Pages

ভালবাসা সম্পর্কিত ৭টি কথাঃ

১. কারো চোখ, বা ঠোঁট কিংবা সুগঠিত শরীর এর কারনে ভালো লাগে

-তবে টা ভালবাসা নয়, বাছাই করা...

২. কারো বুদ্ধিমত্তা বা জীবনের দূরদর্শিতা থেকে কাউকে ভালো লাগে
-তবে তা ভালবাসা নয়, প্রশংসা মাত্র...

৩. কারো অর্থ-সম্পত্তি দেখে কাউকে ভালো লাগে
-তবে তা ভালবাসা নয়, লোভ...

৪. কেউ ছেড়ে যেতে চাচ্ছে বলে অপরজন সবসময় কাঁদে
-তবে তা ভালবাসা নয়, করুণা...

৫. মনঃবাসনা পূরণের জন্য কাউকে দরকার হলে
-তবে সেটা ভালবা-তবে সেটা ভালবাসা না, লালসা...

৬. যদি এটা ঘুমাতে, খেতে কিংবা পড়তে ভুলিয়ে দেয়
-তবে তা ভালবাসা নয় মোহ...

৭. আপনি জানেন না কেন তবু ওই মানুষটাকে ভালো লাগে
-তবে সেটাই ভালবাসা...

ভালবাসতে কেবল একটি কারন লাগে আর তা হল অজানা.

কিউট লাভ

"একবার দেখতে চাই"

তখন আমি সবে ক্লাস টেনে উঠেছি। স্কুল এস এস সি পরীক্ষার জন্য বন্ধ ছিল। একদিন সকাল ১০ টার দিকে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছিলাম। হঠাত্‍ করে একটা মেয়ে বলে উঠল, ভাইয়া কেমন আছেন? আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটা ছেলে সাইকেল করে গেল। আমি মনে করলাম, মেয়েটা তাকে জিঞ্জেস করেছে। আমি চলে যাচ্ছিলাম। মেয়েটা এবার আমাকে বলল, ভাইয়া আপনাকে বললাম? আমি বললাম,ভালো। আমাকে জিঞ্জেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? আমি উত্তর দিলাম, ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছি। সে বলল, আপনারা ছেলে মানুষ, খেলতে যেতে পারেন। আমাদের বাসায় থাকতে হয়। একথা বলে সে চলে গেল। আমি মেয়েটাকে চিনি না অথচ সে আমাকে চিনে। আমি বিকেলে আমার বন্ধুদের সব বললাম। তারা চিনতে পারল না। পরদিন বিকেলে সে আমার বাড়ির সামনে যাচ্ছিল।আমিও সে সময় বের হচ্ছিলাম। আমার সাথে কথা বলে সে চলে যাচ্ছিল।আমি তার নাম জিঞ্জেস করলাম। সে বলল,"অহনা"(আসল নাম নয়)।তারপর থেকে তার সাথে আমার মাঝেমধ্যে দেখা হত। স্কুল খুলল। আমরা কয়েকজন বন্ধু ওদের বাড়ির ওদিকে ঘুরতে যেতাম। একদিন ওর সাথে দেখা ও হয়ে গেল। সে একটা লাল-সবুজ রঙের পোশাক পড়েছিল। তখন কলকাতায় দেব-শুভশ্রীর "চ্যালেঞ্জ" ছবি চলছিল। অহনাকে আমার কাছে শুভশ্রীর মতো লাগছিল। ঐ মূহুর্তে আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে ছিল সে।

এস এস সি দিলাম। তার সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছিল। পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। গোল্ডন A+ পেলাম। আমি একদিন গার্লস স্কুলের পেছন দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম। তার সাথে দেখা হল।সে আমাকে বলল, আপনি গোল্ডেন A+ পাইছেন, আমি কত যে খুশি হইছি। তার কথা শুনে "i was flattered''এরপর ধীরে ধীরে তাকে ভালো লাগতে থাকে। একদিন বিকেলে তার সাথে দেখা হলো। সে ফর্সা ছিল। প্রচন্ড গরম সে সময়। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি তাকে বললাম, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। she was flattered. নতুন বছর এল। তাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা চলছিল। আমি আর আমার কয়েক বন্ধু গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে দুতলার বারান্দায় দাড়িয়েছিল। আমি আমার এক বন্ধুর ঘাড়ে হাত রেখে তাকে hi দিচ্ছিলাম। সে ও আমাকে hi দিচ্ছিল।

মানুষের ভাগ্যে সুখ বেশিদিন সহ্য হয় না। তার বাবা বদলি হয়ে এই শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেল। তার সাথে আমার শেষবার দেখা হয়েছিল ৩০শে মে। আমি তাকে নাম ধরে অনেকবার ডেকেছিলাম। সে কোন উত্তর দেয়নি। আমি জানি, সে এখন কোথায় আছে। মাঝে মাঝে তার প্রতি খুব রাগ হয়। চলেই যদি যাবে, তাহলে কেন স্বপ্ন দেখালে? তুমি কি আমাকে ভালোবাসনি? আমার কথা কি তোমার মনে পড়েনা? তোমাকে দোষ দিব না। সব দোষ আমার। হয়ত বেঁচে থাকলে তোমার সাথে দেখা হবে। কিন্তু তোমাকে কোন প্রশ্ন করব না। তোমার প্রতি আমার কোন চাওয়া, অভিযোগ নাই। যারে ভালোবাসি, তার কি কোন খারাপ চাইতে পারি?পারি না। একবার শুধু তোমাকে দেখতে চাই।

পরাজয়

                                                                                                                                খুব বিরক্ত হয়ে সোফার এক কোনায় বসে আছে ইফতি। শত বিরক্ত হলেও মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। ছোট ভাইয়ের বন্ধুর জন্মদিন। মায়ের আদেশে ভাইকে নিয়ে আসতে হয়েছে। নিজের বয়সী কাউকে না পেয়ে বেকার বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। কেক কাটা শেষ, রাতের খাবারটা সেরেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি। ভেতরে সব বাচ্চারা হইচই করছে, একটু বাইরে বের হবে ইফতি। গেটের মুখে এসে থমকে গেলো। মানুষ এতো সুন্দর হয় ?! কত বয়স হবে, ইফতি থেকে বড়জোর ২/৩ বছর ছোট। মেয়েটাকে দেখে ইফতির প্রথম মনে হল এই মেয়ের সামনে গিয়ে কথা বলা সহজ হবে না। এতোখানি দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আগে কখনও কোন মেয়ের মধ্যে দেখেনি সে।




যদিও মেয়েদের সামনে সে বরাবরই কখনও মুখ ফোটাতে পারেনি, তবুও মেয়েটির অদ্ভুত রূপ এবং ব্যক্তিত্ব আচ্ছন্ন করে রাখে অনেকক্ষণ। ছোট ভাইয়ের সাথে অনেকটাই ফ্রী ইফতি। বাড়ি ফেরার পথে আর না থাকতে পেরে ভাইকে জিজ্ঞাসা করে বসে-
-‘হ্যাঁরে প্রতীক, ঐ মেয়েটা কে রে?’
-‘কোন মেয়েটা?’
-“ঐ যে সাদা-কালো জামা পরা লম্বা করে?”
-“ও...উনি? উনি তো আমাদের দীপাদি...দীপান্নিতা... আমরা দীপাদি বলে ডাকি। আমার বন্ধুর বড় বোন। আমাদের স্কুলেই পড়ে। খুব ভালো ছাত্রী।





আচ্ছা! এই ব্যাপার। ইফতির মনে কেবল দীপার আশ্চর্য সুন্দর মুখটা ভাসতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই ইফতি একটু মুখচোরা। পরিচিত গণ্ডিতে হৈ-চই করতে তার জুড়ি নেই, কিন্তু অপরিচিত মানুষের সামনে একবারে চট করে সহজ হতে পারে না সে। মেয়েদের বেলায় তো আরও শোচনীয়। যাহোক, কদিন পর ভাইয়ের সাথে কথায় কথায় জানা গেলো দীপাদের বাসাটাও খুব দূরে নয়। কীভাবে যোগাযোগ করা যায় দীপার সাথে ? তখনও এখনকার মতো সবার হাতে হাতে মোবাইল আসে নি। দীপাদের বাসার আসে-পাশে যাতায়াত বাড়তে লাগল ইফতির। দীপার বাবা সরকারি চাকুরে। সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের একমাত্র কন্যা দীপা। কৌশলে একদিন ওদের বাসার দারওয়ানের কাছ থেকে দীপার বাবার মোবাইল নাম্বার টা যোগাড় করে ফেলল সে। কিন্তু ফোন করে কাকে চাইবে সে ? দীপার বাবাই তো ধরবেন। ভাবতে ভাবতে সে রাতে সাহস করে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলো ইফতি। নাহ, কোন উত্তর নেই।





২/৩ দিন পর যখন ইফতি প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছে, একরাতে হঠাৎ অবাক করে দিয়ে মেসেজ এর উত্তর এলো।
-কে আপনি?
খুশির একটা স্রোত বয়ে গেলো ইফতির ভেতর দিয়ে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়েও কি মনে করে প্রতুত্তর করলো সে
-আমি সায়ন । নটরডেম কলেজে পড়ি।





কোন ফোন দেয়া নয়, কেবল মেসেজ আদান প্রদান চলতে লাগল তাদের। জানা গেলো দীপার নিজের মোবাইল নেই। যখন ইচ্ছে হতো তখন বাবার মোবাইল থেকে মেসেজ দিত দীপা। ইফতির উত্তর দিতে দেরি হতো না। আস্তে আস্তে ইফতি বুঝতে পারে, আসলে দীপার কাছের বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই। ইফতির কাছে নিজের সবকিছু শেয়ার করতে ভালবাসে দীপা। ইফতিও যতটা পারে ততটা সাপোর্ট করতে লাগল। কেউ কাউকে না দেখে, কথা না বলে অদ্ভুত এই যোগাযোগ চলতে লাগল। অবশেষে এক রাতে দীপা নিজেই ফোন করলো ইফতিকে। কথায় কথায় নিজের আসল পরিচয় দিলো ইফতি। ভেবেছিল দীপা অনেক রাগ করবে। কিন্তু না, দীপা একটু মন খারাপ করলেও মেনে নিয়েছিল। ৩ মাস পর একদিন দীপার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হল ইফতির। স্কুলের সামনে গিয়ে দীপার দেখা পেল ইফতি। ইফতির হাতে চট করে একটা হলমার্কের কার্ড ধরিয়ে দিয়েই তরিঘড়ি করে রিকশায় করে মিলিয়ে গেলো দীপা। রাতে ফোন এলো দীপার।





-কী ব্যাপার বলতো? আনন্দ মেশানো গলায় প্রশ্ন ইফতির...।
-কী আবার ? বন্ধু তো বন্ধুকে উপহার দিতেই পারে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? দীপা উত্তর দেয়।
নিয়মিত যোগাযোগ হতো না ওদের। হয়ত সপ্তাহে একবার। কিন্তু এই একটা বারের সুযোগটুকুর অপেক্ষা করত দুজনেই অধীর ভাবে। দুজনেই দুজনের সঙ্গ উপভোগ করে দারুনভাবে। ইফতি তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারা দিন কোচিং ক্লাস আর দীপার চিন্তায় দিন কাটে তার। একই শহরে থাকলেও দীপার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। দীপার স্কুল এবং কোচিং এ ওর মা সাথে যান। কিছুই করার নেই। শুধু ফোনে কথা বলেই দিন কাটতে লাগল। ভালবাসার কথা মুখ ফুটে বলা হয়নি কারোরই, তবে দুজনেই দুজনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ভালমতই।
এক রাতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না দীপা। অসহায় ভাবে নিজের ভালবাসা প্রকাশ করে ইফতির কাছে। ইফতিও কম ভালবাসে না দীপাকে। কিন্তু দীপা হিন্দু, আর ইফতি মুসলমান। ধর্মের বাঁধার কথা একটা বারের জন্যও মনে আসে না কারোর। অমোঘ নিয়তির কাছে নিজেদের ভবিষ্যৎকে সঁপে দিলো দুজন।





বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ভালো হল না ইফতির। খুব মুষড়ে পরল সে। বলতে গেলে দীপার একক আগ্রহে পরের বছর আবার পরীক্ষা দিলো ইফতি। এবারে ঠিকই সুযোগ পেল কিন্তু ঢাকা থেকে অনেক দূরে সিলেটে । এরই মধ্যে অনেক গুলো বছর পার হয়ে গেছে। দীপাও কলেজে ভর্তি হয়েছে। কষ্টে বুক বেঁধে বাবা-মা, পরিবার, দীপাকে ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলো ইফতি। যোগাযোগের জন্য কেবল মোবাইলটুকুই ভরসা। দীপা নিজের মোবাইল নেয় নি তখনও। তার বাবার ভয়ে যখন তখন ফোন করতেও পারে না ইফতি। কেবল মাত্র যখন দীপা মিসকল দেবে তখনই কথা বলা সম্ভব। ইফতি নিঃসঙ্গ জীবনে দীপাই একমাত্র আনন্দের উৎস। দীপাও বোঝে ব্যাপারটা। দীপার জীবনেও ছেলে বলতে কেবল ইফতিই। হাসি আনন্দ বেদনা সব মিলিয়ে বেশ চলতে লাগল ওদের জীবন। মাঝে মাঝে ঢাকা এলেও দীপার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয় না ইফতির। এ নিয়ে অভিমান হলেও দীপার সমস্যার কথা ভেবে সে মেনে নিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের পর তো দীপা হোস্টেলে থাকবে, তখন তো ইচ্ছে মতো দেখা করা যাবে, এই ভেবে সান্তনা নেয় ইফতি।




উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলো দীপার। ওর খুব ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ার। খুব ভালো ছাত্রী হয়েও বুয়েটে সুযোগ পেলো না দীপা। বাধ্য হয়ে রুয়েটে সুযোগ পেয়ে সেখানে ভর্তি হল দীপা। দুজনের ঠিকানা হল বাংলাদেশের দুই প্রান্তে। এখন নিজের মোবাইল নিয়েছে দীপা। রাজশাহী চলে যাওয়ার আগের রাতে ফোন করলো ইফতিকে।
-আমি তোমার কাছ থেকে আরও দূরে সরে গেলাম, তাই না? তুমি কি এতো দূরে কখনও আসবে আমাকে দেখতে ? কান্না ভেজা কণ্ঠে দীপা শুধায়।
-আরে পাগলি, তুমি দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকো না কেন, দেখো আমি ঠিক চলে আসব! কষ্ট চেপে হাসতে হাসতে বলে ইফতি।




শুরু হল দীপার হোস্টেল জীবন। ইফতি মুখে যতই বলুক এতোটা দূর আসবে ওর সাথে দেখা করতে, সেটা ভাবে নি দীপা। কিন্তু দীপাকে অবাক করে দিয়ে দুই সপ্তাহের মাথায় ঠিকই হাজির ইফতি। ইচ্ছে মতো রিকশায় ঘুরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া করলো দুজন মিলে। এতোটা বছর পর ইফতিকে নিজের মতো করে পেয়েছে দীপা। ছাড়তে মন চায় না তার। কিন্তু ইফতিরও তো পড়াশোনা আছে। ৩ দিন পর আবার সিলেটে ফিরে যায় সে। মোবাইল এর কল্যাণে দূরত্ব বাধা হয় না ওদের প্রেমের কাছে। সারা দিন রাত কথা হয় আর সুযোগ পেলেই ইফতি ছুটে যায় দীপার কাছে। দীপার জন্য এটা ওটা কিনে পাঠাতে ভুল হয় না ইফতি। দীপাও যতটা পারে পাঠায়।






ইফতিকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে ক্লাসে যায় দীপা। সারাদিনের ব্যস্ত সময়েও ঠিকই খোঁজ নেয় আর ওর অগোছালো অভ্যাসের জন্য রাগ করে। ইফতিও যখনই যে অবস্থায় থাকুক দীপাকে একটু পরপর ফোন করতে ভোলে না। সারাদিন কি হল না হল সেটা না বলা পর্যন্ত যেন শান্তি পায় না কেউ। দু’জনের সারাদিনের ক্লান্তি শেষ হয় অনেক রাত অবধি এটা সেটা নিয়ে খুনসুটি করতে করতে।
মাঝে মাঝে দীপা ভবিষ্যতের কথা ভাবে। কী পরিনাম হবে এই সম্পর্কের ? ধর্মের বাঁধার কাছে অসহায় দুজনেই। বাবা-মাকে ছেড়ে আসার কথা ভাবতেও পারে না দীপা। ইফতি তো এগুলো ভাবতেই চায় না। তাকে বললে সে কেবল বলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে ? জানে না দুজনের কেউ ই। ইফতি দীপার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ও যদি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে ইফতির কী হবে তা ভাবতেও বুক কাঁপে দীপার। কিন্তু এভাবে কতো দিন? ভেবে কূল পায় না দীপা।





দিন যায়, বছর যায়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট অভিমান যখন ঝগড়ায় রূপ নেয়, তখন দীপা বলে ওঠে আমি আর সম্পর্ক রাখব না তোমার সাথে। তবে রাগের ধাক্কা কেটে গেলে আবার দীপাই ঠিকঠাক করে সব । পরম আদরে কাছে টেনে নেয় ইফতিকে।
পরেরবার রাজশাহী গিয়ে ইফতি টের পায় যে সব কিছু আগের মতো নেই। কোথায় যেন সুর কেটে যেতে শুরু করেছে। রিকশায় ইফতির হাতে নিজের হাত রেখে দূর দিগন্তে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বসে থাকে দীপা। ইফতি জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে। চমকে উঠে দীপা বলে- কই, কিছু না তো!
চিন্তিত ইফতি সিলেটে ফিরে আসে। বার বার দীপাকে জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর পায় না সে। সব কিছু চলতে লাগল আগের মতোই।
একদিন আচমকাই সিদ্ধান্তটা এলো। দীপা ফোন করে ইফতিকে জানিয়ে দেয় যে তার পক্ষে আর সম্পর্কটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। হতবাক হয়ে যায় ইফতি। না, কেবল ধর্মের বৈরিতা নয়, তাদের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অন্য কেউ। সুজয় এর কথা আগেও জানত ইফতি। কিন্তু শুধুই দীপার বন্ধু বলে জানত। মাঝে মাঝে দীপার সাথে ফোনে কথা হতো। সেই সুজয় দীপাকে ক’দিন আগে প্রপোজ করেছিল । কিন্তু দীপা সুজয়কে কেবল বন্ধু হিসেবে দেখত বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এই সব কথাই ইফতিকেই বলেছিল দীপা। কিন্তু আজ দীপা ইফতিকে জানিয়ে দেয় যে সে এখন সুজয় কে খুব বেশি ফীল করছে এবং আজ রাতে সে সুজয় কে প্রপোজ করবে। দীপা খুব খুশি হবে যদি ইফতি ওকে আর ফোন না দেয়।





ইফতি পারেনি নিজেকে শক্ত রাখতে। অসহায় ভাবে ভেঙ্গে পড়ে দীপার কাছে নিজের প্রেম ভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু না, দীপা ফিরে আসেনি আর।
দীপা চলে গেছে আজ অনেক দিন। প্রায় বছর ঘুরতে চলল। দীপা আর কোনোদিনই ফোন দেয়নি ইফতিকে। সুজয়ের সাথে ভালমতই প্রেম চলছে সে খবরও পেয়েছে ইফতি। যাওয়ার সময় দীপা বলে গিয়েছিলো ইফতি যেন ওকে ভুলে যায়। ইফতিকে আর মনেই পড়ে না দীপার। কিন্তু ইফতি ভুলতে পারেনি দীপাকে। ঈশ্বর ইফতিকে ভালবাসার ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু ভুলতে পারার ক্ষমতা দেননি।
সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন রাতে ঘুমোতে পারেনি ইফতি। ও জানত দীপার সাথে ওর বিয়ে হওয়াটা প্রায় অসম্ভব ছিল। নিয়তির কাছে পরাজিত হলেও তা মেনে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করত সে। কিন্তু এতগুলো বছরের ভালবাসা নিয়ে মাত্র কয়েকদিনের ভালবাসার কাছে হেরে গিয়ে এখন বোবা হয়ে গেছে ইফতি।

অশ্রুবিন্দু

"ফ্রেন্ড এবার বলেই ফেলব।এভাবে আর থাকা সম্ভব না ।"
"হুম বলে ফেল । পরে দেখবি কোনদিন তোর পরান পাখি খাচা ছেড়ে উড়াল দিয়েছে ।", তাওসিফের কথার উওরে বলল হাসান ।হাসান হচ্ছে তাওসিফের রুমমেট।তারা "নুরুঊদ্দিন মোহাম্মদ ডিগ্রী কলেজ"এর ১ম বর্ষের ছাত্র এবং তারা কলেজ হোস্টেলে থাকে।তওসিফ বলল,"যা ব্যাটা,কই একটু উত্‍সাহ দিবি তা না ,উল্টো আরো আজেবাজে কথা বলছিস।যা ভাগ ।"হাসান মুচকিহেসে চলেগেল ।আর তাওসিফ ডুব দিল তার স্বপ্নের রাজ্যে।সুখের স্বপ্ন....।এক স্বপ্নে তার রাত পার হয়ে গেল ।

"নুরুঊদ্দিন মোহাম্মদ ডিগ্রী কলেজ"।ক্লাস চলছে।দেরী করে ঘুম থেকে উঠার কারনে তৌসিফ ঠিক সময়ে ক্লাসে আসতে পারল না।পেছনের দরজা দিয়ে কোনমতে ক্লাসে ঢুকল।ঢুকেই স্বভাবসুলভ সারা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিল।একটা জায়গায় এসে তা আটকে গেল। তার স্বপ্ন কন্যা...।ধীরে ধীরে সে ডুব দিল তার স্বপ্ন সমুদ্রে।কোনদিকে যে ক্লাস আওয়ার যে শেষ হয়ে গেল তা বুঝতেই পারলনা।
ছুটির পর হোস্টেলের দিকে রওয়ানা হল।সে কলেজের হোস্টেলে থাকে।ক্যাম্পাস থেকে হোস্টেল খুব বেশী দূরে নয়।পথে ক্যান্টিনে দেখতে পেল-তান্নিকে।তান্নি।তান্নি...।সেই স্বপ্ন কন্যা।যার কথা ভেবে তার সারাদিন-রাত কাটে।তাওসিফের মনে হল এখনি গিয়ে কথা বলে।কিন্তু তার মধ্যে আবার ভর করল সেই পুরনো ভয়।আজানা ভয়।মনের ইচ্ছাকে আবার চাপা দিতে হল।

রাতে সে শুয়ে আছে।এই মাত্র রাতের খাবার খেয়ে এল।পরীক্ষা সামনে তাই পড়তে বসল।কিন্তু তাতে তেমন মন বসাতে পারলনা।সে রাতের পড়ালেখাও বিসর্জন দিল তান্নির কথা ভাবতে ভাবতে ।

এভাবে বলি বলি করে অনেক দিন কেটে গেল।কিন্তু তার মনের কথা মনেই থেকে গেল ।প্রতিদিনই সে কলেজে যায় ।আবার ফিরে আসে ।কিন্তু বলি বলি করেও বলা হয় না তার না বলা কথা।

অনেকদিন পর।
একদিন কলেজের ক্যান্টিনে,তাওসিফ তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।আড্ডা তখন সবে জমে উঠতে শুরু করেছে।তখনই সে খেয়াল করল তান্নি তার কয়েকজন বান্ধবীদের নিয়ে ক্যান্টিনে প্রবেশ করেছে।তাওসিফের মনে যেন ঝড় বয়ে গেল।আনন্দের ঝড়।এ ঝড় তার মনকে উড়িয়ে নিয়ে গেল দূরে...অনেক দূরে...।আপলক সে তাকিয়ে আছে তান্নির দিকে।হঠাত্‍ সে দেখল তান্নি এদিকে ফিরছে।তাকে অবাক করে দিয়ে হাসল।তাওসিফের মনে হল তার হৃত্‍পিন্ড যেন খাঁচা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।তান্নির হাসির জবাবে সেও একটু হাসল।অথচ সে দেখল না,তার পেছনের টেবিল থেকে আরও দুটি চোখ একই দিকে তাকিয়ে আছে।

খুশী মনে সেদিন তাওসিফ হোস্টেলে গেল।ঐ রাতটাও উত্‍সর্গ করল তান্নিকে নিয়ে ভাবার কাজে।সে খেয়াল করেছে যখনই সে তান্নির কথা ভাবে তখনি তার মন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে যায়।এই ভালোবাসাই তার জীবনে এনে দিয়েছে এতো শান্তি।সে মনে মনে মহান আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করল।এসব কথা ভাবতে ভাবাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারবেনা।

সপ্তাহখানেক পরের কথা।তাওসিফ কলেজে গেল এবং সারাদিনক্লাস করে কাটাল।সেদিন সে মনস্থির করে ফেলল আজ যে করেই হোক তান্নির সাথে কথা বলবেই।অবশ্য প্রতিদিনই এই কাজটি করতে চায়।কিন্তু তার সমস্যা একটাই সে কখন কোন মেয়ের সাথে কথা বলেনি।আর আসল ব্যাপার সে গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা। তার ভয়,কথা বলতে গেলেই যদি তান্নি মন খারাপকরে,যদি তাকে খারাপ ছেলে মনে করে।
তবে আজ সে দূঢ় প্রতিঞ্জ,যে করেই হোক কথা বলবেই।

ছুটির পর সে কলেজ গেইটের কাছের শিমুল গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে আছে।অবশ্য একাজটা সে প্রতিদিনই করে ।তান্নি প্রতিদিন এদিক দিয়েই পাশের বাস স্ট্যান্ডে যায়।তবে আজকে দিনটার কথা আলাদা ।আকাশের মনটা আজ বেদনার কালো মেঘে ছেয়ে আছে।যেকোন মুহুর্তে ফেটে পড়বে অঝোর ধারায়।

অনেক্ষন যাবত সে দাঁড়িয়ে আছে।কলেজের প্রায় সব ছাত্র ছাত্রীই চলে গেছে।কলেজ প্রায় ফাঁকা।অদূরেই দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র বাইক নিয়ে বসে আছে।তাকে দেখে তাওসিফ মনে মনে হাসল।সে মনে মনে ভাবল "ঐ বড় ভাই বোধ হয় আমার মত একই কারনে দাঁড়িয়ে আছে"।

ইতিমধ্যে টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।এ সময় বেরিয়ে এল তান্নি।তাওসিফের হৃদপিন্ডের কম্পন ভয়াবহ রকমে বেড়ে গেল।অথচ সে খেয়াল করল তান্নির যে দিকে আসার কথা সে সেদিকে আসছে না।তাওসিফ কিছুটা অবাক হয়ে গেল।তাকে আরো অবাক করে দিয়ে তান্নি এগিয়ে গেল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রটির দিকে।কিছুক্ষন কথা বলার পর সে ছেলেটির হাত ধরে উঠে বসল তার বাইকে।তাওসিফ দম বন্ধ করে ফেলল ।দেখতে দেখতে দীর্ঘ হাইওয়ের মোড় ঘুরে তাদের বাইকটি হারিয়ে গেল অন্য পাশে।এতোক্ষনে তাওসিফের চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে।বৃষ্টির জলের সাথে মিশে যাচ্ছে তার চোখের জল ।নির্জন প্রান্তরে সে একাদাঁড়িয়ে আছে।তার বুঝাতে আর বাকি নাই যে ঐ ছেলেটা তান্নির প্রেমিক ।অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে তার চোখ দিয়ে ।আর তার এতোদিনের জমানো সব স্বপ্ন বেরিয়ে যাচ্ছে অশ্রুবিন্দু হয়ে। ___

লেখকের কথাঃ এ গল্পের কাহিনী বা চরিত্র সবই বাস্তব ।তবে কলেজের নামের পরিবর্তন করা হয়েছে

আপেক্ষা....

                                                                                                                               প্রতিদিন মোবাইলে একটা মিস কল আসতো ।প্রথেম ভাবতাম হয়তো কেউ মজা করে
।কিন্তু সে নাম্বার কল করলে কেউ রিসিভ করে না। তবে মিস কলটা আমার বাসার
মোবাইলে আসতো যেটা আমার আম্মুর কাছে থাকতো ।একদিন সেই নাম্বার থেকে একটি
মেসেজ দিয়েছে শেষে আমার নামটি ছিলো ,প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম ।।মেসেজ
পড়ে জানতে পারলাম যে সে নাকি আমাকে অনেক পছন্দ করে।।মনে মনে খোঁজার
চেষ্টা করলাম কে এমন মেসেজ দিতে পারে  কাউকে খুজে পেলাম না ।




এমন মেসেজ আর মিস কল চলতে থাকলো অনেক দিন ।।
তবে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সে কে ।।আমার মোবাইল থেকে তাকে কল করলাম
।।সেদিন সে কল রিসিভ করেছিল।।
সে বলল,আপনি কে বলছেন ?
আমি বললাম ,আপনি আমাকে চিনেন।।
সে বলল চিনতে পারছিনা আপনি বলুন কে আপনি ?
বললাম যাকে আপনি প্রতিদিন মিস কল দেন আমি সেই ।।।
তারপর সে চুপকরে থাকলো।।
আমি বললাম,কে আপনি আর কেন মিস আর মেসেজ দেন ।।আমি কি আপনাকে চিনি ?
সে তার নামটা বলেছিল।।সে নাকি আমাকে চেনে ,আমাকে রাস্তায় দেখে ।আমার
বাসার আশেপাশে তার বাসা।।কিন্তু আমি তাকে চিনিনা ।।
আমি তাকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম ।।
সে বলেছিল,সময় হলে সেই দেখা করবে।।
জানিনা কেন জানি সেদিন তাকে অনেক বকে ছিলাম,মিস কল মেসেজ দিতে নিষেধ করেছিলাম।।



সে নাকি আমাকে অনেক ভালোবাসে তাহলে সামনে আসতে সমস্যা কি ?
কয়েকদিন পর সে আমাকে একটা মেসেজ দিয়েছিল,যেটা পড়ে বুঝলাম সেদিনের
কথাগুলোতে সে কষ্ট পেয়েছিল।।তারপর আমি তার সাথে দেখা করতে চেয়েছি
।।তবে এখনও সে সময় হয়নি।।সেএখনও আমাকে মিস কল আর মেসেজ দেয়।।জানিনা
কেন সে দূরে থাকতে চায়,
জানিনা কে সে ,তাকে জানার অপেক্ষায় রইলাম

জন্মদিনে ভালবাসা।

                                          গধূলীর রঙ বিহীন রাতের আধার, সঙীহীন আকাশের তারা। নীরব নিথর চারদিক। কোন সাড়া শব্দ নেই.. সবাই ঘুমিয়ে।একা বসে বসে ভাবছি আমি।
ঘুমিয়ে তুমি.....হয়ত গভীর স্বপ্নে ও বিভোর। সুন্দর আগামী দিনের স্বপ্ন। কেননা আজ রাত টা পেরুলে ই তুমার জীবনে নতুন আর একটা বছর যোগ হচ্ছে। নতুন ভোরে তুমি পা রাখছ ২৪ এ। নতুন জীবনের নতুন স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে ভোরের সূর্যের সোনালি আলোর ঝলকানিতে। হ্যা হ্যা তাই যেন হয়। আল্লাহ যেন তোমার সকল চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করেন!
অবাক হতে পার তুমি নীল তোমাকে wish করে নি। অথচ.... মন খারাপ কর না। আমি কোনদিন তোমাকে wish করব না। কারন আমি চাই না অন্য সবার দলে আমি ও থাকি। অন্য সবাই তোমাকে wish করুক। আমি যে ভীষণ জেদি। যাই মন বুঝে তাই করি। তাই ঠিক করেছি কোন বিশেষ দিনে তোমাকে wish করব না। হ্মমা কর আমায়...


তাই বলে আবার ভেব না তোমাকে আমি ভালবাসি না। এটা যে মস্ত বড় ভুল হবে তোমার ।আমার সকল ভাবনা তোমাকে ছুয়ে। জানো তুমি হীনা আমার কোন ভাবনা বেশিহ্মণ স্থায়ী হয় না। আমার রঙ তুলিতে রঙ ওঠে না তুমি ছাড়া।



নীল হৃদয়ের নির্জনতাকে তাড়িয়ে দিয়ে তুমি এসেছ আমার হয়ে। আমার দু চোখের পাতায় ভর করা স্বর্গ রচনার স্বপ্ন তুমি। আছ মিশে আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে,আমার প্রতিটা নিশ্বাস তোমাকে ঘীরে।


তোমার অনুপ্রেরণা নিয়ে হয় আমার পথ চলা। আমি বেশ আছি তোমায় নিয়ে।তুমি রাঙিয়েছ আমার পৃথিবী। আর এই পৃথিবীর সমস্ত সত্তাধীকারি তুমি। একান্তই তুমি। সব ক্লান্তি আর জড়তা শেষে তোমার ছোয়ায় আমি হাসি, গাই। এর সব ই হয়েছে তোমাকে পেয়েছি তাই।


এই পৃথিবীর কোলাহল থেকে আড়ালে আমার হৃদয় মন্দিরে সারাহ্মন তোমার অবাধ বিচরণ আমাকে মাতিয়ে রাখে। তোমার ভালবাসা নিয়ে আমি বেঁচে আছি। চাই ও সারাটা জীবন তোমার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকতে।

তোমাকে কত্তটা ভালবাসি বুঝাতে পারি না।সত্যি বলতে কি জানো তোমাকে পেযে এ হৃদয় পূর্ণতা পেয়েছে।কেননা আমি যেমনটা চেয়েছিলাম তমি তাই হয়েছ। আমি তোমার জীবনে ছায়া হয়ে থাকতে চাই। তোমার দুঃখ সুখের সাথী হতে চাই।যাই হোক জন্মদিনে তোমার প্রতি রইল আমার অজস্র ভালবাসা।

তোমাকে ভালবাসি

                                                                                                                                                                                                                                                                একটি ছেলে তার প্রেমিকার"আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে মিস করি"এই টাইপ মেসেজ পেতে পেতে বিরক্ত হয়ে যেত !

এক রাতে প্রেমিকার কাছ হালকা কথা কাটাকাটির পর সে মোবাইল সাইলেন্ট করে দিলো, অনেকগুলো ফোন আসলো, একটি মেসেজ আসলো, কিন্তু সে সেটি না পড়ে ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন ভোর বেলায় মেয়ের মা'র ফোনে তার ঘুম ভাঙ্গল। মা বললেন, তার মেয়ে গতকাল রাতে এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে।

বাকরুদ্ধ ছেলেটি তখন মেসেজটি চেক করলো। লেখা ছিল --

"প্লিজ, তুমি বাসার সামনে বের হও, তোমাকে দেখতে অনেক ইচ্ছে করছিল, তাই কাউকে না জানিয়ে এত রাতে বের হয়েছিলাম, আমি এক্সিডেন্ট করেছি, আমার অবস্থা খুবই খারাপ, একবার তোমাকে দেখবো, আই এম সরি...."
(collected)

জীবনে কখনই কোন কিছু Ignore করবেন না।

"ভালোবেসেছি এবং ভালোবাসবো"

সকাল বেলা কানের কাছে এসে কে যেন ডাকতেছে
"এই রফিক তাড়াতাড়ি ওঠ,তোর না আজকে কোথায় যাওয়ার কথা"
মাথাটা পুরাই গন্ডগোল পাকায় গেল,এমন একটা শান্তির ঘুমের মাঝে কে সেই আপদ যে আমার অশান্তির কারন তা দেখার জন্যই চোখ খুললাম । ওহ এইটা হল চিরশত্রু ঝুমুর । একটা চিত্‍কার দিয়া বললাম "ওইতোর সমস্যাটা কি,প্রতিদিন এই একই ভাবে আমার ঘুম ভাঙ্গাস কেন ? "
তার নির্লিপ্ত জবাব "তুই বলছিলি ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে ,তাই দিলাম,না হলে সকাল বেলা তোর আজাইরা বকা শুনতে আমার বয়েই গেছে,যাই হোক রেডি হ,কলেজ এ দেরি হয়ে যাচ্ছে ,আমি রেডি হয়ে নিচে ওয়েট করতেছি ।"
কিছু বলার আগেই উনি মুখটা গোমরা করে বাসায় চলে গেলেন ।


পরে ভাবলাম আসলেই এই মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দেই । সেই ৫ বছর আগে থেকে বর্তমানে এতিম এই ছেলেটার সবকিছুর খেয়াল রাখে এই ঝুমুর । স্কুল পেরিয়ে কলেজের গন্ডিও প্রায় শেষের দিকে কিন্তু সকাল বেলা ও ই আমার ঘুম ভাঙ্গায় , মনে পড়ে না কোনদিন একা একা জেগেছি কিনা । যখন বাবা ছিল তখনও ওর ডাকেই সকালের সোনা রোদের মুখ দেখতাম ।এইতো সেদিন আমাদের বাড়িতে আসলো ওরা , একদিন খেলার ছলে বলেই ফেললাম "এই শোন সকালে প্রতিদিন তুই আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিবি " বলতে বলতে পাঁচটা বছর হয়ে গেল তবু ওর রুটিন ভঙ্গ হয় না । আমাকে জ্বালাতে ওর মনে হয় খুব মজা লাগে ।দুর ভাবতে ভাবতে কলেজে দেরি হয়ে যাচ্ছে । রেডি হয়ে নিচে গেলাম ,আমি জানতাম ও অলরেডি দাড়িয়ে আছে । একই গাড়িতে দুজন কলেজে যাই । ও পড়ে শহীদ আনোয়ার এ আর আমি সিটি কলেজে । ওকে নামিয়ে দিয়ে আমি কলেজে যাই ।


নিয়মতান্ত্রিক জীবনটা এভাবেই চলছিল ।ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত খুব উপভোগ করতাম । বন্ধুত্ত্বের বাহিরে সম্পর্কটাকে কখোনোই অন্য কিছু ভাবার ইচ্ছা হয়নি । হয়ত তাতে সম্পর্কটাতে একটা কালিমা পরে যেত । ইচ্ছে ডানার উড়ন্ত ইচ্ছে গুলো ,কিছু খেয়ালিপনা,কখোনো বেয়ারাপনা এভাবেই চলছিল আমার আর ঝুমুর এর বন্ধুত্ত্বের ভালোবাসার ডিঙ্গা । ইচ্ছে হলেই ঘুরতে যেতাম , স্পেশাল দিন গুলোতে খুব বেশী মজা করতাম।একদিনের একটা ঘটনা ভ্যালাইন্টাইনস ডে তে আমরা ফুচকা খাচ্ছি ,ওকে একটা ছেলে এসে বলল "এই শোনআই লাভ ইউ"
ঝুমুর তো সেটা নিয়া বিশাল একটা কাহিনীকরে বসল,ফুচকা গুলা সব ছেলেটার মাথার উপর ঢেলে দিলো । আমি শুধু সাইড নায়কের মত দেখলাম,হাসতে হাসতে পেটে ব্যাথা হয়ে গেল ।তারপর ঝুমুর ছেলেটাকে বলল"এখন আবার বলো তো "
ছেলেটা কোথায় যে পালাবে সেই পথ খুঁজে পাচ্ছিল না ।
এভাবেই হাসি আনন্দে দিনগুলি কাটছিল আমাদের ।


একদিন ও আমাকে বলল "রাফি আমি যখন থাকবো না তখন তোর ঘুম ভাঙ্গাবে কে ?"
আমি বললাম "কেনো,আমার বউ !!"
সেদিনের পর থেকে ওকে অনেকটা চুপচাপ হয়ে যেতে দেখলাম । সকালে ও আর আমার ঘুম ভাঙ্গাতে আসে না , একা একাই কলেজে চলে যায় , আমি ঠিক মত খাই কিনা সে খবর ও নেয় না ।


একদিন ওদের বাসায় গেলাম,ওর রুমে গিয়ে ওর গলাটা টিপে ধরে বললাম "হারামি আমার সাথে কথা বলিস না কেন?আমি কি করছি?"
ঝুমুর আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,"রাফি আমরা এখন বড় হয়েছি , নিজেদের দ্বায়িত্ব নিজেদের বুজে নেওয়া উচিত"
আমি এতক্ষন খেয়াল করি নি,ওর হাসিটা কেমন শুকনো লাগছিলো,মনে হচ্ছিল অনেক শুকিয়ে গেছে ঝুমুর , ওর চোখে মুখে যে চাঞ্চল্যতা ছিল তা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেনো মোচড় দিয়ে উঠল । ওকে বললাম "তুই অনেক শুকিয়ে গেছিস , কি হয়েছে তোর আমাকে বল? আমি তোর সব কষ্টের ভাগ নিতে চাই ।"
ও শুধু শুকনো একটু হাসল ।


সেদিন বিকেল বেলা আমরা আবার আগের মত বের হলাম ঘুরতে । এর ভিতরে ঝুমুর মাথার ভিতরে বিশাল এক টেনশন ঢুকিয়ে দিয়েছে । সব মিলিয়ে বিশাল ফাপরে পরলাম। একটা নির্জন জায়গাতে বসলাম আমরা ,ও আমার পাশে এসে বসল-
"আমার হাতটা একটু ধরবি ?"
এই একই হাত আমি বহুবার ধরেছি ,সেটা দুষ্টামির ছলেই হোক আর যাই হোক । কখোনো মনে দ্বিধা হয়নি ,আজ কেমন যেন লাগছিল । আমি পারলাম না ওর হাতটা ধরতে।
"কিরে ধরতে বলছি ধর"
ঝুমুরের ধমকে আচমকা লাফিয়ে উঠে ওর হাতটা ধরলাম ।
"আমাকে তোর বুকে একটু ঠাই দিবি ? আমি তোর বুকে মাথা রেখে বাচতে চাই , আমি তোর ঘুম ভাঙ্গাতে চাই জীবনের শেষ সকালটা পর্যন্ত , বল এই অধিকার টুকু দিবিনা ??"
আমি ঝুমুরকে না করতে পারিনি ,ওর মাঝে আমি বেচে থাকার প্রেরনা দেখেছি , ওর আবদার টুকু আমি ফেলতে পারিনি , ও আমার জীবনের একটি অংশ একথাটা ও মনে না করিয়ে দিলে আমি বুঝতেই পারতাম না । ভালোবাসার রক্তিম আভায় রন্জিত হয়েছি ,ভালোবেসেছি ,ভালোবাসবো ।

[আমার না হলেও এটা অন্য কারো ভালোবাসার গল্প ,সাথে রয়েছে কিছু কল্পনার রং]

১৪ই ফেব্রুয়ারী

                                             অমিলন ভালোবাসা 
সুন্দর চেহারার একটা মেয়ে কি মিষ্টি করেই না আইসক্রিম খাচ্ছে!

যতক্ষন ছিলাম কে এফ সি তে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে।।এতো মিষ্টি একটা মেয়ে!মন ছুঁয়ে গেলো আমার।।প্রথম দেখাতেই স্বপ্নের প্রজাপতিকে ভালো লেগে গেলো।।ভাবলাম কথা বলব মেয়েটার সাথে।মনে ভয় পাচ্ছিলাম।।মেয়েটার সাথে ওর আরো দুজন বন্ধু ছিলো।।আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে বললাম,Excuse me,কথা বলতে পারি আপনার সাথে?মেয়েটা বলল বলুন।
আপনাকে আমি খুব লাইক করি।।আপনার সাথে frndship করতে চাই আমি।।মেয়েটা খুবই অবাক হলো।।তারপর মেয়েটা বললো এভাবে তো frndship করা যায় না।আপনাকে চিনি না জানি না!কিভাবে!




আমি বললাম কথা বলতে বলতে পরিচিত হয়ে যাবো।।মেয়েটা বলল, আচ্ছা।।
তারপর ওর আইসক্রিম খাওয়া পর্যন্ত কথা বললাম আমরা।।সুযোগ বুঝে নাম্বার টা চেয়ে নেই আমি।।

এরপর কিছুদিন কথা হয় আমার সাথে তার।।আমার ভালো লাগা টা ভালোবাসায় পরিনত হলো।খুব ভয় পাচ্ছিলাম আমি।।যদি ও মেনে না নেয়।।একদিন সে আমাকে কে এফ সি তে আসতে বলে,আমার আসতে দেরি হয় আর ও চলে যায়।খুব খারাপ লাগে সেদিন।।ও ফোন ধরছিলো না।।যাই হোক রাতে কথা হয় ওর সাথে,ও আমাকে যে কথা শোনালো তাতে আমার হার্টবির্ট বেড়ে গেলো।।সে বললো "She loves me"




আমি চুপ হয়ে গেলাম।।কথা হলো কে এফ সি তে কাল দেখা করব।পরদিন আমরা দেখা করলাম।।তার মিষ্টি চোখের কাজঁল আমাকে তার দিকে বার বার টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো।।আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।।ওর হাত দুটো ধরলাম আমি।।তারপর বললাম,আমাকে ছেড়ে যেও না ঐশী কোনদিন।।প্লিজ।।

ও বললো যদি কখনো যাই তোমাকে সাথে নিয়ে যাবে,আমার সাথে,যাবে তো!!

তিনটি বছর কেটে যায়।।খুব ঘুরতে পছন্দ করত সে।।কফি আর বার্গার ছিলো তার খুব পছন্দের।।ক্যাটবেরি খেতো প্রচুর।।তবে আমি তাকে বার বার বলতাম,ঐশী আইসক্রিম টা খাও,কত মিষ্টি লাগতো যখন ও খেত!উফ!বুকে এসে লাগে।।

ওর বাসা ছিলো ধানমন্ডিতে। 10 e পড়ে।।আর আমি থাকতাম বনশ্রী।।A level দিয়েছি।।খুব ভালো একসময় আমরা কাটাই তখন।।কত খুশি কত আনন্দ!
এই ১৪ই ফেব্রুয়ারী তে ওকে আমি আংটি পড়াই।।আর একটা ছোট্ট গিফট দেই ওকে।।একটা নতুন মোবাইল ফোন।।খুব খুশি হয় সে।।আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিলো আমাকে।।সেই দিন থেকে সে আমার কাছে থেকে হারিয়ে লাগলো।।




ভার্সিটিতে ভর্তি হই আমি।।আমার সম্পর্কটা আরো সুন্দর হচ্ছিলো।।১ম সেমিষ্টারে ফেল করি।।নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে,কখনো ফেল করি নি আমি।।নতুন ভাবে লেখাপড়া শুরু করি আমি।।লেখাপড়ার চাপের কারনে ফোনে কথা কমিয়ে দেই আমি।।

ও ভাবত আমি এখন আর ভালোবাসি না ওকে,আস্তে আস্তে বড় একটা Gap হয়ে যাচ্ছিলো আমাদের মাঝে।।সে ভাবে আমি এখন বোধ হয় অন্য কাউকে ভালোবাসি।।সামান্য একটা ঘটনার কারনে ভেঙ্গে যায় আমার স্বপ্ন।।হারিয়ে যায় স্বপ্নের প্রজাপতি।।

brk up হবার দিন ও আমাকে আমার গিফট গুলো আর ফোন টা ফেরত দেয়।।আমার হাত কাপঁছিলো।।যাই হোক দুদিন পর ই ঐশী আমাকে ফোন দেয় বলে দেখা করতে চায় আমার সাথে।।ও থাকতে পারছিলো না তাই।।আমি বললাম কে এফ সি তে এসো আমি অপেক্ষা করব।।পরদিন আমি আগেই পৌছে গেলাম।।ও ফোন করে জানালো ও বাসা থেকে রেরিয়ে রিক্সায় উঠেছে।।দু ঘন্টা পার হয়ে যায়।ও আসে না।।ফোন করে দেখি ফোন বন্ধ।।




আমি খুব অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকি।।পাগলের মত ওকে ফোন দিতে থাকি।।ওর বাসার নিচে যাই।।রাস্তা থেকে ওর রুমের বারান্দা দেখা যেত।।সন্ধ্যা হয়ে গেছে তবুও ওর রুম অন্ধকার।।বুকের মাঝে কি এক শূন্যতা!আমার সব কিছু কে গ্রাস করছিলো,মনে হচ্ছিলো কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমার থেকে।।আমি আমার বাসায় চলে আসি।।রাতেও ফোন বন্ধ,ঘুম হয় না।।খেতে পারি না।।নামায পড়লাম অনেকদিন পর।।স্রষ্টাকে খুব ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।




যাইহোক সকাল দশটায় ওর বাসার সামনে উপস্থিত হই।।দেখি বাড়ির সামনে অনেক মানুষ।।একজন কে জিগ্যেস করলাম কি হয়েছে এখানে!লোকটা বললো আমাকে এই বাড়ির চারতলার একটা মেয়ে রোড একসিডেন্টে মারা গেছে।।আমি হতভম্ব।।ওর লাশের কাছে যাই।।সারা দেহ সাদা কাফনে আব্ত।খালি মুখ টা দেখা যাচ্ছে।।কি পবিত্র দেখাচ্ছিল মুখটা।।ওর পাশে ওর বান্ধবীরা ছিলো।।কাদঁতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।।ওরা আমাকে ধরে বসালো।।আমি আমাকে হারিয়ে ফেলি সেদিন থেকে।।




ওর সাথে কাটানো সময় গুলো মনে পড়লে অশ্রু হয়ে বারে বার ওর কবরের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।।
এখনো তোমাকে খুব মনে পড়ে।।রাতে ঘুমুতে পারি না,তোমার ছবিগুলোর দিকে চোখ পড়লে চোখ ভিজে উঠে সহসায়।।আজ ও ভুলতে পারি নি তোমাকে.......    

"পায়েল...."

                                                                                                                                                                                                                                     নীলিমার হাতে যখন নুপুর যুগল তুলে দিলাম, ও হাতে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু আরেকটা হাত চোঁখের অশ্রু মুঁছতে ব্যস্ত ছিল তার। আর আমার? কথায় আছেনা 'অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর' আমিতো পাথর হয়ে গেছি সেই ৪ বছর আগেই।


নুপুরগুলো হাতে নিয়ে নীলিমা আমাকে প্রশ্ন করল ৫ জোড়া তো হয়ে গেছে, আর কত কিনবে?

- যতদিন আমি বেচে আছি।

আর কিছুই জানতে চাইল না চুপচাপ নূপুর যূগল আলমিরাতে রেখে দিল।


প্রতি বছর এই ৭ এপ্রিল আমি এক জোড়া নূপুর নিয়ে ঘরে ফিরি, গত ৪ বছর ধরে। ইচ্ছে করলে এখন আমি প্রতিদিন এক জোড়া নূপুর ও কিনতে পারব। অথচ এই নূপুর ই আমাকে সারাজীবন কাঁদিয়ে বেড়াবে।

৯ বছর আগের কথা, সেদিন ভোরের আলো না ফুটতেই নীলিমার কড়া নাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গল, এত ভোরে তাকে দেখে অবাকই হলাম! সাধারনত আমার মেসে সে আসেনা। তার বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে যা করার আমাকে এখনি করতে বলছে সে। না হয় এটাই তার আর আমার শেষ দেখা বলে হুমকি দিচ্ছে আমায়।


কিছু বুঝে উঠার আগেই কাজী অফিস, বিয়ে সব কিছুই হয়ে গেল।

নীলিমাকে নিয়ে গেলাম বাড়িতে সৎ মার চেয়ে বাবাকে পাষন্ড মনে হচ্ছে আজ, আমিতো সব বুঝি বাবা সৎ মায়ের ভয়েই সেদিন তাড়িয়ে দিল আমায়, একবার নব পুত্রবধূটা কেও দেখলোনা ভাল করে। আর মা এমন ভাবে দেখছে যেন আমার অপরাধটা তার আপন ছেলের হেরোইন সহ ধরা পড়ে জেল এ যাবার চেয়ে গুরুতর অপরাধ!


নীলিমার বাড়ির পথ তো আরও আগে বন্ধ হয়ে গেছে, তাছাড়া তার বাড়ি যাবার প্রশ্নই উঠেনা। ফিরে এলাম ঢাকা শহরে, ফ্ল্যাট নেয়া তো আর সম্ভব না কবুতরের খুপরির মত একটা রুম নিলাম, সেখানেই দুজনের সুখের সংসার গড়ে তুললাম।

চাকরির জন্য ঘুরছিলাম তো আরও আগে থেকে, কিন্তু এবার তো আবশ্যক হয়ে গেল। কিন্তু এটা তো আগে জানতাম সোনার হরিণ এখন মনে হচ্ছে হীরার হরিণ, শেষ পর্যন্ত আগের ২ টা টিউশনির পাশাপাশি আরও দুইটা টিউশনি পেলাম। নিলীমাও কমাস পর একটা কিন্ডার গার্ডেন এ জয়েন করল। টোনাটুনির সংসার ভাল ভাবেই চলছিল।

বছর ঘুরতেই আমাদের কবুতরের খূপরি আলো করে একজন এল, নাম রাখলাম পায়েল। টোনাটুনির সংসার পরিনত হল তিনজনের পরিবারে। আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো আমাদের পায়েল। একবার আমার বা নিলীমার পরিবারের কেউ আমাদের খোঁজও নিলো না।

দুজনের আয়ের পাশাপাশি কিছু জমা ও হয়েছে আমাদের। সেই জমা টাকা আর ক্ষূদ্র লোন পেলাম এক বন্ধুর সহযোগিতায়। শুরু করলাম ছোট খাট ব্যবসা, গাজীপুর থেকে ডিম সংগ্রহ করে ঢাকার আড়তে সাপ্লাই দিতাম, শুনতে খারাপ হলেও ব্যাবসা মন্দ না। ভালই লাভবান হতে লাগলাম।

এতদিনে বড় বড় আড়তদার দের সাথে ভালই জানাশুনা হয়ে গেছে, ব্যবসার জন্য এখন আর পূঁজির অভাব হয় না। ডিমের পাশাপাশি মূরগীর ব্যবসাও চালু করলাম। কবুতরের খূপরী ছেড়ে ফ্ল্যাট বাড়ি তে উঠে গেছি সেতো কবেই। আমার সৎ মা এখন আমাকে নিজের ছেলের চেয়ে বেশী দরদ দেখান্, বাবার কথা না ই বা বললাম। পায়েল কে স্কুলে ভর্তি করালাম, সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চলছিল। হঠাৎ কয়েকটি দেশে বার্ড ফ্লু'র প্রাদূর্ভাব দেখা দিল। বাংলাদেশে এর প্রভাব না থাকলেও গুজব এর কারনে সবাই এ মূরগী ডিম খাওয়া বন্ধ করে দিল। অনেক বড় একটা লোকসান খেলাম, এক দিকে আড়তদারদের পাওনা, ব্যাংক লোন সব মিলিয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা।

কদিন পরে পায়েলের জন্মদিন, এখন সে তার নামের অর্থ ও জানে, পায়েল মানে নূপুর। জন্মদিনে তার দাবী সোনার নূপুর। এটা তেমন কিছু ছিলনা আমার জন্য, কিন্তু এমন এক পরিস্থিতি তে আছি সংসার চলে বাকীতে। এর মধ্যে পায়েল অসুস্থ হয়ে পরল। বিপদ যখন আসে তখন চারিদিক থেকে আসে।

এই অসুস্থতার মাঝেও মেয়েটা তার জন্মদিন আর আমার দেয়া নূপুর কিনে দেয়ার কথা মনে রেখেছে। হাসপাতালের বেডে শুইয়ে আমাকে বলছে বাবা কাল তো আমার জন্মদিন, তুমি আমার নূপুর আনবে তো, সোনার নূপুর?

মিথ্যা বলা ছাড়া আর কি আছে আমার কাছে তখন্, মেয়ে কে বললাম আনব। পরদিন হাসপাতালে যাবার পথে কসমেটিকের দোকান থেকে এক জোড়া ইমিটিশনের নুপূর কিনে নিলাম। ছোট মানুষ বুঝতে পারবেনা, আসল না নকল । নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে ফাঁকিবাজি করতে নিজেকে অনেক অপরাধী লাগছে, কিন্তু কি করব আর তো কোন উপায় নেই। মেয়ে টা গেলেই তো বলে উঠবে বাবা আমার নুপূর এনেছ? কি জবাব দিব। নিজেকে এই ভেবে শান্তনা দিলাম একটু গুছিয়ে উঠলে সোনার নয় আমার মেয়েকে হীরার নুপূর কিনে দিব।

নুপূর জোড়া পকেটে পুরতেই নিলীমার ফোন পেলাম কান্না জড়িত কন্ঠে বলছে -ওগো তুমি তাড়াতাড়ি আস, পায়েল শুধু তোমাকে ডাকছে, কিভাবে ছুটে গেলাম শিশু হাসপাতাল পর্যন্ত নিজেও জানিনা। আমি গিয়ে দেখলাম আমার নিলীমা চিত্কার করে কাঁদছে, একটা বিছানার চাঁদরে ঢেকে আছে আমার পায়েলের ছোট্ট দেহ খানি, এখন তো সে চুপ করে থাকার কথা না, তার তো নুপূরের জন্য হাত বাড়ানোর কথা। তবে কি জানতো সে আমি তাকে ফাঁকি দিতে নকল নুপূর এনেছি তাই আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে? বিধাতা... কেন এই নিস্পাপ পায়েলের দিকেই তোমার নজর গেল? পায়েল কি দোষ করেছিল যে এই অল্প বয়সেই তার বাবার হাতে নুপ্পু ( পায়েল নুপুরকে নুপ্পু বলতো) না পরেই হারিয়ে গেল না ফেরার দেশে। বিধাতা...ও বিধাতা...এখন কে আমাকে বাব্বা...বাব্বা বলে আমার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পরবে?

ইচ্ছা হচ্ছিল না ব্যবসায় ফিরে যেতে, কিন্তু পাওনাদারদের টাকা কিভাবে শোধ দিব ঐ দিকে সরকার ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ট্রি ব্যাবসায়ীদের লোন দিল সহজ শর্তে। ঘুরে দাড়ালাম আবার এখন আর আমি সাপ্লায়ার নই, কাওরান বাজারের সফল আড়তদারদের একজন। অভাব শুধু একটাই বাব্বা..বাব্বা ডাকার মত কেউ নেই। এখনও আমি প্রতি ৭ এপ্রিল এক জোড়া নুপূর নিয়ে ঘরে ফিরি, মনে হয় আমার পায়েল ঘরে আসলেই আমাকে ডেকে বলে উঠবে- বাবা আমার নুপূর এনেছ? 

"এই সময়, সেই সময়"

                                                                                                                                                                                "আচ্ছা আমি খুব সুন্দর,তাই না ?"

 "

"কি ব্যাপার হা করে তাকিয়ে আছেন কেনো, প্রতিদিন আপনি আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকেন, বিরক্ত হয়ে গেছি, হুহ।"

রাজু থতমত খেয়ে গেলো, মুন্নির আকস্মিক এই প্রশ্নের তান্ডবে সে কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। প্রতিদিন মুন্নির স্কুলের সামনে ঠায় দাড়িয়ে থাকে সে।হ্যা, মুন্নিকে সে ভালোবাসে। স্কুলের স্পোর্টস প্রোগ্রামে মুন্নিকে প্রথম দেখেছিল রাজু। সেদিন থেকেই ভালোবাসতে শুরু করেছে সে মুন্নিকে। মুন্নি সবেমাত্র অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী আর রাজু অল্প লেখাপড়া করার পরই বুঝতে পেরেছে আসলে ঐটা তার দ্বারা সম্ভব না, তাই এইচ এস সি পাশ করেই একটা কাজে লেগে পরে । মুন্নি অনেক চঞ্চল টাইপের একটা মেয়ে সেই তুলনায় রাজু অনেকটা লাজুক।



সেদিনের পর থেকে মুন্নির সামনে যেতো না রাজু, লুকিয়ে লুকিয়েই দেখতো।কিন্তু এভাবে আর কতদিন, রাজু সিদ্বান্ত নিলো মুন্নিকে সে তার ভালোবাসার কথা এবার বলেই দিবে। একদিন মুন্নি স্কুল থেকে যাচ্ছিল, রাজু পিছন থেকে ডাক দিলো।

"এই মুন্নি,শোন"
"আপনে আমার নাম জানলেন কিভাবে?"
"তোমার বান্ধবীর কাছ থেকে"
"নাম চোর"
"আচ্ছা শুনো তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে"
"বলে ফেলেন, আমি আপনার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি"
"সত্যি?!"
"আরে হ্যা, নাহলে আমি এখানে তালগাছের মত দাড়িয়ে থাকব কোনো?"
"আচ্ছা বলছি, তোমাকে যেদিন থেকে দেখেছি, সেদিন থেকেই ভালোবেসে ফেলেছি, দিনগুনেছি তোমার অপেক্ষায়, ভালোবেসেছি তোমার চাঞ্চল্য, ভালোবেসেছি তোমার প্রতিটি হাসির প্রতিটি ঝলক, তোমাকে আমি ভালোবাসি"
"আমিও আমার আব্বু আম্মুকে এরকমই ভালোবাসি, একদম জীবনের প্রথম দিন থেকে "
"আরে তুমি বুঝনা কেনো, বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর একটা ছেলে একটা মেয়ের ভালোবাসা সম্পূর্ন আলাদা"
"ওহ আচ্ছা, ওইটা আমার বুঝার বয়স হয় নি"
"বুঝতে চেষ্টা কর, বুঝতে পারবা"
"কি যে বলেন না ভাইয়া, আমি যাই, বাসায় ফিরতে দেরি হলে আম্মু টেনশন করবে"
"ওকে, উত্তরটা কবে দিবা ?"
"আসলে আমি এইসব ফিলিংস বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না , বিয়ের বয়স হলে বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিবে। কাহিনী শেষ ।"
রাজু স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইল, মুন্নি চলে গেলো।


"রাজু কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, পৃথিবীটা তার কাছে মুন্নির মতই নিষ্ঠুর মনে হল। মুন্নি কেনো একবার বুঝতে চেষ্টা করল না তাকে, এই ভেবে চোখের জলে সিক্ত হয় রাজু। আর কিছু করার থাকে না। সে একদিন মুন্নিকে একটা চিঠি লিখে বসে।

"মুন্নি,
তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে, জানো খুব কষ্ট হয়েছে। সেদিন থেকে প্রতিটি নির্ঘূম রাত কেটেছে চোখের জলের সাথে গল্প করেই। কিন্তু আর তো পারছি না। তাই কষ্ট গুলোকে ভুলতে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি। অবশেষেও আমি তোমায় ভালোবাসি।
ভালো থেকো।
ইতি রাজু"

চিঠিটা পড়তে পড়তে মুন্নির চোখে থেকে কোন এক অজানা কারনে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পরল। যদিও ভালোবাসা কি তা বুঝত না মুন্নি, তার মনে হয়েছিল একটা জীবন শুধুমাত্র তার কারনে যদি অকালে ঝরে যায় তখন সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।


মুন্নি রাজুর সাথে দেখা করল কোন এক নির্জন বিকেলে।
বিশাল একটা বট গাছের নিচে দুজন বসল
মুন্নি শুধু একটা কথা বলল,
"আপনি এইসব আজে বাজে কিছু করবেন না, আমি আপনার পাশেই থাকব।"
রাজুর মনটা অনেক দিন পর একটু শীতল হাওয়ার ছোয়া পেলো ।


শুধুমাত্র একটি জীবন বাচানোর তাগিদেই মুন্নির কাছে অজানা এই ভালোবাসা নামক বস্তুটার অভিনয় করে যেতে লাগলো মুন্নি। রাজু বলত, সে শুধু শুনতো ।

সময় এভাবেই গড়িয়ে যায়। মুন্নি এস এস সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়।এর মধ্যে মুন্নি অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে, সেও রাজুকে ভালোবাসে। দুজনার ভালোবাসার গভীরতায় হারিয়ে যেতো দুজন। ভালোবাসার দিন গুলি প্রতিটা মুহুর্ত পরম মধুরতায় কাটত তাদের। মুন্নি অত্যন্ত সহজ সরল একটা মেয়ে ছিলো, রাজুর কথা সে তার আম্মুর কাছে বলল একদিন। অত্যন্ত আদুরে এই মেয়েটার উপর ছোট্রবেলা থেকে কখোনো কঠর হতে পারেনি তার মা। তাই সেদিনও পারল না , শুধু বলল-
"সবকিছু ভেবে চিন্তে করো"
মুন্নি বলল-"আমি তোমার লক্ষী মেয়ে না? আমি খারাপ কিছু করতেই পারি না। রাজু আমার জন্য অনেক ভাবে। ও আমাকে তোমাদের মতই ভালোবাসে।"
মুন্নির মা মেনে নিল সবকিছু।


দুজন দুজনার ইচ্ছা গুলোকে অনেক গুরুত্ব দিত। খুটিনাটি ঝগড়াও হত তবে সেটা সাময়িক। অনেক রাত জেগে কথা বলত দুজন আবার সকাল হলেই দেখা হত। রাজু মুন্নিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেত। মুন্নির এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হল।


রাজু একদিন মুন্নিকে বলল-
"চল বিয়ে করে ফেলি , পাঁচটা বছর তো প্রেম করেই কাটিয়ে দিলাম। এভাবে অবাধ মেলামেশা করছি আমরা, সবাই খারাপ বলবে।"
"আসলেই কথাটা ঠিক বলছ , আমারও আর ভাল্লাগে না, চলো বিয়েটা করেই ফেলি, একটা বাবু হবে আমাদের, তুমি বাবা হবে আমি মা হব, হি হি হি"
রাজু মুন্নির হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে বলে-
"লক্ষী বউটা আমার"
"হিমম, সবসময়ই"


রাজুর পরিবার থেকে মুন্নির পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে বিয়ে হয় ওদের। শুরু হল নতুন স্বপ্নবোনা, নতুন আলপনা আঁকা। খুব সুখেই কাঁটে ওদের দিনগুলি।

নতুন সংসার , নতুন জীবন , নতুন কতগুলো মানুষের সাথে বসবাস । সবকিছু সাজাতে হবে নতুন করে , মুন্নি নিজের মত করে সাজাতে চায় তার স্বপ্নের পৃথিবী । স্বপ্নের নকশী কাথা বুনতে সে ব্যস্ত হয়ে পরে । চটপটে মুন্নি একদিন রাজুকে বলে -
"তোমার সাথে আমার যে কথা ছিলো , তুমি কিন্তু রাখতেছো না"
রাজু অবাক হয় না , কারন মাঝে মাঝে এমন ধুমকেতুর মত কিছু কথা বলে চমকে দেওয়াটা মুন্নির অভ্যাস । অনেক দিন ধরে রাজু এই স্বভাবের সাথে পরিচিত । তাই সে অবাক না হয়ে বলে-
"বলে ফেলো কি কথা"
"ওমা , তুমি ভুলে গেছো ?আমাদের না দুজন মিলে সংসারটা সাজানোর কথা , তুমি তো আমাকে হেল্পই কর না ,পচা একটা"
রাজু মুন্নির কাধের উপর হাত রেখে বলে
"সংসারটা তোমার মুন্নি , তোমার মত করে সাজাও । আমি তোমার পাশে আছি ।"
"এতো সুন্দর করে কথা বলার কি আছে , আমাকে একটু বকাও দিতে দিবানা"
মুখটা বাঁকিয়ে বলে মুন্নি
রাজু একগাল হেসে বলে
"ওরে সোনা বউটারে তুমি আগে থেকে প্ল্যান করে রাখছিলা যে আমাকে বকা দিবা । কিন্তু ম্যাডাম সমস্যা হলো আমিতো তোমাকে তোমার থেকে বেশি বুঝতে পারি"
"আমিও চাই তুমি আমাকে আমার থেকে বেশি বুঝ ।"
রাজুকে জড়িয়ে ধরে বলে মুন্নি
অনন্ত সুখের ভেলায় ভাসে দুজন ।


মুন্নি নিজের মত করেই সাজাতে লাগলো ভালোবাসার উদ্যান খুব যত্ন করে । কিন্তু রাজুর মা তার কাজগুলোতে প্রায়ই আপত্তি করতেন । রাজুর মা মুন্নির উড়ন্ত স্বভাবটা পছন্দ করত না । মুন্নি চেষ্টা করে নিজেকে পাল্টাতে কিন্তু যেই মেয়েটি ২১ বছর একইভাবে বাচতে শিখেছে খুব সহজে সে নিজেকে কিভাবে পাল্টে ফেলবে । তাই মুন্নিকে সহ্য করতে হত অনেক কটু কথার যন্ত্রনা ।



একা একা নিরবে কাঁদে মুন্নি , রাজুকে কখোনো বুঝতে দিতনা । সে লক্ষ্য করে রাজু যেন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । মুন্নির সাথে তেমন কথা বলেনা , অনেক রাতে বাড়ি ফেরে অফিস থেকে । রাজুর এই পরিবর্তনের কারন খুঁজতে দিশেহারা হয়ে যায় মুন্নি । কারনটা সে একদিন খুজে পায়ও , মুন্নি জানতে পারে পরিবারের এই অশান্তির কথা , মুন্নির নানা রকম দোষের কথা সবকিছু রাজুর কানে দিতো রাজুর মা । অশান্তির কারন আর দোষগুলো মুন্নির বলেই রাজু মনের যন্ত্রনার আগুন নেভাতে রাজু নেশাগ্রস্ত হয়ে পরেছিল ।
মুন্নি সবকিছু জানতে পেরে নির্বাক হয়ে যায় , কাঁদতেও যেনো ভুলে যায় ।



একদিন রাতে রাজু বাসায় ফেরার পর মুন্নি বলে
"রাজু তুমি এসব কেনো করছ । দেখবা আমি তোমার লক্ষী বউ হয়ে যাবো , তোমার মা যা বলবেন আমি তাই শুনব । প্লিজ তুমি আগের মত হয়ে যাও"
রাজু ভ্রূ কুন্চিত করে বলে
"তোমাকে আমি এতো অবহেলা করি তুমি বুঝনা তোমার কি করতে হবে , তোমার হাতে পায়ে ধরি আমাকে তুমি তোমার বাধন থেকে মুক্তি দাও"
মুন্নি রাজুর দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে বলে
"আমার চোখে চোখ রেখে বলোতো তাহলে তুমি ভালো থাকতে পারবা ?"
রাজু কঠিন দৃষ্টিতে মুন্নির দিকে তাকিয়ে বলে-
"হ্যা পারব"
মুন্নি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাজুর দিকে কিছু বলতে পারে না ।

পরের দিন সকালে মুন্নি তার মায়ের কাছে চলে আসে । প্রায় একমাস কেটে যায় , এর মাঝে রাজুর বাড়ি থেকে অথবা রাজু কোন খবর নেয়নি মুন্নির ।মুন্নি অতিরিক্ত ভেঙ্গে পরে । সারাদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে , মুন্নিকে স্বান্তনা দিতে পারেনা কেউ ।


সকালে একটা চিঠি এসেছে কোর্ট থেকে । হ্যা,সেটা রাজুর পাঠানো ডিভোর্স পেপার ছিলো । মুন্নিকে রাজু ফোন দিয়ে বলে
"ডিভোর্স পেপারটা পাঠালাম"
এরপর ফোনটা কেঁটে দেয় রাজু ।
মুন্নি অনেক্ষন বসে থাকে পেপারটা সামনে নিয়ে , কলমের একটা আচরে শেষ হয়ে যাবে সকল স্বপ্ন । কিন্তু সেদিন রাতের কথাগুলো বারবার সামনে চলে আসে মুন্নির । রাজু মুক্তি চেয়েছিল মুন্নির কাছে তাই শেষ পর্যন্ত মুন্নি ইতি টানল
তার ভালোবাসার সকল বাধনের । পাথরে পরিনত হয় মুন্নি ।


আসলেই কি মুক্তি দিতে পেরেছিল সে রাজুকে ? তার মন থেকে ? শুধু কাগজ কলমেই কি তাদের সম্পর্কটা আবদ্ধ ছিলো ? এসব কথা ভেবে সারাদিন চোখের জল ফেলে মুন্নি । সেদিনের পর থেকে রাজুর আর কোন ফোন আসেনি মুন্নির কাছে ।


এরপর থেকে আর কোনদিন হাসেনি মুন্নি । সেই হাস্যজ্জল মেয়েটা কেমন যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে । এই সময় আর সেই সময়ের পার্থক্য কতটা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আজো তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে । সেই প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু তার দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না            

''অতঃপর ভালবাসা''

                                                                                                                                                                              অনেক্ষন ধরে এলার্ম বেজে চলেছে। প্রথমে লাবণ্যর মনে হল এলার্ম এর ঘটনা সে স্বপ্নে দেখছে। কিন্তু কর্কশ আওয়াজটা আরও বাড়তেই বালিশের নীচ থেকে মোবাইল বের করে এলার্ম অফ করল সে। বুঝতে পারছে না এত তাড়াতাড়ি বাজল কেন এলার্মটা । মনে হচ্ছে এই মাত্র ঘুমিয়েছে । না-কি , ভুল করে সকাল সাতটার পরিবর্তে ভোর চারটায় এলার্ম দিয়ে রেখেছে? এলার্ম-ই বা দিয়ে রেখেছিল কেন মনে করতে পারছে না । মনে করতেও চায় না সে । সকালে ঘুম থেকে ওঠার এই কাজটা খুবই অপছন্দ লাবণ্যর । তাই আবার ঘুমিয়ে পড়ল । কিছুক্ষন পর বিপ বিপ শব্দে আবার মোবাইল বেজে উঠে । মহা বিরক্তি নিয়ে লাইন কেটে দেয় লাবণ্য । বালিশ কানে চেপে ঘুমানোর চেষ্টা করে আবার । পাঁচ মিনিট বিরতির পর ফোনটা আবার বাজতেই ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলের দিকে তাকায় । তার বান্ধবী শর্মার ফোন । এতক্ষনে মনে পড়েছে এলার্ম বাজার কারন । সকাল আটটার মধ্যে কলেজে পৌঁছার কথা । কলেজ থেকে আজ তারা পিকনিকে যাবে গাজিপুর । লাবণ্য যে ঘুম পাগল তা শর্মা ভাল করেই জানে । তাই কাল রাতেই বার বার বলছিল মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখতে । এই শর্মা মেয়েটাকে প্রচন্ড ভয় পায় লাবণ্য । পান থেকে চুন খসলেই চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে এই মেয়েটা । এজন্য শর্মার কল দেখেই চট করে আনসার করে লাবণ্য । ফোনের ওপাশ থেকে শর্মা বলল ''কী-রে ,তুই কই ? বের হয়েছিস ? না-কি এখনও বেডে ? ভয়ে ভয়ে লাবণ্য বলল '' উফফ্ ,এত প্রশ্ন একসাথে করেছিস ,কোনটার উত্তর দেব ? তারপর মিথ্যা বলল ,হুম্ উঠে গেছি অনেক আগেই এইতো রেডি হচ্ছি ।-''ওকে ,গুড । এখন ফোন রেখে তাড়াতাড়ি বের হন ম্যাডাম । সাতটা বেজে গেছে । কলেজে আসতেই তো আরও ঘন্টা খানেক লাগবে''। -''হুম্ ,রাখছি এখন ''। ফোন রেখেই ঘড়ি দেখল লাবণ্য । সাতটা বেজে গেছে । কিন্তু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার । কেন যে ওদের সাথে পিকনিকে যেতে রাজি হয়েছিল । এখন মনে হচ্ছে পিকনিকের চেয়ে সকাল বেলার এই ঘুমই ঢের ভাল । কিন্তু সে না গেলে শর্মা, হেলেন ,সানজিদা,নাদিয়া ওরাও কেউই পিকনিকে যাবে না ,সাফ বলে দিয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়ল । উঠেই তাড়াহুড়ো করে হাত মুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে গেল । অন্য দিন হলে তৈরী হতে তার অনেক সময় লাগত । কোন ড্রেস পরবে , ড্রেসের সাথে কোন জুয়েলারী মানাবে , কোন লিপিষ্টিক মানান সই হবে ,জুতা কোনটা পরবে এসব ঠিক করতে করতেই অনেক সময় লাগে তার । ভাগ্যিস ,কাল রাতেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছিল , তাই আধা ঘন্টার মধ্যে তৈরী হতে পেরে নিজে নিজেই কিছুটা অবাক হল এত জলদি তৈরী হতে পেরে । তারপর শেষবারের মত আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল । নাহ্ ,সবই ঠিক আছে । পারফেক্ট লাগছে । ঘড়ি দেখল আবার । সাড়ে সাতটা বাজে । সময় নেই , নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়ে লাবণ্য ।




গাড়িতে সবাই আধ ঘন্টা ধরে বসে আছে । গাড়ি থেকে কাউকেই নামতে দিচ্ছেন না ম্যাডাম । অথচ এই ছাড়ছে ছাড়ছে বলে গাড়িও ছাড়ছে না । এভাবে বসে থাকতে একদম ভাল লাগছে না লাবণ্যর । ক্ষিধায় পেট চুঁ চুঁ করছে তার । কিছু একটা খাওয়ার জন্য নামতে চাচ্ছিল কিন্তু ম্যাডাম নামতে দিচ্ছেন না । উপায় না পেয়ে ব্যাগে রাখা ক্যানডিবার খেতে শুরু করে সে । ক্যানডিবার তার পছন্দের একটা খাবার । সব সময় ব্যাগে ৩/৪ টা থাকেই । কিন্তু রাগের কারনে এখন এগুলো খেতেও ভাল লাগছে না । ফিস ফিস করে সে ঐ নবাবজাদার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে যার জন্য গাড়ি ছাড়তে দেরী হচ্ছে । তার মাথায় ঢুকছে না একজনের জন্য কেন সবাইকে সাফার করতে হবে ? অবশেষে সাহেবজাদা এলেন বেলা দশটায় । মেয়েরা সবাই মহা বিরক্তি নিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে । কারো কারো ভাব এমন যে পারলে থাকে একচুট ধোলাই দেয় । পরে যখন জানল তাদেরই ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের ঐ ছাত্র তাদের খাবারগুলো প্যাকেট করে আনতেই এত দেরী হয়েছে তখন সবাই কিছুটা শান্ত হয় । গাড়িতে উঠে মাউথপিস হাতে নিয়ে দেরীর জন্য ক্ষমাও চায় হিমেল । গাড়ি চলতে শুরু হলে শর্মা লাবণ্যকে বলল এবার তো মুড অন কর ''ময়না পাখি'' । আমার কী দোষ ? আমি কি জানতাম এত দেরী হবে ? শর্মা প্রায়ই লাবণ্যকে ময়না পাখি বলে ডাকে । এখন এই ডাক শুনে হেসে ফেলে সে । বলে ময়না পাখি ডাক শুনে তো আর পেট ভরছে না আমার । পেটের ক্ষিধা তো বেড়েই চলেছে । শর্মা বলে একটু ধৈর্য্য ধর সোনা । তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলে ময়না পাখি এতক্ষন টেনশনে তো খেয়ালই করি নি , তোকে তো আজ একদম ''নীল পরীর ''মত লাগছে রে !! ছেলেরা সবাই তো টাসকি খেয়ে যাবে আজ । তারপর হিমেলকে দেখিয়ে বলে হিমেল ভাইকেও অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে , দেখ । শর্মার কথায় এই প্রথম হিমেলের দিকে ভাল করে তাকায় লাবণ্য । সত্যি অনেক হ্যান্ডসাম ছেলেটা । কিন্তু কেমন যেন ভাব ধরে ম্যাডামের পাশে বসে আছে । শর্মার কথার উত্তরে লাবণ্য বলল তুই উনাকে চিনিস নাকি ? ''হ্যাঁ ,আমাদের ইংরেজীরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ''। লাবণ্য আর কোন কথা বলল না । শর্মা বকবক করেই যাচ্ছে । কিছুই শুনছে না লাবণ্য । সে হেডফোন কানে লাগিয়ে ফুল ভলিয়মে শুনছে richard max এর ''Oceans apart day after day and I slowly go insane........right here waiting for u '' এই গানটি । ঘন্টা খানিকের পথ পাড়ি দেয়ার পর লাবণ্যর পেট আবার মোচড় দিয়ে উঠে । এখনই তাকে কিছু খেতে হবে তা না হলে আজকে সবাইকে পিকনিক বাদ দিয়ে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হবে । বিষয়টা ম্যাডামকে জানাতেই তিনি এবং হিমেল বলল এখন কিছুতেই গাড়ি থামানো যাবে না । এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে । এদিকে ক্ষিধার জালায় লাবণ্যর অজ্ঞান হবার জোগাড় । আগেও একবার বাসায় আপুর সাথে রাগ করে না খেয়েই কলেজে গিয়েছিল শেষে কলেজে মাথা ঘুরে পড়ে যায় ।এখন কিছুটা ইচ্ছে করেই অসুস্হ হওয়ার ভান করে । খুব জেদী মেয়ে সে । যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে । যখন দেখল ম্যাডাম ও হিমেল তার খাবারের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না তখন ইচ্ছে করেই এ পদ্ধতি বেছে নেয় । শেষে বাধ্য হয়ে গাড়ি থামিয়ে একটি বিরিয়ানীর প্যাকেট দেয়া হয় তাকে । বাকি পথটুকু খুব ভালই কাটে লাবণ্যর।

গাজীপুর প্রিয়াঙ্গন পিকনিক স্পটে নেমে হালকা নাস্তা শেষে সবাই যে যার মত ঘুরতে থাকে । লাবণ্য,শর্মা,সানজিদা ,নাদিয়ারা আলাদা হয়ে ইচ্ছে মত ছবি তুলল । এটি তাদের সবারই খুব পছন্দের একটি কাজ । ঘোরাঘুরি শেষে খাবার খাওয়ার সময় লাবণ্য খেয়াল করল সবাই তার দিকে ঘন ঘন তাকালেও হিমেল তাকায় নি একবারও । কী এমন দেমাগ তার ? এ চিন্তাটাই লাবণ্যর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে । সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক হিমেলের দেমাগ ভাঙ্গতে হবে । ফিরতি পথে গাড়িতে বসেই এ বিষয়ে মোটামুটি একটা পরিকল্পনাও করে ফেলে লাবণ্য । সে জন্য যাবার সময় কিছুটা খারাপ লাগলেও এখন এই ফিরতি জার্নিটা বেশ ভাল লাগছে । গাড়িতে রেফেল ড্র আর একেক জনের সুরে বেসুরে গাওয়া গানের আয়োজনের মাঝে কখন যে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে টেরই পায় নি । কিছুটা ভীষন্ন মনে গাড়ি থেকে নেমে একে একে সবাই বিদায় নিতে থাকে । হিমেল তখনও গাড়ির ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত । আবার গাড়িতে ফিরে আসে লাবন্য। উঠেই গাড়িতে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। সেটা দেখে হিমেল এগিয়ে এসে জানতে চাইল , ''কিছু কি হারিয়ে ফেলেছেন ''? ''হুম ,আমার মোবাইলটা খুঁজি পাচ্ছি না । গাড়িতে কোথাও পড়ে গেছে হয়তো । একটা কল করে দেখবেন ,প্লিজ ''। ''ঠিক আছে ,নাম্বার বলেন ''। নাম্বার বলার পর অনেকবার রিং করে হিমেল । কিন্তু গাড়িতে কোথাও ফোন বাজছে না । বাজার কথাও না। লাবণ্য ফোনটা শর্মার কাছে রেখে এসেছে । কৌশলে হিমেলের নাম্বারটা নেয়ার জন্য তার এই ফোন হারানোর নাটক করা ।


ক্লাসের পর ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়েই বরফ গলা খাচ্ছে লাবণ্য আর শর্মা । প্রায় প্রতিদিনই এই জিনিসটা খায় দুজনে । তারা অপেক্ষা করছে হিমেলের । তার সাথে ভাল করে পরিচিত হতে চায় লাবণ্য । শর্মা মোটামুটি ভাবে হিমেলকে চেনে । হিমেলও শর্মাকে চেনে । তাই লাবণ্য শর্মাকে নিয়ে এসেছে তাকে হিমেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে । একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে তাই একজন আরেকজনের সাথে পরিচয় থাকাটা ভাল । ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাবার পথে তাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আগ বাড়িয়ে কথা বলে হিমেল । শর্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল - ''কেমন আছ ''? -''ভাল ,উত্তর দিল শর্মা । আপনি ''? ''হুম,ভাল । ও হ্যাঁ আপনার মোবাইলটা পেয়েছেন ? লাবণ্যর দিকে চেয়ে জানতে চাইল হিমেল '' । ''নাহ্ , কোন কিছু একবার হারালে আর পাওয়া যায় না - কি ? আর হ্যাঁ , আমাকে আপনি আপনি করবেন না তো !! আমি তো আপনার জুনিয়র তাই তুমি করে বললে খুশি হব''। '' তা না হয় হবে , কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু না খেয়ে আর কথা বলতে পারছি না । খুব ক্ষুধা লেগেছে । চল্ ,ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেতে খেতে কথা বলি । অবশ্য যদি তোমাদের কোন আপত্তি না থাকে ''।
- '' আমাদের ক্লাস তো শেষ । বাসায়ই যাচ্ছিলাম । চলেন বসি ''।

ক্যান্টিনে বসে সিঙ্গারা , চা খেতে খেতে হিমেল বলল এতক্ষন ধরে কথাই বলে যাচ্ছি অথচ তোমার নামটাই তো জানা হল না । এবার কথা বলল শর্মা । আরে !! সত্যি তো । আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্বটাই তো হল না এখনও। ok ,আমি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি ,ও হচ্ছে লাবণ্য আমার close friend.আর লাবণ্য ,উনি হচ্ছেন হিমেল ভাই আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র । শর্মাকে বাঁধা দিয়ে হিমেল বলল থাক্ থাক্, আমাকে মেধাবী বলে আর মেধাবীদের অপমান কর না । এরপর আরও কিছুক্ষন কথা বলল তারা । যাবার সময় একটি সুন্দর পিকনিক আয়োজনের জন্য হিমেলকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললো না লাবণ্য ।


রাতে হিমেলের নাম্বারে ফোন করল লাবণ্য । ওপাশে রিসিভ হতেই বলল, - ''কেমন আছেন ''? ''sorry, কে বলছেন? '' ''আমি মানুষ, এটাই কী কথা বলার মত পরিচয় হতে পারে না ''। '' দেখুন ,পরিচয় পেলে কথা বলতে সুবিধা হয় ''। ''পরিচয় না হয় পরে জানবেন। আচ্ছা ,আমি যদি মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করি আপনি কি বিরক্ত হবেন ''? ''কাউকে না চিনলে তো তার সাথে কথা বলতে খুব ভাল লাগার কথা না ''। ''ঠিক আছে ,অন্য দিন না হয় পরিচয় হবে । আজ রাখি। ''

কলেজেও তাদের আড্ডা চলতে থাকে রীতিমত । তিনজনই খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেছে এখন । ক্লাস শেষে প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা দেয়া যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে । হিমেলকে প্রথমদিন লাবণ্যর যে রকম দেমাগী মনে হয়েছিল এখন আর সেরকম মনে হয় না । আড্ডায় সে এখন কথার ফুলঝুরি ফুটায় । রাতেও ফোনে কথা বলার সময় ফটফট করে কথা বলতে থাকে । যদিও ফোনে হিমেলকে এখনও আসল পরিচয় দেয় নি লাবণ্য কিন্তু কদিন কথা বলার পর হিমেল ঠিকই ধরতে পারে ব্যাপারটা । বুঝতে দেয় না লাবণ্যকে । ক্রমেই সে দূর্বল হয়ে পড়ে লাবণ্যর প্রতি । কলেজের বেশির ভাগ সময় লাবণ্যর সাথে কাটলেও বাসায় ফেরার পরই অস্হির হয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন লাবণ্যকে ফোন করবে , কখন তার মিষ্টি কথা শুনবে । ফোন রেখে দিলেই বিভোর হয়ে অপেক্ষায় থাকে পরদিন কলেজ সময়ের । তার ধারনা লাবণ্যও একইভাবে তাকে মিস করে (না-কি করে না)। কিন্তু কেউই কাউকে বলতে পারে না ভাললাগার সেই চিরন্তন ''ভালবাসি '' কথাটি ।

কিছুদিন ধরে কিছুই ভাল লাগছে না লাবণ্যর । কেবলই অস্হির লাগছে । কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কারো সাথে । তাই মোবাইল অফ করে রেখেছে । কলেজেও যায় নি দুই তিন থেকে । এমন কেন হচ্ছে তার ? বার বার কেন হিমেলের কথাই মনে পড়ছে । এটাই কি তাহলে প্রেম ? নাহ্ এমন কেন হবে ? সে তো সত্যি সত্যি ভালবাসেনি হিমেলকে । শুধু তাকে পাত্তা না দেয়ার শাস্তি দিতে চেয়েছে হিমেলকে । কিন্তু এখন যেন সে নিজেই শাস্তি পাচ্ছে । তার চিন্তা চেতনা সব একই জায়গায় আটকে আছে। ধ্যুৎ ,কিচ্ছু মাথায় আসছে না । ভেবেছিল কদিন কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে হিমেলের সাথে দেখা না করলে বা ফোনে কথা না বললে সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা । আরও বেশি বেশি মনে পড়ছে । নিজের রুমে বসে এসব চিন্তা করছে লাবণ্য । এ সময় রুমে ঢুকে শর্মা । লাবণ্যকে দেখা মাত্রই ইচ্ছে মত ঝাড়ি দেয় টানা দশমিনিট । এক নিঃশ্বাসে জানতে চায় এই কয়দিন কলেজে যায় নি কেন ? ফোন বন্ধ কেন ? তিনদিনে একবারও তাকে ফোন করেনি কেন ? হাবিজাবি আরও অনেক কথা । শর্মাকে সব খুলে বলে লাবণ্য । হিমেলকে শাস্তি দিতে চায় লাবণ্য । সেটা শর্মা আগে থেকেই জানত । কিন্তু এদিকে লাবণ্যর যে বেহাল দশা সেটা আজই প্রথম জানল । সব শুনে বলল হিতে বিপরীত হতে পারে সেটা আগেই বলেছিলাম । কিন্তু তোর জেদের কারনে আমার কথা শুনলি না । এখন নিজেই কষ্ট পাচ্ছিস । এদিকে হিমেল ভাইয়ের অবস্হা ও তো বেশ খারাপ দেখলাম । দুদিন ধরে দেখছি ক্লাস না করেই আমাদের কমন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । সিগারেট টানে একটার পর একটা । যতবারই আমাকে দেখেছে ততবারই তোর কথা জানতে চেয়েছে । তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে শর্মা বলল পরশু দিনের প্ল্যান কী ? ''কেন ? পরশুদিন কি স্পেশাল কিছু ''? ''তোর জন্মদিন, তুই নিজেই ভুলে গেলি '' ''ও হ্যাঁ তাই তো । আসলে লাবণ্য ভূলেই গিয়েছিল তার জন্মদিনের কথা । শর্মার কথার উত্তরে বলল না-রে , কিচ্ছু ভাল লাগছে না । এবার জন্মদিন পালন করব না'' ''তা কী করে হয় ! এক কাজ করি আমরা সব বান্দবীরা মিলে না হয় তোর এই জন্মদিনটা আমাদের বাসায় ছোট পরিসরে পালন করি । শনিবার-ই তো তোর জন্মদিন আর ঐ দিন বাবা মা গ্রামের বাড়িতে যাবেন । কাজেই বাসাও ফাঁকা থাকবে। লাবণ্য বারবার না করলেও শর্মার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় । কথা হয় শনিবার বিকাল পাঁচটার মধ্যে শর্মার বাসায় পৌঁছে যাবে লাবণ্য। বিদায় নেয়ার সময় শর্মা বলে ঐ বিষয়ে হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিস না । চোখ বন্ধ করে নিজের মনের সাথে কথা বল । মন যেটা বলে সেটাই কর ।

ক্লাস থেকে বের হতেই শর্মা দেখল দরজার সামনে হিমেল দাঁড়িয়ে । কিছুটা উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছে তাকে । শর্মাকে দেখেই বলল , লাবণ্যর কী হয়েছে ? কদিন ধরে কলেজে দেখছি না যে ? তুমি কি কিছু জানো ? এক পর্যায়ে লাবণ্যকে যে সে ভালবেসে ফেলেছে তা খুলে বলে । তারপর একরকম কান্না জড়িত কন্ঠে শর্মাকে অনুরোধ করে , যে কোন উপায়ে লাবণ্যর সাথে তার দেখা করার সুযোগ করে দিতে । সব শুনে শর্মা বলে আমি চেষ্টা করব।

আজ শনিবার। ২৮এপ্রিল । লাবণ্যর জন্মদিন । সারাদিন ধরে বিছানায় শুয়ে আছে সে । কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না । কিন্তু শর্মার পোগ্রামের কথা মনে পড়তেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়ে । বিকাল পাঁচটার কিছু পরে শর্মার বাসায় পৌঁছায় লাবণ্য । দরজা খুলাই ছিল । ভেতরে ঢুকে কাউকেই দেখতে পেল না সে । ঘরের ভিতরটাও আবছা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে । এর মাঝেই দেখল টেবিলের উপর ''শুভ জন্মদিন লাবণ্য '' লেখা বেশ বড় সাইজের একটি কেক । রুমের চারদিকে ভাল করে তাকাতেই ঘরের কোনায় অন্ধকারে কেউ একজনকে বসে থাকতে দেখে। কিছুটা ভয় পেয়েই রুমের বাতি জালায় সে। এমন সময় পেছনে হঠাৎ শুনতে পায় ''শুভ জন্মদিন । তোমাকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভ কামনা ''। কন্ঠটা তার খুবই পরিচিত । হ্যাঁ ,পেছনে তাকিয়ে হিমেলকেই দেখল । তাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ে লাবণ্য । বিশ্বাস করতে পারছে না হিমেল এখানে আসল কেমন করে । নিশ্চয়ই শর্মার কাজ । ''কি অবাক হলে ''? হিমেলের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে লাবণ্যর । উত্তরে কিছু বলতে পারে না । হিমেলকে দেখে সে এতটাই অভিভূত হয়েছে যে মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না । হিমেল আরও কিছুটা এগিয়ে লাবণ্যর ঠিক সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসে । একটি লাল গোলাপ লাবণ্যর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ''প্রথমত আমি তোমাকে চাই , দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই ,তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই ,শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই ''। কথাটা শুনে চোখে পানি এসে যায় লাবণ্যর । সে-ও মনে প্রানে ভালোবাসে হিমেলকে । অন্তঃত গত কদিনে সেটা উপলব্ধি করেছে প্রবলভাবে । এই কদিন সে যতবারই চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে প্রশ্ন করেছে হিমেলকে সে ভালবাসে কি-না ,ততবারই উত্তর পেয়েছে অনেক বেশি ভালবাসে । আজ জন্ম দিনে নিজের ভালবাসাকে পেয়ে তাই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে তার চোখ । নির্বাক হয়ে লাবণ্য শুধু হিমেলের দুটি হাত শক্ত করে ধরে থাকে । পৃথিবীটাকে যেন এখন আরও বেশি সুন্দর আর আনন্দময় মনে হচ্ছে তার কাছে । মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করে ঘরটায় স্বর্গীয় সুখ নেমে এসেছে । সুখের অতিশয্যে তারা দুজন এতটাই মগ্ন ছিল যে ,কখন রুমে শর্মা , হেলেন,সানজিদা,নাদিয়া এসে ঢুকেছে টেরই পায় নি । সবাই যখন একসাথে বেশ বড় আওয়াজ করে লাবণ্যকে জন্মদিনের উইস করল তখনই যেন সম্বিত ফিরে পায় দু'জনে । তারপর শর্মা বলল লাবণ্য এবার কি দয়া করে কেকটা কাটবি ? তার কথায় কেক কাটে লাবণ্য এবং সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানায় তাদের । তারপর অনেক হৈ হুল্লোড় করে স্বন্দ্ব্যাটা পার করে তারা । সেই সাথে লাবণ্য'র কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় জন্মদিনের এ ক্ষনটি ।

"বোবা কষ্ট"

                                                                                              আজ রোদেলার বিবাহিত জীবনের ২৫ বছর পূর্ণ হল। এই ২৫ বছরের মধ্যে শুধুমাত্র প্রথম বছরটা ছাড়া কোন বিবাহবার্ষিকীতেই রোদেলা প্রান্তকে কাছে পায়নি। আজও যে পাবেনা এটা সে ভালো করেই জানে।জানলেও মেনে নিতে কেন যেন খুব কষ্ট হয় রোদেলার।

বিয়ের আগে কত রকমের স্বপ্নই না দেখেছিলো রোদেলা। যত ব্যস্তই থাকুক না কেন প্রতি শুক্রবার সারা বিকাল তারা এক সাথে ঘুরে বেড়াবে।সময় পেলেই দুজনে মিলে শপিং করবে। লং ড্রাইভে যাবে। একসাথে জ্যোস্না দেখবে, বৃষ্টিতে ভিজবে। আরোও কত কি!!! কিন্তু বিয়ের পর রোদেলা বুঝতে পারে তার এই স্বপ্নগুলো যে স্বপ্নই থেকে যাবে। কখনই পূরণ হবেনা।

রোদেলা যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন প্রান্তর মা বাবা রোদেলার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে। একেতো ছেলেরা বিরাট ধনী তার উপর ছেলের খুব বড় বড় বিজনেস আছে শুনে রোদেলার মা বাবা এই বিয়েতে আর অমত করেননি। খুব ধুমধাম করেই প্রান্তর সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়।

বিয়ের পর প্রথম বছরটা যেন স্বপ্নের মতই কেটেছিল। যখন যা যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই পেয়েছিল। প্রান্তর মা বাবা রোদেলা কে পরম মমতায় খুব আপন করে নেয়। একমাত্র ছেলের বউ বলে কথা। আর প্রান্তও রোদেলার সব চাওয়া পাওয়ার দিকে খেয়াল রাখত। কোন কিছুর প্রয়োজন অনুভব করার আগেই সব পেয়ে যেত। প্রান্ত কোন একভাবে জেনেছিল রোদেলা রজনীগন্ধ্যা ফুল খুব পছন্দ করে। তাই তো সে প্রতি সপ্তাহেই রোদেলার জন্য তার প্রিয় ফুলটি নিয়ে আসতো। একদিন রোদেলা কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে একটা গাড়ির ধাক্কায় রিকশা থেকে পড়ে যায়।এতে তার হাত পা সামান্য ছিলে যায়। আর হাতের দুটা আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়।রোদেলার এই অবস্থা দেখে প্রান্ত এমন অস্থির হয়ে গিয়েছিল মনে হচ্ছিল প্রান্তরই কিছু একটা হয়েছে। তার এই অস্থিরতা দেখে রোদেলার হৃদয়ে প্রান্তর প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে যায়। সে ভাবে এই জীবনে আর কিছুই লাগবেনা শুধু প্রান্ত তার পাশে থাকলেই তার দিনগুলো খুব আনন্দে কেটে যাবে। রোদেলা হয়তো ভাবতেও পারেনি তার জীবনে সুখটা যে খুব ক্ষনস্থায়ী।

প্রতি বছরে বিবাহ বার্ষিকীর দিনে ডায়রী নিয়ে বসাটা যেন একটা নিয়ম হয়ে গেছে। তাই তো সে এ বছরও তার প্রিয় ডায়রীটা নিয়ে বসেছে। এই ডায়রীটাই যেন এখন তার সবচেয়ে কাছের হয়ে গেছে। রোদেলার আজো মনে পড়ে বিয়ের প্রথম বছর ঠিক এই দিনেই প্রান্ত তাকে কিভাবে চমকে দিয়েছিলো। ঐ দিনটি যেন আজো সে স্পষ্ট দেখতে পায়। রোদেলা তার সব কাজ গুছিয়ে রুমে প্রবেশ করা মাত্রই যখন দেখল যে আধো আলোমাখা রুমের বিছানার পাশের টেবিলটায় শোভা পাচ্ছে বিশাল এক ফুলের তোড়া। কত রকমের মোম দিয়ে পুরা রুমটাকে প্রান্ত কত অদ্ভুত ভাবেই না সাজিয়েছে। আর মোমের আলোতে রুমটা যে কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে।রোদেলা ভাবতেও পারেনি প্রান্ত এমন কিছু করবে। বিস্ময়ে আর আনন্দে সে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। এরপর প্রান্ত যখন তার ব্যাগ থেকে একের পর এক প্রথম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আনা গিফটগুলো বের করে রোদেলার হাতে দিচ্ছিল মনটা এত ভরে গিয়েছিলো যে খুশীতে সে আর চখের পানি আড়াল করে রাখতে পারেনি। এরপর থেকে প্রতি বছরই সে প্রান্তর দেয়া উপহারগুলো দেখে আর চখের পানি ফেলে। কিন্তু কেন যেন তা আর প্রথমবারের মত আনন্দ অশ্রু হয়ে ঝরেনা।


বিয়ের দু তিন বছর পর থেকেই প্রান্তর মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন চলে আসে। বিজনেস নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে যায় যে তাকে বেশীরভাগ সময়ই দেশের বাইরে থাকতে হত। কিন্তু এই ব্যাপারে রোদেলার কোন আপত্তি ছিলনা। কারন রোদেলা সবসময়ই চেয়েছিল প্রান্ত যেখানেই থাকুক না কেন যেন সে খুব ভাল থাকে। কিন্তু প্রান্তর ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমন আর বিদেশেই বেশীরভাগ সময় থাকাটা রোদেলাকে ভাবিয়ে তোলে। প্রথম প্রথম ৩/৪ মাসে ১০/১২ দিনের জন্য রোদেলা প্রান্তকে কাছে পেত। এরপর আস্তে আস্তে রোদেলার কাছাকাছি থাকার দিনগুলো যেন আরো কমে যেতে থাকে। এভাবে সময় যত যেতে থাকে প্রান্তও যেন ধীরে ধীরে রোদেলার থেকে অনেক দূরে সরে যায়।


বিয়ের চার বছরের মাথায় রোদেলা ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। রোদেলা ভাবতেই পারেনি যে এই সময় সে প্রান্তকে কাছে পাবে। প্রান্ত যখন তার মায়ের সাথে কথা বলছিল এক পর্যায়ে উনি তার নাতির কান্নার শব্দটা প্রান্তকে শোনায়। ছেলের কান্নার শব্দ শোনে পরদিনই সে সিঙ্গাপুর থেকে ছেলেকে দেখতে চলে আসে। প্রায় ৫/৬ মাস পর প্রান্তকে দেখে রোদেলা যেন তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। রোদেলা ভাবে প্রান্ত অনেক দিন পর পর দেশে আসলেও বা কি তবুও তো কিছুদিনের জন্য হলেও প্রান্তকে কাছে পাচ্ছে। এটাই বা কম কিসের???


সময়ের ব্যবধানে সবার জীবনে কত রকমেরই না পরিবর্তন আসে। কত রকমের ঘটনাই না ঘটে যায়। এখন রোদেলা বুঝতে পারছে তাই মাঝেও যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। কিছু কষ্ট যেন মানুষের মনকে পাথর করে দেয়। রোদেলার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে আসা একটা চিঠি যেন রোদেলার জীবনকে অনেক পরিবর্তন করে দেয়। চিঠিটায় প্রান্ত কত স্বাভাবিকভাবেই না লিখেছিল তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা। সে যে আর কখনই দেশে ফিরবেনা এটা জানিয়ে দিতেও প্রান্ত যেন বিন্দুমাত্র সঙ্কোচবোধ করেনি। মানুষ বদলায় কিন্তু প্রান্ত যে এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে রোদেলা তা কল্পনাও করেনি।


এই ২৫ তম বিবাহবার্ষিকীর দিনে রোদেলা তার পাওয়া না পাওয়া দুঃখ-কষ্ট আনন্দ-বেদনায় মিশে থাকা দিনগুলোর কথা ভাবছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে ছেলে সৌম্যই প্রতি বছর এই দিনটায় মাকে খুশী রাখার জন্য কত কিছুরই না আয়োজন করত। এই দিনে মা যেন চোখের পানি ফেলার সুযোগ না পায় এজন্য সে মাকে নিয়ে সারা দিন ঘোরাঘুরি করে রাতে ডিনার সেরে বাসায় ফিরত। কিন্তু এবার সৌম্য কাছে না থাকায় অতীতের কষ্টগুলো যেন রোদেলাকে আরোও পেয়ে বসেছে। রাজশাহী মেডিকেলে পড়ার কারনে সৌম্যকে ওখানেই থাকতে হচ্ছে। দুদিন পর তার ফাইনাল পরীক্ষা। পড়ার চাপে হয়তো এই দিনটির কথা ভুলেই গেছে, ভাবছিলো রোদেলা। ঠিক এই মুহূর্তেই রোদেলার ফোন বেজে উঠে। রিসিভ করা মাত্রই সৌম্য অস্থির হয়ে বলে-"মা অনেক্ষন ধরে বেল বাজাচ্ছি,দরজাটা কি একটু খুলবে?"

দরজা খুলেই রোদেলা দেখে সৌম্য বিশাল একটা ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে দেখেই যেন রোদেলার মনের গহীনে জমাট বেধে থাকা বোবা কষ্টগুলো এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। ছেলেকে কপালে গালে চুমু দিতে থাকে। এরপর জড়িয়ে ধরে বলে-"আমাকে কখনও একা করে দিস না বাবা।" সৌম্য বুঝতে পারে তার মা যে অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু এ কান্না কি সুখের নাকি দুঃখের তা আর বুঝে উঠতে পারেনা...                                                                                                                             

ভালোবাসার সাত রং

                                                                                                                                                                                                               অনিন্দিতার ছুটির দিনের বিকেলেবেলাটা কাটে খুব সাদামাটাভাবে।
সারা সপ্তাহের কাজের পর ছুটি পেয়ে ইচ্ছে মতন নাক ডুবিয়ে ঘুমিয়ে নেয় সবাই।
মেয়ে তামান্না এমবিএ করে সম্প্রতি ব্যাংকে ঢুকেছে। প্রাইভেট ব্যাংক । যেমন বেতনের বাহার তেমনি হাড়ভাঙা খাটুনি। রাত আটটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। ছুটি পেলে খেয়ে না-খেয়ে ঘুমায়।
ছোটো ছেলে ইন্টার্নি ডাক্তার। সবাই কেবল ওর উপর কাজ চাপায়। সে নিজেও কাজ পাগল। কাজ পেলে সে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কাজটাই কেবল করতে থাকে। ছুটির দিনে সে-ও ঘুমায় পাগলের মতো। সময় মতো ডেকে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। নইলে পুরো দিন কোরবান করে দেবে ঘুমে।
আর রইলেন ইলিয়াস সাহেব। তিনি বারোশ স্কোয়ার ফিটের এই সুসজ্জিত এপার্টমেন্টটির গর্বিত কর্তা। অনিন্দিতার স্বামী। রিটায়ার করতে আর মাত্র দুবছর বাকি। পাসপোর্ট অফিসে কাজ করেন। প্রতিদিন এত পাসপোর্টে সই-সাবুদ করতে হয় যে বাড়ি ফেরার পর মানুষটির দিকে তাকালে রীতিমতো কষ্ট লাগে অনিন্দিতার। এই লোকটির জন্যে ছুটির দিন মানে স্বর্গোদ্যানে বেড়াতে যাওয়া। ঘুম না এলেও এমন আয়েস করে শুয়ে থাকে যে মনে হবে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ বুঝি সে।
এই পরিবারে অনিন্দিতার কেবল অফুরন্ত অবসর। সামান্য রান্নাবান্না আর ঘর গেরস্থালীর কাজ ছাড়া তেমন কিছু নেই করার। তাও ঠিকে ও স্থায়ী কাজের মানুষ থাকায় কোনো বাধ্য বাধকতা নেই কাজের। করলে করো , নইলে শুয়ে থাকো। কিঞ্চিৎ চোখ-কান খোলা রাখলেই হল। অবশ্য, একসময় হাত ভরা কাজ ছিল ওর । এতো কাজ যে করতে গিয়ে হিমসিম খেতে হতো। বাচ্চাদের পড়ালেখা করানো, নিয়মিত স্কুলে নিয়ে যাওয়া, ঘড়ির ঘন্টা-মিনিটের কাঁটা ধরে রান্না-বান্না করা, স্বামীর মন যোগানো, আত্মীয়-স্বজন ম্যানেজ করা, সামাজিকতা সব তো ওকে একাই সামলাতে হতো। তখন এত ফাঁকা সময় কই গালে হাত দিয়ে ভাববার?
এই পরিবারে অনিন্দিতা সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতেও একা । বাবুর্চি আর কাজের বুয়ার সাথে কয়েক ঘন্টা কাটানোর পর হাতে জমে থাকে অফুরন্ত সময়। এসময়টুকু সে ঘুমিয়ে , টেলিভিশন দেখে আর আত্মীয় -স্বজনের সাথে অবিরাম কথা বলে কাটায়।
ছুটির দিনগুলোতেও সে একা। কেননা, সবাই তখন গাঢ় ঘুমে মগ্ন। এতো ঘুম আসে কোথ্বেকে ভেবে আকুল হয় মন।
এসময়টায় মন খারাপ করে কখনো ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে কলোনীর দৃশ্য দেখে কিংবা নিজের রুমে গিয়ে টেলিভিশর ছেড়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখার পুররাবৃত্তি করে। দেখা হয়ে গেছে , তবু তাকিয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কী যে এর আবর্ষণ তা বলে বোঝানো দায়।
পঞ্চাশোর্ধর্ অনিন্দিতার সময় কাটে এভাবেই।

খ.
আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনে অনিন্দিতার পরিবারে যা হয় হয় আজো তাই চলছে। পিছনে সবাই ভূতুড়ে ঘুম ঘুমিয়ে নিচ্ছে আর সে বসে রয়েছে ব্যালকনির গ্রীল ধরে।
টেলিভিশন দেখে এসেছে এতোক্ষণ। চোখে ব্যথা হচ্ছে কড়া আলোর চাপে।
তবু কখনো দাঁড়িয়ে কিংবা কখনো পাতা চেয়ারে বসে নীচের দৃশ্য অবলোকন করতে থাকে।
ওদের এই কলোনীটা স্বাধীনতার পরপরই তৈরি হয়েছে। তখনো ঢাকা শহরটা বসবাসের যোগ্য ছিল ; কিলবিল করা অগুনতি মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়া শহরটাকে বছরের পর বছর ধর্ষণ করে মেরে ফেলেনি। তখনো কেউ ভাবত না যে বুড়িগঙ্গায় গোসল করা আর দশ বছরের জেল ফেরতের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সমান কথা ।
সূত্রাপুরের মিলব্যারাকের দিকে গিয়ে বুড়িগংগার পাড়ে বসলে সন্ধ্যার পর ঠিকই চাঁদের দেখা মিলত। নদীর মৃদু হাওয়া গায়ে মেখে চাঁদের দিকে চোখ রাখলে সত্যি সত্যি স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো সুখ অনুভব হতো অন্তরে।
ওদের কলোনীর পাকা উঠোনে দাঁড়ালেও চাঁদের দেখা মিলত। পায়ে - পায়ে তখন এতো বাড়ি-ঘর কোথায় ঢাকা শহরে? নারকোল , সুপারি আর বড়ো বড়ো গাছের ফাঁকে ঠিকই নববধূর মুখের মতো চাঁদ কথা কয়ে উঠত। গরমকালে ফ্ল্যাট বাসীরা উঠোনেই বারোটা বাজিয়ে ফেলত। এমনি কমনীয় পরিবশে তখন।
অথচ বেশিদিন আগের কথা তো নয়। ছিয়াত্তর সাতাত্তর সনের ঢাকা তখন। মুড়ির টিন ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো গণ-বাহন তখন আর কই। একটা একতলা বাড়ি , একটা কালো টেলিফোন আর একটা ভোক্স ওয়াগন যার আছে সে তো মহা বড়লোক। তার দিকে তাকায় কজন !
মানুষের সম্মান ছিল সমাজে। পাশাপাশি সম্পদেরও আভিজাত্য ছিল । কারণ, সেটি সবাইকে সবার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে অর্জন করতে হতো। সমাজ তখনো লুটেরা বণিকশ্রেণীর দখলে চলে যায়নি!
শুরু থেকে চোখের সামনে কতো যে পরিবর্তন হল এই কলোনির ফ্ল্যাট- মালিকদের। কোনো কোনো ফ্ল্যাটের ছয়বার পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়েছে মালিকানা।
কতো রকমের মানুষ এখন চোখে পড়ে। চিনতে পারে না অনিন্দিতা। মাঝে মাঝে দারোয়ানও খেই হারিয়ে ফেলে ।
অজস্র অচিন মুখ। ইচ্ছে করে না এখন আর নীচে নেমে বাতাস খেতে। বরং উপর থেকে কলোনীর ভেতর মানুষের আনগোনা দেখতে মন্দ লাগে না। না চিনুক, তবু অপিরচিত মানুষের একটা আকর্ষণ থাকে, যা রোধ করা সত্যি মুশকিল।
কে কিভাবে হাঁটছে , কোন্ ফ্ল্যাটে যাচ্ছে , কীরকম জামা- কাপড় পরেছে , কী গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করছে সব খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সময় কেটে যায় অনিন্দিতার।
বিকেল হতে না হতেই সবার আগে যে ছেলেটা নেমে এসে মাঝ উঠোনে গলা খাঁকারি দেয় ওর নাম রাসেল। জিমে যাওয়া শরীর স্বাস্থ্য। স্কিনটাইট গেঞ্জি গায়। মুখের গড়ন পুরনো দিনের ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো।
সে মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে ব্যায়াম করে আর গলা খাঁকারি দেয় জোরে জোরে। চোখ থাকে দুই নম্বর বিল্ডিংএর তিন তলার ব্যালকনির দিকে।
একটু পর বরফ খন্ডের মতো ফর্সা পেলব একটি মেয়ের চেহারা ভেসে আসে ঐ বারান্দায়। চোখাচোখি আর হাসাহাসি। আর কিছু হয় কিনা অনিন্দিতার জানা নেই। হয়তো হয় কিংবা হয়তো হয় না। হয়তো ফাস্ট ফুড খেতে মাঝে মধ্যেই পিজা হাটে চলে যায়। কথা হয় । গানের ডিভিডি বিনিময় চলে।
ওর এসব জানার কথা নয়। সে লিজা নামের মেয়েটাকেও চেনে না। আর রাসেল নামের ছেলেটাও ওর পরিচিত নয়। কারণ , ওরা দুজনই ভাড়াটে। ভাড়াটেদের ব্যাপারে এই ঢাকা শহরে কম মালিকদেরই আগ্রহ থাকে। ওরা শ্যাওলার মতো , ভেসে আসে , ফের চলে যায়। কোথায় , কোন্খানে তাদের ঠিকানা তা নিয়ে বাড়িওলারা মাথা ঘামায় না। যতো বড়ো লোক আর ক্ষমতাশালীই হউক না কেন ভাড়াটে , বাড়িওলাদের কম আগ্রই কাড়তে পারে তারা।
অনিন্দিতাও বিরক্ত হয়ে ভাবে,‘ কোথ্বেকে যে আসে সব আজবের দল। এসেই প্রেমের কলেজে ভর্তি হতে চায়। ফালতু। ’
রাসেলের পর পরই খ্যাপাটে বাড়িওলা হামদু সাহেব নিজের ফ্ল্যাট থেকে নেমে আসে নীচে। তিনি একা মানুষ। ছেলেমেয়ে সব বিদেশে। কোনোকালে আমলা ছিল। এখানে বিশাল ফ্ল্যাটে নিজে রেধে খায় আর পুরো কলোনী জুড়ে মাতব্বরি করে বেড়ায়।
ওকে দেখেলে সবাই লুকোতে চায়। অযাচিত ও অগুনতি প্রশ্নের ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে থাকে রীতিমতো। অপরিচিত ও ভাড়াটে হলে তো কথাই নেই।
রাসেল লুকোতে গিয়েও মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়। মুখোমুখি পড়ে যায়। ব্যস , পড়লেই হল, প্রতিদিন একই কথা।
‘হু আর যূ?’
‘স্যর আমার নাম রাসেল। ’
‘হয়্যার ডু যূ লিভ ইন? হয়্যার?’ হুংকার দিয়ে ওঠে হামদু সাহেব।
‘চাইর নম্বর বিল্ডিংএর তিন-এ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকি। ’
‘হুয়াট ইজ ইয়োর কুয়ালিফিকেশন? টেল মি? ’
‘এমবিএর ছাত্র। ’
‘স্পিক ইন ইংলিশ । ডোন্ট যূ নো ইংলিশ বিং এ স্টুডেন্ট অব এমবিএ? ’ বলে চেঁচাতে থাকে।
তিনতলার সেই বরফ কন্যা ততক্ষণে ব্যালকনি ছেড়ে সুড়–ৎ করে ঘরে ঢুকে গেছে। আর রাসেল ইঁদুরকলে আটকে থাকা ইঁদুরের মতো আপ্রাণ চেষ্টা করছে হামদু সাহেবের প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পেতে।
অনিন্দিতা উপরে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করে আর মনে মনে হাসিতে ভেঙে পড়ে।
এরকম কিছু মজাদার দৃশ্য ওর নির্জন আনন্দের উপকরণ।

গ. 
আজো এরকম এক মজাদার দৃশ্য দেখার আগ্রহ নিয়ে গ্রীল ধরে অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওর ঠিক পিছনে ঘরের ভেতর সবাই ঘুমে অচেতন। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
শুধু স্পি¬ট এসি দুটো থেকে সমুদ্রের ঢেউর শব্দ ভেসে আসছে অবিরাম।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর সে হেলান-চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয়। দৃষ্টি গ্রীল ছাড়িয়ে লনের উপর, শূন্য ও উদাসীন সেই দৃষ্টি।
রাসেল আর বরফকন্যার কথা চালাচালি হচ্ছে চোখে চোখে। মেয়েটি চাইলেই নেমে আসতে পারে নীচে। কথা বলতে পারে অনর্গল। অনেকেই বলে , আজকাল এসব নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। দল বেধে বেইলি রোডে গিয়ে ফাস্ট ফুড খাওয়া , বসুন্ধারার সিনেপে¬ক্সে গিয়ে ইংরেজি ছবি দেখা, গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে যাওয়া এসব তো এখন পান্তাভাত। সেখানে রাসেল-বরফকন্যার এই চোখাচোখির কেচ্ছা মোটেই যুগসম্মত নয় বলে অনিন্দিতার মনে হয়।
কিছুক্ষণ বাদে হামদু পর্বও শেষ হয়ে গেল। প্রতিবারই লোকটি কাউকে না কাউকে না-চেনার ভান করে এবং অকারণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে নাতি সমান ছেলেপিলেদের।
আজ এক-দুটো কথার পরই ছেড়ে দেয় রাসেলকে। হামলে পড়ে দারোয়ানের উপর। ‘ডু য়ূ নো মি? আই এ্যাম দ্য ওল্ডেস্ট ওনার অব দিজ কলোনী। হুয়াই ডোন্ট যূ শো মি রেসপেক্ট? হুয়াই ?’ বলে বলে পুরো কলোনী কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দারোয়ান যত বলে ‘স্যর, আমি আপনেরে দেখবার পাই নাই। তাই সালাম দিবার পারি নাই। ’ তত হামদু সাহেবের গলা চড়তে থাকে। একসময় গালাগালি শুরু হয়ে যায় , ওয়ার্থলেস-হোপলেস দিয়ে আরম্ভ হয়ে সমাপ্তি ঘটে স্টুপিড - রাসকেল -ডাফারে । গালাগালির যত না তীব্রতা তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি কন্ঠের শক্তি। যাতে দূর থেকেই মনে হবে এখানে কিছু একটা হচ্ছে।
অনিন্দিতা এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত। এসব আর এখন ওর মনে আনন্দ যোগায় না। সে পাতাবাহার গাছের মতো গ্রীলের ধারে অলস সময় কাটায়। ওর ঠিক পিছনে সাজানো গুছানো ঘুম-বাড়ি।
সেখানে প্রতিটি ঘরে এসির সোঁ -সোঁ বাতাসে ভাদ্রের প্রচন্ড গরমেও শীতের হাড়কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে , কম্বলে গা ঢেকে ঘুমিয়ে থেকেও এর থেকে নিস্তার মেলে না। ঘুম চোখে রিমোট নিয়ে মাঝে মাঝে তা কমাতে হয় !
অনিন্দিতা অলস চোখে একবার নীচে তাকায়। হামদুর গলাবাজি যত এগোচ্ছে তত খোকা য়ূ-ক্যালিপটাসের নীচে দাঁড়িয়ে রাসেলের অঙ্গ-ভঙ্গি বাড়ছে। ইশারায়-ইঙ্গিতে মেয়েটিকে যে সে কী বোঝাতে চাইছে তা ওর মগজে ঢুকছে না। মেয়েটির চোখে একটাই ভাষা , কৌতূহল। আর কিছু নয়।
এই মোবাইল আর কম্পিউটার যুগে এসব বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ ভীষণ বেমানান লাগছে অনিন্দিতার কাছে। রাসেলটা কি গেঁয়ো?
ওর নিজের কথা মনে হচ্ছে এ সময়টায়।
পচাত্তর ছিয়াত্তর সনের কথা। অনিন্দিতার বাবার বাসা সূত্রাপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাওয়া -আসা মুশকিল হওয়ায় ওকে থাকতে হচ্ছে রোকেয়া হলে। ইলিয়াসের নতুন চাকুরি। বাসা নেবার মতো টাকা নেই।সাত-আটজন মিলে রামপুরার দিকে কোনোরকমে মেসে বসবাস করে।
বিকেল হলেই অনিন্দিতার তখন উচাটন মন ঘরে রয় না। কখন ইলিয়াস চিরকুট পাঠাবে সেজন্য অপেক্ষা।
তারপর পাশাপাশি দুজনার বসে থাকা। দরকারী কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দুজনার কারো মুখে রা নেই। অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রয়েছে পাশপাশি। ভাল লাগার অদ্ভুত মাদকতা, কিভাবে যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামত নিজেরা টেরই পেত না।
ওকে একবার দেখলেই হত । শরীর মন সব চনমন করে উঠত। ক্ষণে ক্ষণে কান্না পেত। কোথ্বেকে যে এত কান্না আসত তা এখন ভাবলে হাসি পায়। সারাক্ষণ এক ধরনের বালখিল্যতা গ্রাস করে রাখত ওর সমস্ত শরীর-মন।
সেসব স্মৃতি এখন অনিন্দিতার কাছে প্রাগৈতিহাসিক আমলের কোনো অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়। এখন ছেলেরা চিরকুট কি বস্তু তা হয়তো জানেও না। হল থেকে বেরোতে বেরোতে একটা এসএমএস , হলের কিনারে এসে একটা এবং গেটে দাঁড়িয়ে একটা মিসকল। ব্যস , হয়ে গেল। রোদ নেই বৃষ্টি নেই ঘন্টার পর ঘন্টা হল গেটে দাঁড়িয়ে থেকে গররাজি এক বোর্ডারের কাছে চিরকুট গুঁজে দিয়ে অপেক্ষা করার স্মৃতি কি এখন কারো কারো কাছে হাস্যকর বলে মনে হবে না?
রাসেলটা কি ওদের সময়ের কেউ নাকি?
নইলে সে চোখাচোখি -দেখাদেখির মাঝে কী এমন মজা পায় ?
অনিন্দিতা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
সে বিরক্ত, চোখ বুঁজে তা থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ঘ.
এমনি সময় ঘটনাটা ঘটল।
ঘটনা ঠিক নয়।
অপরিচিত কিছু শব্দ। হামদুর হম্বি তম্বি নয়, আবার দারোয়ানের কাকুতি মিনতির মতোও লাগছে না।
অনিন্দিতার তন্দ্রা মতন পাচ্ছিল । চোখ খুলতে মন সায় দিচ্ছে না।
একই রকম দৃৃশ্য কল্পনা করে সে চোখ বুঁজে থাকবার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে।
একটু বাদে চেঁচামেচির ধরনে ওর সন্দেহ গাঢ় হয়।
সে দাঁড়িয়ে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ঘটনাটি।
অনিন্দিতা একেবারে থ।
দুজন হিজড়া জোর করে কলোনির ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
দারোয়ান যত তাড়া দেয় ওদের বের হয়ে যেতে তত ওরা চেঁচাতে থাকে,‘ ওই হারামীর ব্যাটা। বুঝস না , অনারকলি আইছে সেলিমের খোঁজে, বুঝস না বিনদাস কুনহানের।’ বলে দারোয়ানের গালে ঠোকর বসায়। পাশে দাঁড়ানো হামদু একেবারে চুপসে যায়। কোনো কথাই যেন মুখ থেকে বেরোচ্ছে না। একবার কিছু একটা বলতে গেল , ওমনি একজন হামদুর সামনে হাত -পা নেড়ে গান গেয়ে উঠল, বন্ধু তিনদিন তর বাড়িৎ গেলাম দেখা পাইলাম না/ আইতে যাইতে বারোয়ানা উশুল হইল না। ’
অন্যজন পাশ থেকে ধোঁয়া দেয়,‘কী যে কস, অহন আবার বারোয়ানা আছেনি? অহন পাঁচশ ট্যাকা।’ বলে সে হাত ঢুকাতে চায় হামদুর শার্টের পকেটে।
হামদু হম্বি -তম্বি ছেড়ে এক লাফে দূরে সরে আসে।
অনিন্দিতা মজা পায় দৃশ্যটা দেখে।
দারোয়ান ফের চেঁচায় ।
কিন্তু দারোয়ানের কথা ওদের কানে ঢোকে না। ওদের লক্ষ্য কেবল রাসেলের উপর।
রাসেল তখনো বরফকন্যার সাথে তাকাতাকি নিয়ে মশগুল । এরকম কাজে নিবেদিত থাকায় টেরই পায়নি কখন দুই হিজড়া এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
দারোয়ানের হাজারবার নিষেধ সত্বেও ‘জানেমন’ বলে ছুটে আসে রাসেলের দিকে।
সহসা চোখের সামনে ওদের দেখে রাসেল প্রথমে ভড়কে যায়। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারে না।
অনিন্দিতার বেশ লাগে রাসেলের এই অপ্রস্তুত হবার দৃশ্যটি।
রাসেলের ভ্যাবচ্যাকা খাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে একজন হিজড়া বলে ওঠে‘, ওর নাম আনারকলি। তর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে আছে। ’
‘আমি?’ আকাশ থেকে পড়ে রাসেল। সে চোখ বড় বড় করে দুজনার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় অসহায় লাগে রাসেলকে এসময়। অনিন্দিতা বেশ মজা পায় । হাসি এসে যায় ঠোঁটের কোণে।
আনারকলি নামের হিজড়াটি বেশ সেজেগুঁজে এসেছে। চুলে খোঁপা বেধেছে, ঠোঁটে মেখেছে লিপস্টিক, চোখে দিয়েছে কাজল আর চাপাভাঙা গালের হনুয় ঘষেছে লাল রঙ। শরীরে পেঁচানো রঙচঙে জর্র্জেট শাড়ি , পায়ে লাল ফিতার জুতো জোড়া আর মুখে পান। এই নিয়ে আনারকলি সলজ্জ চোখে রাসেলের দিকে একবার তাকাচ্ছে আবার পরক্ষণে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রেমের আতিশয্য বড় তীব্র হয়ে ওকে গ্রাস করে ফেলেছে। ছাড়া পাওয়ার কোনো রাস্তা খোলা নেই আনারকলি নামের হিজড়াটির সামনে।
সঙ্গী হিজড়াটি কন্ঠকে বিকৃত করে উত্তর দেয়,‘ ওমা, নাগর য্যান কিছু বোঝে না। দুইদিন আগে কফি খাইতে বেইলি রোডে গ্যালা, ওইখানেই তো আনারকলির মন কাইরা নিলা। এক দেহাতেই আনারকলির দেহ-মন সব কাইরা নিছ তুমি । মাইয়াডা খায় না, ঘুমায় না। খালি কয় তুমার কতা। বহুত কষ্টে জিগাইতে জিগাইতে তুমার ঠিকানা পাইছি। আর অহন তুমি কও আমরা কেডা? হায় বেরহম জানেমন, তুম কিত্না পাথ্বরদিল নিকলা! হায় পরওয়ারদিগার , হায় খোদা মেহেরবান!!’ বলে সে শরীরে হিলে¬াল তুলে নাচের ভঙ্গি করে।
অনিন্দিতার হো: হো: করে হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঘটনাটা কদ্দুর গড়ায় দেখার জন্যে সে ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে রয়েছে। কৌতূহলের নিুচাপ এত বেশি যে সময়ের সাথে সাথে রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়ছে সে। কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না সেখানে।
রাসেল বাঁচার জন্যে দারোয়ানকে ডাকতে লাগল,‘ আরে ভাই, ওদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ওদের দেখতে পচ্ছেন না? আজব কতগুলো মানুষ ভেতরে ঢুকে পড়েছে আর আপনি হাওয়া খাচ্ছেন?’
রাসেলের তাড়া খেয়ে দারোয়ানটি হাতে একটি লাঠি নিয়ে ছুটে আসে ওদের দিকে। কিন্তু কাছে এসেই কেমন যেন চিমসে যায়। হিজড়া দুজনার দিকে তাকিয়ে সে নিজে মিন মিন করতে শুরু করে।
রাসেল চেঁচায় ,‘ তাকিয়ে দেখছেন কি? তাড়াচ্ছেন না কেন এদের? রং দেখেন নাকি?’
এবার দারোয়ানটি চেঁচিয়ে ওঠে‘, বাইর হন , বাইর হন কাইতাছি। ’
কিন্তু হিজড়া দুজন দারোয়ানের কথায় মোটেই কর্ণপাত করছে না।
আনারকলির সঙ্গীটি ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে,‘ হুদা কি আমিই কতা কমুনি ? তুই তর ডারলিংরে কিছু কবি না?’
‘কি কমু আমি? আমার লজ্জা করে। ’ বলে সে ওড়নায় দাঁত কামড়ায়।
‘ক, কিছু একটা ক।’
‘আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ।’ বলে আনারকলি মাটিতে বসে পড়ে মুখচোখ হাতের তালু দিয়ে ঢেকে ফেলে।
একটু বাদে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলা নেই কওয়া নেই কাঁদতে থাকে । ঝরঝর করে চোখ বেয়ে ওর জল ঝরছে। এক পর্যায়ে রাসেলের হাতটি এক ঝটকায় নিজের সমতল বুকের উপর চেপে ধরে চীৎকার করে ওঠে,‘ আমার মত কেউ তুমারে এ্যাতখানি লাভ করতে পারবে না জানেমন।এ্যাই আনারকলি তুমার জন্য জান দিবে , সাত তলা থেইক্যা লাফ দিবে। সাপের বিষ খাইয়া মারা যাইবে। খোদা কসম, আমার দিকে চাইয়া একবার হাস, আমি চইল্যা যামু। জানেমন , একবার হাইসা বিদায় দ্যাও। ’
অনিন্দিতা এবার সত্যি সত্যি হেসে ওঠে। বাঁকা চোখে একবার তিনতলার বরফকন্যার দিকে তাকায়। সে বহু আগেই পালিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
এবার অনিন্দিতা তাকায় পাগলা হামদুর দিকে। সে এক পা -দু পা করে কখন যে সবার অগোচরে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেছে তা টেরই পাওয়া যায়নি।
কলোনির পুরো উঠোন জুড়ে রয়েছে দুজন হিজড়া আর রাসেল নামের এক ভাড়াটে যুবক। অপ্রস্তুত অপারগ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দারোয়ানটিও আছে সাথে। আর আছে অনিন্দিতার মতো বেশ কয় জোড়া কৌতূহলী চোরা চোখ , যারা
ব্যালকনির আড়াল থেকে মজা লুটতে চাইছে সংগোপনে।
অনিন্দিতা অপেক্ষা করছে এক চরম পরিণতির।
রোমিও -জুলিয়েটের মতো কোনো এক ক্যাটাস্ট্রফির জন্যে নিদারূণ অপেক্ষা ওর।
একটা রক্তারক্তি অবস্থা যা সবাইকে বিস্মিত , উদ্বেলিত ও হতচকিত করে দেবে।
র‌্যাব -প ুলিশ নিয়ে টানাটানি হবে, কলোনি জুড়ে বইবে প্রচন্ড টেনশন।
পত্রিকার পাতা দখল করবে এমন এক সংবাদ যা আপামর মানুষকে আমূল নাড়িয়ে ছাড়বে।
অনিন্দিতা কল্পচোখে দেখতে পাচ্ছে - আনারকলি ওর সেলিম ওরফে রাসেলের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে উন্মাদিনী হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সে একটি ধারালো ছুরি নিয়ে নিজের পেটে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করে বসে।
কলোনির উঠোন জুড়ে কেবল রক্ত।
ঘটনার আকস্মিকতায় কলোনির লোকজন হতভম্ব।
সাক্ষ্যের ভয়ে কেউ বেরোচ্ছে না। অনাগত শংকায় সমস্ত ফ্ল্যাটবাসী থরথর কাঁপছে।
অনিন্দিতা এর ব্যতিক্রম নয়।
ওর কপালেও একটু একটু করে স্বেদবিন্দু জমা হচ্ছে।

ঙ.
এসময় অনিন্দিতার কাঁধে কারো হাত পড়ে। সম্বিৎ ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় ইলিয়াসকে।
ঘুম চোখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
হাতে ধরা একটি লাল গোলাপ। স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে নি:সঙ্গ স্ত্রীর দিকে।
ইলিয়াসের হাতে ধরা গোলাপটির উপর নজর পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে অনিন্দিতা,‘ তুমি কি একটা? আবারও বেডরুমের বাগানে গিয়ে গোলাপ ছিঁড়েছো? কত কষ্ট করি আমি টবের গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখছি তা তুমি জানো?’
‘এই জন্যই তো নিয়ে এলাম। হ্যাপি বার্থডে টু য়ূ।’
সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার চোখ দুটো কুঁচকে যায়। নিজের জন্মদিনের কথা কোনোকালেই মনে থাকে না ওর। বাড়ির কেউ এ ব্যাপারে মাথাও ঘামায় না। ইলিয়াস তো জন্মদিন নিয়ে কোনোরূপ আদিখ্যেতা একদম সহ্য করতে পারে না। ওর কাছে এগুলো বৃটিশদের শেখানো একরকম ন্যাকামো অভ্যেস ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি কোনোকালে।
এতবছর পর পড়ন্ত বয়সে এসে সেই ইলিয়াস নিজে থেকে ওকে ফুল সাধছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা হিসাবে?
চোখে জল চলে আসে অনিন্দিতার। সে হাত বাড়িয়ে ফুলটি নিয়ে মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করে,‘ এটা কি আমার টবের ফুল?’
‘হ্যা।’
‘কী দরকার ছিল ফুলটি ছেঁড়ার?’ অনুচ্চ বন্ঠ অনিন্দিতার।
‘না ছিঁড়লেও এটি একদিন ঝরে পড়ত। তুমি কি একটি ফুল সারাজীবন টবের গাছে জীবিত রাখতে পারবে?’
‘তবু।’ অনিন্দিতার চোখের সামনে পুরনো দিনগুলো চেষ্টনাট গাছের পাতার মতো স্মৃতি হয়ে ঝরে পড়ছে। বিয়ের পরপর ইলিয়াস প্রায়ই ওকে ফুল এনে দিত। ঢাকায় তখন অত ফুলের বাহার ছিল না। হাইকোর্টের সামনে থেকে সংগ্রহ করে আনতে হত। সেই ফুল নিয়ে ওদের সে কি উচ্ছ্বাস ! দুজন দুজনার দিকে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাত। এখন সেসব কথা জোর করে মনে করতে হয়।
ছোট নদীর ধারে একদন্ড দাঁড়িয়ে তখন যে আনন্দ মিলত এখন অনেক বড় বড় উপহার সামগ্রী হাতে পেয়েও সেই অকৃত্রিম আনন্দ আর পাওয়া যায় না।
ভেতরকার সেই উচ্ছ্বাসটুকু যেন উবে গেছে। এখন ধার করে আনন্দ কিনতে হয়। নিজের ভেতর আর আপনা আপনি তৈরি হয় না !
এতো বছর পর আজ ইলিযাসের হাতে ফুল দেখে সেসব কথাই কেবল মনে হচ্ছে ওর।
একটুখানি হতচকিত , কিঞ্চিৎ অভিভূত অনিন্দিতা!
দীর্ঘ অদর্শনের পর আজ যেন পুরনোরূপে প্রিয় কোনো মানুষের দেখা পাওয়া গেল।
‘চল বেডরুমে চল। বসে গল্প করি। ’ ইলিয়াস বলে।
‘ নীচের উঠোনে রোমিও-জুলিয়েট চলছিল। দেখবে না?’
‘আমি তোমাকে চন্ডিদাস -রজকিনীর প্রেমপর্ব দেখাব । চলো। ’ বলে ইলিয়াস ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢোকে। তারপর ডাইনিং টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে অনিন্দিতাকে বলে,‘ কিচেনের ভেতর তাকাও। ’
সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার চোখ পড়ল সেদিকে। সে দেখতে পেল - ওর কাজের বুয়া সালেহা কিচেনের জানালা ধরে দাঁত বের করে বেঢপ রকমের হাসি হাসছে। মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে কিছু অঙ্গভঙ্গিও করছে। একবার মনে হল মোটা কোমর দুৃলিয়ে নেচে উঠল যেন সে।
অনিন্দিতার ঠোঁটের ডগায় ফিক করে এক টুকরো হাসি হেসে এসে গেল ।
ইলিয়াস ওর কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলে উঠল‘, এবার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাও। ’
ডাইনিংরূম থেকে তাকালে নজর সরাসরি ওদের কলোনির বাইরের রাস্তায় গিয়ে হোঁচট খায় । স্পষ্ট চোখে পড়ে সবকিছু। ওখানে মূক ও বধিরদের জন্যে একটি স্কুল রয়েছে। জায়গাটা ঘিরে রয়েছে আজস্র গাছগাছালির ছায়া , এ বৃক্ষভূক নগরে এমন ওয়েসিস মেলা সত্যি কঠিন । জায়গাটা যেহেতু কানাগলি সেহেতু বেশ নিরিবিলি আর নির্জনও বটে।
সেখানে একটা গাছের তলায় এক রিক্সাওলা বেশ আয়েশ করে বসে রয়েছে রিক্সার সীটে। পায়ের উপর ঠ্যাং, হাতে ধরা সিগারেট। ডান হাতে ঝুলানো চেন-ওলা ঘড়ি। গায়ে একটা কালচে রঙের গেঞ্জী আর লুঙ্গি, মাথায় ক্যাপ। সিগারেটে এক একটি টান দিচ্ছে আর মাথা বেঁকা করে তাকাচ্ছে সালেহার জানালা বরাবর।
বয়স সালেহার চেয়ে কম হবে বলেই অনিন্দিতার মনে হল।
সালেহার এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ে হয়েছে। একটি গ্রামে থাকতে মাত্র বার বছর বয়সে সম্পন্ন হয় আর বাকি দুটি ঢাকায় এসে আপনা-আপনি জুটে যায়।
সর্বশেষ জামাই বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়ার ভ্যান গাড়ি চালাত। বাঁজা বলে সে-ও ওকে ত্যাগ করে।
এখন এই রিক্সাওলাটি এসে জুটেছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় ওদের। কিঞ্চিৎ বিটকেলে লাগলেও অনিন্দিতার এজন্য ভাল লাগছে যে এতকিছুর পরও সালেহা ফের স্বপ্ন দেখতে চাইছে। ভারি কোমর দুলিয়ে , হেসে এবং নানারকমের অঙ্গভঙ্গি করে সে যেন এই কথাটাই বলছে বারবার!!
‘চলো। চন্ডিদাস- রজকিনী দেখা হল? ’ বলে ইলিয়াস ওকে বেডরুমে নিয়ে যায়।
দুজনার মুখে হাসির ছটা।
ওরা দুজন গিয়ে দাঁড়ায় বিছানার সামনে ।
ওদের বিছানার কাছে দেয়ালে টাঙানো রয়েছে দুজনার অনেকদিনের পুরনো হাসিখুশি বাধানো একটি ফটো।
ইলিয়াস বলে ,‘ মনে পড়ে? ’
অনিন্দিতা উত্তর দেয়,‘ হারাধন ফিরে পেলে এরকমই হাসিখুশি লাগে সবাইকে। ’ বলে ইলিযাসের চোখে চোখ রাখে।
‘তারিখটা মনে আছে?’ ইলিয়াস স্ত্রীকে বাজিয়ে দেখে।
‘১৯৭১ সনের ১৮ ডিসেম্বর। সূত্রাপুরের আমার বাবার বাসায় এই ছবিটা তুলেছিল নয়ন ভাইয়া। তোমার দাড়ি-টাড়ি ছিল। সেগুলো কামিয়ে তারপর আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে। ’
‘নয়ন ভাইয়া খুব যত্ন করে ছবিটা তুলেছিল, তাই না?’
‘হু। কার ভাই দেখতে হবে না?’
‘আচ্ছা তুমি ধরেই নিয়েছিলে যুদ্ধ থেকে আমি আর ফিরব না? তখন কী ভাবতে ? মরে গেছি আমি?’
‘জানি না অত। ’ অনিন্দিতার গলা থেকে সোহাগ ঝরে। কেন যেন অন্যরকম লাগছে সবকিছু। প্রতিদিনের গতবাধা অলস সময় থেকে ভিন্নতর ; মাত্র একটি ফুল ওকে বদলে দিয়েছে আমূল। শুকিয়ে থাকা নদী যেন সহসা ফুলে ফেঁপে বর্ষার ভরা নদীতে পরিণত হতে চাইছে!
‘এই ছবিটার দিকে তাকালে আজ কাল আমার অন্য রকম অনুভূতি হয় অনি। বলব?’ ইলিয়াস বলে।
‘বলো।’
‘ আজকাল কেন যেন প্রায়ই মনে হয় যদি তখন যুদ্ধের মাঠে শহীদ হতাম তাহলেই যেন ভাল ছিল ! ’
‘কেন?’ চোখ ঘুরিয়ে সারসরি স্বামীর দিকে তাকায় অনিন্দিতা। চোখে মুখে বিস্ময়। একজন পূর্ণ সুখী মানুষের হঠাৎ এমন মানসিক অবক্ষয় কেন অনিন্দিতা তা বুঝতে পারে না।
‘আমি সারাজীবন তোমার হিরো হয়ে থাকতে পারতাম। তোমার ভালবাসা কখনোই কমত না। জাতি শ্রদ্ধা জানাত। সমাজ মাথা নত করত। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সবসময় সবার আদর্শ হিরো হতে পারতাম। এই বৈচিত্রহীন পোকা মাকড়ের জীবন আর ভাল লাগে না। সত্যি ভাল লাগে না আমার!! ’! আবেগের অতিশয্য ওকে এতটাই আগ্রাসী করে তোলে যে ওর চোখ দুটো কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসে ।
ইলিয়াস চোখ থেকে চশমা খুলে মোছার চেষ্টা করে। এ যেন কাচ মোছা নয়; অন্য কিছু।
‘ক্লান্তি এসে গেছে , না? একটা কাজ করবা?’
‘কি?’ চশমার কাচ মুছতে মুছতে উত্তর দেয় ইলিয়াস।
‘আমরা কতক্ষণ এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি চল। দেখো, আমাদের ভেতর প্রেম এসে যাবে আগের মতন। তাকাও।’
ইলিয়াস মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। একটু বাদে ফটো বরাবর ওর কান্না -ঝাপসা চোখ দুটো তাক করে । ইলিয়াসের চোখের পাতা আর পড়ে না। তীক্ষè অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে পরখ করতে থাকে জীর্ণ ছবিটা।
‘শুধু তাকালে হবে না। ফিল কর , ফির করার চেষ্টা কর সেই সময়। ’ অনিন্দিতা বিড় বিড় করে ইলিয়াসকে বোঝায়।
ওরা এবার দুজন মিলে সত্যি সত্যি ফটো-ফ্রেমটা বরাবর দৃষ্টি স্থির করে রাখে এবং অপেক্ষা করতে থাকে কখন ওদের বোধের গভীরে শ্রাবণধারা বইবে।
ওরা তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চোখের পাতায় ব্যথা ধরে যায়।
কিন্তু নিষ্ফলা মাঠে বৃষ্টি আর নামে না!!