Pages

''অতঃপর ভালবাসা''

                                                                                                                                                                              অনেক্ষন ধরে এলার্ম বেজে চলেছে। প্রথমে লাবণ্যর মনে হল এলার্ম এর ঘটনা সে স্বপ্নে দেখছে। কিন্তু কর্কশ আওয়াজটা আরও বাড়তেই বালিশের নীচ থেকে মোবাইল বের করে এলার্ম অফ করল সে। বুঝতে পারছে না এত তাড়াতাড়ি বাজল কেন এলার্মটা । মনে হচ্ছে এই মাত্র ঘুমিয়েছে । না-কি , ভুল করে সকাল সাতটার পরিবর্তে ভোর চারটায় এলার্ম দিয়ে রেখেছে? এলার্ম-ই বা দিয়ে রেখেছিল কেন মনে করতে পারছে না । মনে করতেও চায় না সে । সকালে ঘুম থেকে ওঠার এই কাজটা খুবই অপছন্দ লাবণ্যর । তাই আবার ঘুমিয়ে পড়ল । কিছুক্ষন পর বিপ বিপ শব্দে আবার মোবাইল বেজে উঠে । মহা বিরক্তি নিয়ে লাইন কেটে দেয় লাবণ্য । বালিশ কানে চেপে ঘুমানোর চেষ্টা করে আবার । পাঁচ মিনিট বিরতির পর ফোনটা আবার বাজতেই ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলের দিকে তাকায় । তার বান্ধবী শর্মার ফোন । এতক্ষনে মনে পড়েছে এলার্ম বাজার কারন । সকাল আটটার মধ্যে কলেজে পৌঁছার কথা । কলেজ থেকে আজ তারা পিকনিকে যাবে গাজিপুর । লাবণ্য যে ঘুম পাগল তা শর্মা ভাল করেই জানে । তাই কাল রাতেই বার বার বলছিল মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখতে । এই শর্মা মেয়েটাকে প্রচন্ড ভয় পায় লাবণ্য । পান থেকে চুন খসলেই চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে এই মেয়েটা । এজন্য শর্মার কল দেখেই চট করে আনসার করে লাবণ্য । ফোনের ওপাশ থেকে শর্মা বলল ''কী-রে ,তুই কই ? বের হয়েছিস ? না-কি এখনও বেডে ? ভয়ে ভয়ে লাবণ্য বলল '' উফফ্ ,এত প্রশ্ন একসাথে করেছিস ,কোনটার উত্তর দেব ? তারপর মিথ্যা বলল ,হুম্ উঠে গেছি অনেক আগেই এইতো রেডি হচ্ছি ।-''ওকে ,গুড । এখন ফোন রেখে তাড়াতাড়ি বের হন ম্যাডাম । সাতটা বেজে গেছে । কলেজে আসতেই তো আরও ঘন্টা খানেক লাগবে''। -''হুম্ ,রাখছি এখন ''। ফোন রেখেই ঘড়ি দেখল লাবণ্য । সাতটা বেজে গেছে । কিন্তু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার । কেন যে ওদের সাথে পিকনিকে যেতে রাজি হয়েছিল । এখন মনে হচ্ছে পিকনিকের চেয়ে সকাল বেলার এই ঘুমই ঢের ভাল । কিন্তু সে না গেলে শর্মা, হেলেন ,সানজিদা,নাদিয়া ওরাও কেউই পিকনিকে যাবে না ,সাফ বলে দিয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়ল । উঠেই তাড়াহুড়ো করে হাত মুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে গেল । অন্য দিন হলে তৈরী হতে তার অনেক সময় লাগত । কোন ড্রেস পরবে , ড্রেসের সাথে কোন জুয়েলারী মানাবে , কোন লিপিষ্টিক মানান সই হবে ,জুতা কোনটা পরবে এসব ঠিক করতে করতেই অনেক সময় লাগে তার । ভাগ্যিস ,কাল রাতেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছিল , তাই আধা ঘন্টার মধ্যে তৈরী হতে পেরে নিজে নিজেই কিছুটা অবাক হল এত জলদি তৈরী হতে পেরে । তারপর শেষবারের মত আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল । নাহ্ ,সবই ঠিক আছে । পারফেক্ট লাগছে । ঘড়ি দেখল আবার । সাড়ে সাতটা বাজে । সময় নেই , নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়ে লাবণ্য ।




গাড়িতে সবাই আধ ঘন্টা ধরে বসে আছে । গাড়ি থেকে কাউকেই নামতে দিচ্ছেন না ম্যাডাম । অথচ এই ছাড়ছে ছাড়ছে বলে গাড়িও ছাড়ছে না । এভাবে বসে থাকতে একদম ভাল লাগছে না লাবণ্যর । ক্ষিধায় পেট চুঁ চুঁ করছে তার । কিছু একটা খাওয়ার জন্য নামতে চাচ্ছিল কিন্তু ম্যাডাম নামতে দিচ্ছেন না । উপায় না পেয়ে ব্যাগে রাখা ক্যানডিবার খেতে শুরু করে সে । ক্যানডিবার তার পছন্দের একটা খাবার । সব সময় ব্যাগে ৩/৪ টা থাকেই । কিন্তু রাগের কারনে এখন এগুলো খেতেও ভাল লাগছে না । ফিস ফিস করে সে ঐ নবাবজাদার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে যার জন্য গাড়ি ছাড়তে দেরী হচ্ছে । তার মাথায় ঢুকছে না একজনের জন্য কেন সবাইকে সাফার করতে হবে ? অবশেষে সাহেবজাদা এলেন বেলা দশটায় । মেয়েরা সবাই মহা বিরক্তি নিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে । কারো কারো ভাব এমন যে পারলে থাকে একচুট ধোলাই দেয় । পরে যখন জানল তাদেরই ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের ঐ ছাত্র তাদের খাবারগুলো প্যাকেট করে আনতেই এত দেরী হয়েছে তখন সবাই কিছুটা শান্ত হয় । গাড়িতে উঠে মাউথপিস হাতে নিয়ে দেরীর জন্য ক্ষমাও চায় হিমেল । গাড়ি চলতে শুরু হলে শর্মা লাবণ্যকে বলল এবার তো মুড অন কর ''ময়না পাখি'' । আমার কী দোষ ? আমি কি জানতাম এত দেরী হবে ? শর্মা প্রায়ই লাবণ্যকে ময়না পাখি বলে ডাকে । এখন এই ডাক শুনে হেসে ফেলে সে । বলে ময়না পাখি ডাক শুনে তো আর পেট ভরছে না আমার । পেটের ক্ষিধা তো বেড়েই চলেছে । শর্মা বলে একটু ধৈর্য্য ধর সোনা । তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলে ময়না পাখি এতক্ষন টেনশনে তো খেয়ালই করি নি , তোকে তো আজ একদম ''নীল পরীর ''মত লাগছে রে !! ছেলেরা সবাই তো টাসকি খেয়ে যাবে আজ । তারপর হিমেলকে দেখিয়ে বলে হিমেল ভাইকেও অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে , দেখ । শর্মার কথায় এই প্রথম হিমেলের দিকে ভাল করে তাকায় লাবণ্য । সত্যি অনেক হ্যান্ডসাম ছেলেটা । কিন্তু কেমন যেন ভাব ধরে ম্যাডামের পাশে বসে আছে । শর্মার কথার উত্তরে লাবণ্য বলল তুই উনাকে চিনিস নাকি ? ''হ্যাঁ ,আমাদের ইংরেজীরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ''। লাবণ্য আর কোন কথা বলল না । শর্মা বকবক করেই যাচ্ছে । কিছুই শুনছে না লাবণ্য । সে হেডফোন কানে লাগিয়ে ফুল ভলিয়মে শুনছে richard max এর ''Oceans apart day after day and I slowly go insane........right here waiting for u '' এই গানটি । ঘন্টা খানিকের পথ পাড়ি দেয়ার পর লাবণ্যর পেট আবার মোচড় দিয়ে উঠে । এখনই তাকে কিছু খেতে হবে তা না হলে আজকে সবাইকে পিকনিক বাদ দিয়ে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হবে । বিষয়টা ম্যাডামকে জানাতেই তিনি এবং হিমেল বলল এখন কিছুতেই গাড়ি থামানো যাবে না । এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে । এদিকে ক্ষিধার জালায় লাবণ্যর অজ্ঞান হবার জোগাড় । আগেও একবার বাসায় আপুর সাথে রাগ করে না খেয়েই কলেজে গিয়েছিল শেষে কলেজে মাথা ঘুরে পড়ে যায় ।এখন কিছুটা ইচ্ছে করেই অসুস্হ হওয়ার ভান করে । খুব জেদী মেয়ে সে । যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে । যখন দেখল ম্যাডাম ও হিমেল তার খাবারের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না তখন ইচ্ছে করেই এ পদ্ধতি বেছে নেয় । শেষে বাধ্য হয়ে গাড়ি থামিয়ে একটি বিরিয়ানীর প্যাকেট দেয়া হয় তাকে । বাকি পথটুকু খুব ভালই কাটে লাবণ্যর।

গাজীপুর প্রিয়াঙ্গন পিকনিক স্পটে নেমে হালকা নাস্তা শেষে সবাই যে যার মত ঘুরতে থাকে । লাবণ্য,শর্মা,সানজিদা ,নাদিয়ারা আলাদা হয়ে ইচ্ছে মত ছবি তুলল । এটি তাদের সবারই খুব পছন্দের একটি কাজ । ঘোরাঘুরি শেষে খাবার খাওয়ার সময় লাবণ্য খেয়াল করল সবাই তার দিকে ঘন ঘন তাকালেও হিমেল তাকায় নি একবারও । কী এমন দেমাগ তার ? এ চিন্তাটাই লাবণ্যর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে । সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক হিমেলের দেমাগ ভাঙ্গতে হবে । ফিরতি পথে গাড়িতে বসেই এ বিষয়ে মোটামুটি একটা পরিকল্পনাও করে ফেলে লাবণ্য । সে জন্য যাবার সময় কিছুটা খারাপ লাগলেও এখন এই ফিরতি জার্নিটা বেশ ভাল লাগছে । গাড়িতে রেফেল ড্র আর একেক জনের সুরে বেসুরে গাওয়া গানের আয়োজনের মাঝে কখন যে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে টেরই পায় নি । কিছুটা ভীষন্ন মনে গাড়ি থেকে নেমে একে একে সবাই বিদায় নিতে থাকে । হিমেল তখনও গাড়ির ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত । আবার গাড়িতে ফিরে আসে লাবন্য। উঠেই গাড়িতে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। সেটা দেখে হিমেল এগিয়ে এসে জানতে চাইল , ''কিছু কি হারিয়ে ফেলেছেন ''? ''হুম ,আমার মোবাইলটা খুঁজি পাচ্ছি না । গাড়িতে কোথাও পড়ে গেছে হয়তো । একটা কল করে দেখবেন ,প্লিজ ''। ''ঠিক আছে ,নাম্বার বলেন ''। নাম্বার বলার পর অনেকবার রিং করে হিমেল । কিন্তু গাড়িতে কোথাও ফোন বাজছে না । বাজার কথাও না। লাবণ্য ফোনটা শর্মার কাছে রেখে এসেছে । কৌশলে হিমেলের নাম্বারটা নেয়ার জন্য তার এই ফোন হারানোর নাটক করা ।


ক্লাসের পর ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়েই বরফ গলা খাচ্ছে লাবণ্য আর শর্মা । প্রায় প্রতিদিনই এই জিনিসটা খায় দুজনে । তারা অপেক্ষা করছে হিমেলের । তার সাথে ভাল করে পরিচিত হতে চায় লাবণ্য । শর্মা মোটামুটি ভাবে হিমেলকে চেনে । হিমেলও শর্মাকে চেনে । তাই লাবণ্য শর্মাকে নিয়ে এসেছে তাকে হিমেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে । একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে তাই একজন আরেকজনের সাথে পরিচয় থাকাটা ভাল । ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাবার পথে তাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আগ বাড়িয়ে কথা বলে হিমেল । শর্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল - ''কেমন আছ ''? -''ভাল ,উত্তর দিল শর্মা । আপনি ''? ''হুম,ভাল । ও হ্যাঁ আপনার মোবাইলটা পেয়েছেন ? লাবণ্যর দিকে চেয়ে জানতে চাইল হিমেল '' । ''নাহ্ , কোন কিছু একবার হারালে আর পাওয়া যায় না - কি ? আর হ্যাঁ , আমাকে আপনি আপনি করবেন না তো !! আমি তো আপনার জুনিয়র তাই তুমি করে বললে খুশি হব''। '' তা না হয় হবে , কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু না খেয়ে আর কথা বলতে পারছি না । খুব ক্ষুধা লেগেছে । চল্ ,ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেতে খেতে কথা বলি । অবশ্য যদি তোমাদের কোন আপত্তি না থাকে ''।
- '' আমাদের ক্লাস তো শেষ । বাসায়ই যাচ্ছিলাম । চলেন বসি ''।

ক্যান্টিনে বসে সিঙ্গারা , চা খেতে খেতে হিমেল বলল এতক্ষন ধরে কথাই বলে যাচ্ছি অথচ তোমার নামটাই তো জানা হল না । এবার কথা বলল শর্মা । আরে !! সত্যি তো । আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্বটাই তো হল না এখনও। ok ,আমি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি ,ও হচ্ছে লাবণ্য আমার close friend.আর লাবণ্য ,উনি হচ্ছেন হিমেল ভাই আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র । শর্মাকে বাঁধা দিয়ে হিমেল বলল থাক্ থাক্, আমাকে মেধাবী বলে আর মেধাবীদের অপমান কর না । এরপর আরও কিছুক্ষন কথা বলল তারা । যাবার সময় একটি সুন্দর পিকনিক আয়োজনের জন্য হিমেলকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললো না লাবণ্য ।


রাতে হিমেলের নাম্বারে ফোন করল লাবণ্য । ওপাশে রিসিভ হতেই বলল, - ''কেমন আছেন ''? ''sorry, কে বলছেন? '' ''আমি মানুষ, এটাই কী কথা বলার মত পরিচয় হতে পারে না ''। '' দেখুন ,পরিচয় পেলে কথা বলতে সুবিধা হয় ''। ''পরিচয় না হয় পরে জানবেন। আচ্ছা ,আমি যদি মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করি আপনি কি বিরক্ত হবেন ''? ''কাউকে না চিনলে তো তার সাথে কথা বলতে খুব ভাল লাগার কথা না ''। ''ঠিক আছে ,অন্য দিন না হয় পরিচয় হবে । আজ রাখি। ''

কলেজেও তাদের আড্ডা চলতে থাকে রীতিমত । তিনজনই খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেছে এখন । ক্লাস শেষে প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা দেয়া যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে । হিমেলকে প্রথমদিন লাবণ্যর যে রকম দেমাগী মনে হয়েছিল এখন আর সেরকম মনে হয় না । আড্ডায় সে এখন কথার ফুলঝুরি ফুটায় । রাতেও ফোনে কথা বলার সময় ফটফট করে কথা বলতে থাকে । যদিও ফোনে হিমেলকে এখনও আসল পরিচয় দেয় নি লাবণ্য কিন্তু কদিন কথা বলার পর হিমেল ঠিকই ধরতে পারে ব্যাপারটা । বুঝতে দেয় না লাবণ্যকে । ক্রমেই সে দূর্বল হয়ে পড়ে লাবণ্যর প্রতি । কলেজের বেশির ভাগ সময় লাবণ্যর সাথে কাটলেও বাসায় ফেরার পরই অস্হির হয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন লাবণ্যকে ফোন করবে , কখন তার মিষ্টি কথা শুনবে । ফোন রেখে দিলেই বিভোর হয়ে অপেক্ষায় থাকে পরদিন কলেজ সময়ের । তার ধারনা লাবণ্যও একইভাবে তাকে মিস করে (না-কি করে না)। কিন্তু কেউই কাউকে বলতে পারে না ভাললাগার সেই চিরন্তন ''ভালবাসি '' কথাটি ।

কিছুদিন ধরে কিছুই ভাল লাগছে না লাবণ্যর । কেবলই অস্হির লাগছে । কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কারো সাথে । তাই মোবাইল অফ করে রেখেছে । কলেজেও যায় নি দুই তিন থেকে । এমন কেন হচ্ছে তার ? বার বার কেন হিমেলের কথাই মনে পড়ছে । এটাই কি তাহলে প্রেম ? নাহ্ এমন কেন হবে ? সে তো সত্যি সত্যি ভালবাসেনি হিমেলকে । শুধু তাকে পাত্তা না দেয়ার শাস্তি দিতে চেয়েছে হিমেলকে । কিন্তু এখন যেন সে নিজেই শাস্তি পাচ্ছে । তার চিন্তা চেতনা সব একই জায়গায় আটকে আছে। ধ্যুৎ ,কিচ্ছু মাথায় আসছে না । ভেবেছিল কদিন কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে হিমেলের সাথে দেখা না করলে বা ফোনে কথা না বললে সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা । আরও বেশি বেশি মনে পড়ছে । নিজের রুমে বসে এসব চিন্তা করছে লাবণ্য । এ সময় রুমে ঢুকে শর্মা । লাবণ্যকে দেখা মাত্রই ইচ্ছে মত ঝাড়ি দেয় টানা দশমিনিট । এক নিঃশ্বাসে জানতে চায় এই কয়দিন কলেজে যায় নি কেন ? ফোন বন্ধ কেন ? তিনদিনে একবারও তাকে ফোন করেনি কেন ? হাবিজাবি আরও অনেক কথা । শর্মাকে সব খুলে বলে লাবণ্য । হিমেলকে শাস্তি দিতে চায় লাবণ্য । সেটা শর্মা আগে থেকেই জানত । কিন্তু এদিকে লাবণ্যর যে বেহাল দশা সেটা আজই প্রথম জানল । সব শুনে বলল হিতে বিপরীত হতে পারে সেটা আগেই বলেছিলাম । কিন্তু তোর জেদের কারনে আমার কথা শুনলি না । এখন নিজেই কষ্ট পাচ্ছিস । এদিকে হিমেল ভাইয়ের অবস্হা ও তো বেশ খারাপ দেখলাম । দুদিন ধরে দেখছি ক্লাস না করেই আমাদের কমন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । সিগারেট টানে একটার পর একটা । যতবারই আমাকে দেখেছে ততবারই তোর কথা জানতে চেয়েছে । তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে শর্মা বলল পরশু দিনের প্ল্যান কী ? ''কেন ? পরশুদিন কি স্পেশাল কিছু ''? ''তোর জন্মদিন, তুই নিজেই ভুলে গেলি '' ''ও হ্যাঁ তাই তো । আসলে লাবণ্য ভূলেই গিয়েছিল তার জন্মদিনের কথা । শর্মার কথার উত্তরে বলল না-রে , কিচ্ছু ভাল লাগছে না । এবার জন্মদিন পালন করব না'' ''তা কী করে হয় ! এক কাজ করি আমরা সব বান্দবীরা মিলে না হয় তোর এই জন্মদিনটা আমাদের বাসায় ছোট পরিসরে পালন করি । শনিবার-ই তো তোর জন্মদিন আর ঐ দিন বাবা মা গ্রামের বাড়িতে যাবেন । কাজেই বাসাও ফাঁকা থাকবে। লাবণ্য বারবার না করলেও শর্মার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় । কথা হয় শনিবার বিকাল পাঁচটার মধ্যে শর্মার বাসায় পৌঁছে যাবে লাবণ্য। বিদায় নেয়ার সময় শর্মা বলে ঐ বিষয়ে হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিস না । চোখ বন্ধ করে নিজের মনের সাথে কথা বল । মন যেটা বলে সেটাই কর ।

ক্লাস থেকে বের হতেই শর্মা দেখল দরজার সামনে হিমেল দাঁড়িয়ে । কিছুটা উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছে তাকে । শর্মাকে দেখেই বলল , লাবণ্যর কী হয়েছে ? কদিন ধরে কলেজে দেখছি না যে ? তুমি কি কিছু জানো ? এক পর্যায়ে লাবণ্যকে যে সে ভালবেসে ফেলেছে তা খুলে বলে । তারপর একরকম কান্না জড়িত কন্ঠে শর্মাকে অনুরোধ করে , যে কোন উপায়ে লাবণ্যর সাথে তার দেখা করার সুযোগ করে দিতে । সব শুনে শর্মা বলে আমি চেষ্টা করব।

আজ শনিবার। ২৮এপ্রিল । লাবণ্যর জন্মদিন । সারাদিন ধরে বিছানায় শুয়ে আছে সে । কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না । কিন্তু শর্মার পোগ্রামের কথা মনে পড়তেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়ে । বিকাল পাঁচটার কিছু পরে শর্মার বাসায় পৌঁছায় লাবণ্য । দরজা খুলাই ছিল । ভেতরে ঢুকে কাউকেই দেখতে পেল না সে । ঘরের ভিতরটাও আবছা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে । এর মাঝেই দেখল টেবিলের উপর ''শুভ জন্মদিন লাবণ্য '' লেখা বেশ বড় সাইজের একটি কেক । রুমের চারদিকে ভাল করে তাকাতেই ঘরের কোনায় অন্ধকারে কেউ একজনকে বসে থাকতে দেখে। কিছুটা ভয় পেয়েই রুমের বাতি জালায় সে। এমন সময় পেছনে হঠাৎ শুনতে পায় ''শুভ জন্মদিন । তোমাকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভ কামনা ''। কন্ঠটা তার খুবই পরিচিত । হ্যাঁ ,পেছনে তাকিয়ে হিমেলকেই দেখল । তাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ে লাবণ্য । বিশ্বাস করতে পারছে না হিমেল এখানে আসল কেমন করে । নিশ্চয়ই শর্মার কাজ । ''কি অবাক হলে ''? হিমেলের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে লাবণ্যর । উত্তরে কিছু বলতে পারে না । হিমেলকে দেখে সে এতটাই অভিভূত হয়েছে যে মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না । হিমেল আরও কিছুটা এগিয়ে লাবণ্যর ঠিক সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসে । একটি লাল গোলাপ লাবণ্যর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ''প্রথমত আমি তোমাকে চাই , দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই ,তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই ,শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই ''। কথাটা শুনে চোখে পানি এসে যায় লাবণ্যর । সে-ও মনে প্রানে ভালোবাসে হিমেলকে । অন্তঃত গত কদিনে সেটা উপলব্ধি করেছে প্রবলভাবে । এই কদিন সে যতবারই চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে প্রশ্ন করেছে হিমেলকে সে ভালবাসে কি-না ,ততবারই উত্তর পেয়েছে অনেক বেশি ভালবাসে । আজ জন্ম দিনে নিজের ভালবাসাকে পেয়ে তাই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে তার চোখ । নির্বাক হয়ে লাবণ্য শুধু হিমেলের দুটি হাত শক্ত করে ধরে থাকে । পৃথিবীটাকে যেন এখন আরও বেশি সুন্দর আর আনন্দময় মনে হচ্ছে তার কাছে । মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করে ঘরটায় স্বর্গীয় সুখ নেমে এসেছে । সুখের অতিশয্যে তারা দুজন এতটাই মগ্ন ছিল যে ,কখন রুমে শর্মা , হেলেন,সানজিদা,নাদিয়া এসে ঢুকেছে টেরই পায় নি । সবাই যখন একসাথে বেশ বড় আওয়াজ করে লাবণ্যকে জন্মদিনের উইস করল তখনই যেন সম্বিত ফিরে পায় দু'জনে । তারপর শর্মা বলল লাবণ্য এবার কি দয়া করে কেকটা কাটবি ? তার কথায় কেক কাটে লাবণ্য এবং সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানায় তাদের । তারপর অনেক হৈ হুল্লোড় করে স্বন্দ্ব্যাটা পার করে তারা । সেই সাথে লাবণ্য'র কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় জন্মদিনের এ ক্ষনটি ।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন