Pages

আমার এত দুঃখ, আমার এত কষ্ট!


natureআসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন বন্ধু? আচ্ছা, আমাকে সত্যি করে একটা কথা বলুন তো- আপনার জীবনে কখনও না কখনও কী মনে হয়নি; ধুত! আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, আমি একটা অপদার্থ, সবাই আমার চেয়ে কত্ত বেশি ভালো, কত বেশি যোগ্য! আমাকে বোধহয় কেউই পছন্দ করে না, আল্লাহ্‌ও না, আমার জন্য বুঝি কারোরই একফোঁটা ভালোবাসা নেই, আমার এ জীবনটার কোনো মানে নেই! প্রতিটা মানুষের জীবনেই কিছু কঠিন সময় আসে, খুব কঠিন। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা কিচ্ছুটি মানে না সে। বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে, ইস! এ মানুষটা না জানি কত সুখে আছে, কত আনন্দে আছে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে সে কষ্টের তীব্র দহনে ক্ষণে ক্ষণে জ্বলছে, আমরা ধারণাও করতে পারি না।
সত্যি বলতে কি, দুঃসময়গুলো কিন্তু আমাদের আসল রূপটা বের করে নিয়ে আসতে পারে। কীভাবে জানতে চান? উদাহরণ দিতে পারি – খারাপ সময়ে একজন ‘চমৎকার’ মানুষও চরম অসহিষ্ণুতার-অধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে পারে, আল্লাহ্‌র হুকুমের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেলতে পারে। অন্যদিকে একটু ‘খারাপ’ মানুষটা এসময়ে আল্লাহ্‌র হুকুম মেনে নিয়ে আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে আসতে পারে, জীবনটাকে নতুন করে গড়ে নিতে পারে। পরিণত হতে পারে সে সোনার মানুষে। মানব জীবনে দুঃসময়গুলো কিন্তু আসলেই অনেক গুরুত্ব বহন করে।
কষ্টের কত কারণ …
বর্তমান সময়টাতে পুরো পৃথিবী জুড়েই মানুষের মধ্যে হতাশা- বিষন্নতা-মনোকষ্ট বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। আপনার নিজের আত্নীয়-স্বজন আর বন্ধুমহলেই একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন না, আমার কথার প্রমাণ ভালোভাবেই পেয়ে যাবেন। কত-শত কারণ যে আছে মানুষের হতাশায় ভোগার! কেউ মনের মানুষটিকে না পাওয়ার কষ্টে হতাশ, কেউ পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না করতে পেরে দুঃখী, কেউবা পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ না পাওয়ার বেদনায় বেদনাহত, কেউ দেখতে সুন্দর না বা একটু মোটা বিধায় বিষণ্ণ, কেউ খুব আপনজনকে হারিয়ে বিমর্ষ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অ্যান্টি –ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করার হার বাড়িয়ে দিতে হয়েছে সাইকিয়াট্রিস্টদের। আর ওদিকে আত্নহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে।
অন্তরে প্রয়োজন কারও সান্ত্বনার পরশ…
