ অমান্য
করেন, ফলে তার মৃত্যুদ- হয়। কী চেয়েছিলেন ভ্যালেন্টাইন- সকাম ভালোবাসা না
নিষ্কাম? গির্জার একজন
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্য দিন