'হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/মন বাড়িয়ে ছুঁই/দুইকে আমি এক করি না/এককে করি
দুই/হেমের মাঝে শুই না যবে/প্রেমের মাঝে শুই/তুই কেমন করে যাবি?/পা বাড়ালেই
পায়ের ছায়া/আমাকে তুই পাবি।'... কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় ভালোবাসার
সুগভীর অনুভূতি এমনই। সেই সুদূর বৈষ্ণব পদাবলী থেকে রবীন্দ্র-নজরুল যুগ
পেরিয়ে বাংলা কবিতায় প্রেমের শাশ্বত রূপ শতমুখী ফল্গুধারায় প্রবাহিত হলেও
হৃদয় দিয়ে হৃদয় ছোঁয়ার তৃষ্ণা অনন্ত বহমান। প্রতীক্ষিতের ছায়া হয়ে থাকা আর
তাকে মন দিয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার অদম্য বাসনা লালন করার নামই ভালোবাসা। অদ্ভুত এক
আবেশে মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকাই বোধ হয় প্রেমের ধর্ম। হিয়ার পরশে হিয়ার
সার্বক্ষণিক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া, হৃদয় মনে সারা অনুভবে প্রিয়জনের
প্রতিচ্ছায়া মিশে থাকা, প্রগাঢ় এক মোহ, সেকি কেবলই মায়া? জগতের সবাই
ভালোবাসতে চায়, ভালোবাসা পেতে চায়। 'একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে' ভর করা
সাতটি অমরাবতী যে গভীর কথায় তারই নাম ভালোবাসা। সেই অনন্য ভালোবাসার একটি
বিশেষ দিন আজ। আজ ভ্যালেনটাইনস ডে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। মানব-মানবীর
প্রেমের বাইরেও রয়েছে ভালোবাসার অনন্য এক ফল্গুধারা। তাই তো আছে
ঘূর্ণাবর্ত। আহ্নিকগতি, বার্ষিকগতি, দিবা-রাত্রির পালাবদল আর জোয়ার-ভাটার
টান, সে তো চন্দ্রসূর্যের ভালোবাসারই ফসল! ভালোবাসার দ্রোহে-বিদ্রোহে কাঁপে
চরাচর। ভালোবেসে বৃক্ষ হয় ফলবতী। ভালোবাসার আরেক নাম প্রেম। ভালোবাসার
গভীরতা পৃথিবীর কোনো ফ্যাদোমিটারেই পরিমাপ যোগ্য নয়। স্নেহ-প্রীতি, প্রেম
আর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে আজ সারাবিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে বিশেষ দিন।
প্রতীক্ষার যামিনী পোহানোর মধ্য দিয়ে আজ এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৪
ফেব্রুয়ারি, 'বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।' সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও আজ ধ্বনিত
হবে ভালোবাসার পঙক্তিমালা, গুঞ্জরিত ভালোবাসার গানের অমর সুরলহরী। আজ
সারাদিন তরুণ-তরুণীদের হাতে থাকবে লাল গোলাপ, চোখে আনন্দময় আগামীর স্বপ্ন।
দুরু দুরু হৃদয়ে আনন্দ-উত্তেজনা। হাতে হাত রেখে বাকিটা জীবন কাটানোর
প্রত্যয়। ভালোবাসার বন্ধন আর প্রেমের চাদরে ঢেকে যাবে হৃদয়ের পুরোটা
প্রাঙ্গণ। প্রিয়জনকে পাশে বসিয়ে অনেকেই আজ টুক করে বলে ফেলবে হৃদয়ের গভীরে
লালিত সেই না বলা কথাটি। সারা দুনিয়ার মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসবে। স্বামী
ভালোবাসবে স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, পিতামাতা সন্তানকে, সন্তান প্রিয়
বাবা-মাকে হৃদয় উজাড় করে দেবে মধুর ভাব বিনিময়ে। ভালোবাসায় অনুরাগের
তীব্রতা যেমন, বাঞ্ছিতকে হারানোর ভয়ও কম নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
ভাষায় 'অমন আড়াল দিয়ে/লুকিয়ে গেলে চলবে না/এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো/কেউ
জানবে না/কেউ বলবে না।' অথবা মনে মনে আওড়ে উঠবে সবাই_ 'যত গোপনে ভালবাসি
পরান ভরি/পরান ভরি উঠে শোভাতে/যেমন কালো মেঘে অরুণ-আলো লেগে/মাধুরী ওঠে
জেগে প্রভাতে।' যে 'ভালোবাসা দিবস' ঘিরে দুনিয়ায় এত মাতামাতি, তার সূচনা
একটি পরিণয়ের ঘটনা দিয়ে। প্রথা ভেঙে সেন্ট ভ্যালেনটাইন বিয়ে করেন তার
প্রেয়সীকে। তিনি নিশ্চিত জানতেন, এ বিয়ে করলে তাকে মৃত্যুর জন্য 'হেমলক'
পান করতে হবে। তবু তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এবং আলিঙ্গন করে নিয়েছেন
মৃত্যুকেই। তারপর কেটে গেছে কয়েক শতাব্দী। বিশ্বের দেশে দেশে দিনটি এখন
উদযাপিত হচ্ছে 'ভ্যালেন্টাইনস ডে' হিসেবে। যদিও বিশ্বের নানা দেশে এ নিয়ে
রয়েছে নানা মত। রোমানরা এ দিন আর ঘটনা নিয়ে তাদের বিশ্বাসটা ভিন্নভাবে পোষণ
করেন। ভালোবাসা দিবসে আজ দেশজুড়ে নানা আয়োজন আর বর্ণাঢ্য সব কর্মসূচি
রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও রয়েছে বর্ণিল আয়োজন। টেলিভিশন
চ্যানেলগুলোও সম্প্রচার করবে নাটক, আলোচনাসহ নানা অনুষ্ঠান। রাজধানীর
উদ্যানমালা, সংসদ চত্বর, একুশের বইমেলা, পাঁচতারকা হোটেল, কফিশপ, ফাস্টফুড
কোর্ট আর ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবরে ঢল নামবে ভালোবাসায় নিবিষ্ট লাখো
মানুষের। আজকের দিনটি সবার জন্য হয়ে উঠুক গভীর আনন্দ, আবেগ ও গোলাপের
সৌরভে সুরভিত প্রেমময় একটি দিন ।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্য দিন