আমরা যখন দুঃখ-বেদনা-হতাশায় থাকি, জীবনটা যখন আর একটুও ভালো লাগতে চায় না; তখন যদি কেউ একটু মায়া নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে পাশে দাঁড়ায়, তবে তার চেয়ে কার্যকর ওষুধ বুঝি আর হয় না! আচ্ছা বন্ধু, আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশি মায়া দিয়ে কি আমাদেরকে কেউ সান্ত্বনা দিতে পারবে? আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র রসূলের (সঃ) পন্থার চেয়ে ভালো কোনো পন্থা হতে পারে না। জানেন তো, এই পৃথিবীতে আর একটি মানুষও নেই, ছিল না যে কিনা মুহাম্মাদ(সঃ) এর চেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করেছে। আর মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনের এমনই এক কষ্টের সময় তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আল্লাহ্‌ নাজিল করলেন ‘সূরাহ আদ-দুহা’।
আল্লাহ্‌র রসূল(সঃ) তখন সবেমাত্র দ্বীন প্রচার শুরু করেছেন এমন এক জাতের মানুষের কাছে যারা কিনা প্রতিনিয়ত তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো, মজা করতো। ঐসময়টাতে ৬ মাসের জন্য ওয়াহী নাজিল হওয়া বন্ধ ছিল। আর সে সুযোগ লুফে নিয়ে ঐ মানুষগুলো হাসি-ঠাট্টার পরিমাণ প্রচুর বাড়িয়ে দিল। তারা বলতে লাগলো, “কি হে, আজকে কোনো ওয়াহী এলো না? তোমার প্রভু নিশ্চয়ই এখন তোমাকে ঘৃণা করে।“ আসলেই কি আল্লাহ্‌ আমাদের রসূলকে (সঃ) ঘৃণা করেছিলেন? আসুন সামনে যাই, দেখি কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
জেগে উঠুন, দেখুন সূর্য উঠেছে…
আচ্ছা বন্ধু, অনেকসময় কি আমাদের মনে হয় না, আল্লাহ্‌ বুঝি সত্যি সত্যিই আমাকে ঘৃণা করেন? আমাদের সব দুঃখ-দুর্দশার পেছনে বুঝি আল্লাহ্‌র ঘৃণা রয়েছে,তাই না?
উঁহু, একদমই না। উত্তরটা আসছে,দেখুন!
“সকালের উজ্জ্বল আলোর শপথ!” [কুর’আন ৯৩:১]
ঘুম থেকে উঠে পড়ুন। দেখুন,দেখুন কি চমৎকার সূর্যের আলো! তাকান আপনার আশেপাশের জীবনের দিকে- তা কিন্তু মোটেও বিষাদে ভরা না।
“রাতের শপথ যখন তা হয় শান্ত-নিঝুম” [কুর’আন ৯৩:২]
হ্যাঁ, একটা হতাশ জীবন যেন আসলেই রাতের নীরবতা-স্থবিরতার মতো। একটুও নড়ে না, একটুও যেন সামনে এগোয় না। কিন্তু রাতের পর কি আসে? হ্যাঁ বন্ধু, উজ্জ্বল-স্নিগ্ধ সকাল। রাত যত গভীর হতে হয়, প্রভাত ততই নিকটে আসে। একটি কৃষ্ণ অন্ধকার রজনী মানেই সামনে অপেক্ষমাণ প্রভাতের সেই আকাঙ্ক্ষিত সূর্য। ভেবে দেখুন না, এই রাতের কয়েক ঘণ্টা আগেও তো একটা সকাল ছিল, দেখতে দেখতে আবার আরেকটা সকাল চলে এসেছে! সবকিছু একদম ঠিকঠাক আছে তো, উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। এখন একটু ঘুমিয়ে নিন।
আল্লাহ্‌ আপনাকে ভালোবাসেন আর আপনাকে পরিত্যাগও করেননি…
“তোমার প্রতিপালক তোমাকে কক্ষনো পরিত্যাগ করেননি, আর তিনি অসন্তুষ্টও নন।” [কুর’আন ৯৩:৩]
শুনুন একটা মজার কথা, আপনার প্রভু এমনকি আপনাকে ‘শুভবিদায়’ও বলেননি, তাই একদম দুশ্চিন্তা না। আরবীতে ‘ওয়াদ্দা’আ’ শব্দের অর্থ ‘loving goodbye’। আপনার প্রতিপালক আপনাকে ভালোবাসার সাথেও শুভবিদায় বলেননি, আর ঘৃণা করা তো দূরের কথা। কি এখনও মন ভরছে না বুঝি? তাহলে চলুন দেখি আল্লাহ্‌ কিভাবে প্রমাণ দিলেন যে তিনি আমাদেরকে অপছন্দ করেন না।
সবকিছু এখনকার চেয়ে ভালো হয়ে যাবে…
“অবশ্যই পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে তোমার জন্য হবে অধিক উৎকৃষ্ট।” [কুর’আন ৯৩:৪]
মন্দের পরে ভালো আসে, ব্যাথার পরে স্বস্তি আসে। আর যদি কোনোভাবে এ জীবনে আকাঙ্ক্ষিত শান্তি পুরোপুরি না-ই ধরা দিল, আল্লাহ্‌র বিশ্বাসী বান্দারা তো জানেই মৃত্যুর পরে রয়েছে জান্নাত! হ্যাঁ, এ জীবনটা বোধহয় একটু কষ্টেরই, কিন্তু চলুন বন্ধু ধৈর্য ধারণ করি, ভবিষ্যত নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে।
“অল্পদিনের মধ্যেই তোমার মালিক তোমাকে (এমন কিছু) দেবেন যে, তুমি(এতে) খুশি হয়ে যাবে।” [কুর’আন ৯৩:৫]
এমন একটা সময় আসছে যখন আল্লাহ্‌ আপনাকে এত নিয়ামাত দেবেন যে আপনি একদম সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। এ দুনিয়াতে যদি কিছু কমও পাই, অন্ততপক্ষে পরকাল তো আছেই আমাদের জন্য। ভেবে দেখুন তো বন্ধু, যদি আমরা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাতে যেতে পারি, তবে আমরা যা চাইব, তার সব সবই পাব জান্নাতে। হয়তো আমাদের এমন কোনো স্বপ্ন ছিল, যা এ দুনিয়াতে কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব না। অথচ জান্নাতে আল্লাহ্‌ নিমিষেই আমাদের সে স্বপ্ন পূরণ করে দেবেন! থাকবে না আমাদের কোনো অশান্তি-অস্বস্তি-দুঃখ-বেদনা-হতাশা। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ভালোবাসেন বলেই তো জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন।
স্মরণ করে দেখুন ইতোমধ্যে তিনি আপনাকে কত অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন…
“তিনি কি তোমাকে ইয়াতীম অবস্থায় পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন” [কুর’আন ৯৩:৬]
আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ইয়াতীম ছিলাম, কেউ বাবা হারিয়েছিলাম, কেউবা মা। আবার অনেকে দুজনকেই। আল্লাহ্‌ কি ওরকম এক অসহায় অবস্থা থেকে আমাদের বের করে আনেননি? আমাদেরকে আগের চেয়ে ভালো রাখেননি? আর আমাদের যাদের বাবা-মা দুজনই আছেন, তাদের কথা কি বলব? আমরা ছিলাম একেবারে অসহায় ছোট্ট শিশু, নিজেদের ছিল না কিছু করার ক্ষমতা। আল্লাহ্‌ই তো আমাদের মা-বাবাকে আমাদের জন্য আশ্রয় হিসেবে মঞ্জুর করলেন। তাদের অন্তরে ঢেলে দিলেন আমাদের জন্য পাহাড়সম ভালোবাসা, আদরে-যত্নে বড় হতে লাগলাম আমরা।
“তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথের দিশা-হীন, অতঃপর দেখালেন সঠিক পথ।” [কুর’আন ৯৩:৭]
আমাদের ফেলে আসা অতীত জীবনটার কথা একটু ভেবে আসি তো বন্ধু। আমরা কি আসলেই পথহারা ছিলাম না? অজ্ঞতা আর পথভ্রষ্টতার সমুদ্রে কি আমরা হাবুডুবু খাচ্ছিলাম না? আল্লাহ্‌ নিজেই তো দয়া করে মায়া করে আমাদের সে অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে এলেন। দেখালেন সঠিক পথ। সেই আল্লাহ্‌ কি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন কখনও?
আমাদের প্রতি তাঁর অজস্র দয়া…
“তিনি তোমাকে পেলেন নিঃস্ব, অতঃপর করলেন অভাবমুক্ত।” [কুর’আন ৯৩:৮]
আমরা ভেবে দেখি না, আমাদের এ জীবনেক,কত প্রয়োজন ছিল, কত চাহিদা ছিল- যার বেশিরভাগই পূরণ হয়েছে। না চাইতেই। কে দিলেন আমাদের? হ্যাঁ, আল্লাহ্‌ই দিয়েছেন। জন্মের পর আমাদের দেখাশোনার জন্য প্রয়োজন ছিল মা-বাবার আদর-ভালোবাসা,দেখাশোনা-যত্ন। চাইতে হয়নি জন্ম থেকেই প্রবল মায়ায় আমাদের লালন-পালন করে চলেছেন তারা। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের দরকার ছিল আমাদের। আল্লাহ্‌ পৃথিবীটা ওভাবেই সৃষ্টি করলেন যাতে আমরা খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে পারি। আমাদের সাহায্যের জন্য যখনই কাউকে প্রয়োজন হয়েছে, তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেম কাউকে না কাউকে। আপনার মনে কি এখনও বিশ্বাস জন্মেনি যে, সামনের দিনগুলোতেও তিনি আমাদের সাহায্য করবেন? যদি বিশ্বাস করে থাকেন, তবে এবার কর্মের পালা। কী করতে হবে জিজ্ঞেস করছেন? আল্লাহ্‌ নিজেই বলে দিচ্ছেন-
“কাজেই তুমি কখনও ইয়াতীমের প্রতি জুলুম করবে না; কোনো প্রার্থীকে কোনো সময় ধমক দিও না।” [কুর’আন ৯৩:৯, ১০]
মোটকথা, চলুন আমরা আমাদের কমিউনিটিতে সক্রিয় হয়ে পড়ি। তাদের প্রতি সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই, যারা আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। তাতে আমাদের অন্তর বিনয়ী হবে, প্রশান্ত হবে। অন্যের এত এত কষ্টের মাঝে আমাদের নিজেদের কষ্টটা গৌণ মনে হবে। ধীরে ধীরে এক শক্তিমান মানুষে পরিণত হব আমরা। আমরা অনুধাবন করতে পারব আল্লাহ্‌র রহমাতের চাদর কীভাবে আমাদের আচ্ছাদন করে রেখেছে। আমরা হব কৃতজ্ঞতার বর্ষণে সিক্ত
প্রকৃত শান্তি যেখানে…
“তুমি তোমার মালিকের অনুগ্রহসমূহ প্রকাশ করতে থাক।” [কুর’আন ৯৩:১১]
আমার এটা নেই, আমার ওটা নেই, আমার কত অভাব, ও কত সুখে আছে- এরকমটা অনেক বলেছি আমরা,অনেক। এবার একটু চিন্তা করার পালা। চলুন, এখন থেকে বলা শুরু করি, আল্লাহ্‌ আমাদের কি কি দিয়েছেন, কি কি পেয়েছি আমরা। আর সেগুলোর জন্য অন্তর থেকে ধন্যবাদ দিই আল্লাহ্‌কে, শুকরিয়া আদায় করি তাঁর। ভেবে দেখি তো, শেষ কবে আমাদের অমূল্য দুটো চোখের জন্য আমরা আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ জানিয়েছি? আমাদের ভীষণ শক্তিশালী রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দিলেন যিনি তাঁকে ঠিক কতদিন ধন্যবাদ দিয়েছি? আমাদের শরীরে যে ক্যান্সার বাসা বাঁধেনি এখনও, সে কৃতজ্ঞতা কতবার প্রকাশ করলে আদায় হবে বন্ধু?
আল্লাহ্‌র সিদ্ধন্তের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই পারে আমাদের জীবনটা সুখে-আনন্দে-সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে তুলতে। আল্লাহু আ’লাম। আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে হতাশামুক্ত সুখী জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন