Pages

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট

                                                                                                                                                                                                                                         এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট




পূর্ণিমা রাতে সাম্প্রতিককালের এক কবি গ্রেভইয়ার্ডে ঢুকে পড়েছেন। পূর্ণিমা-মায়ায় তিনি এক একটি সমাধির কাছে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে সমাধিস্থ মানুষের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলার চেষ্টা করেন — ‘এই যে শুনতে পাচ্ছেন…শুনছেন আপনি…আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি…উঠে আসুন উপরে…আপনার সাথে আমার কথা আছে…অনেক কথা। আর এইভাবে বোবার মতো ঘুমিয়ে থাকবেন না। উঠে আসুন।’ না কেউ তার কথা শোনে না। তাই তিনি সমাধি থেকে গজিয়ে ওঠা লতায় ধরা বিচিত্র সব ফুল স্পর্শ করে গন্ধ নিতে থাকেন এবং এক সময় সমাধিফুলের গন্ধে দশাগ্রস্ত ঘোরলাগা কণ্ঠে এই নাট্যকথার সূচনা করেন –
কবি : গ্রেভইয়ার্ড মানে সমাধিক্ষেত্র। দুটি নামই বড় ব্যঞ্জনাময়। আর এখানকার পূর্ণিমা রাত আমার খুব প্রিয়। এখানে নেশা ছাড়াই ফুলের গন্ধে মাতাল হওয়া যায়। আমি জানি, সমাধিতে যে ফুল ফোটে — তার পুষ্পলতার শিকড় সমাধি তলের ঘুমন্ত মানুষটির দেহসার থেকে রসদ নিয়েই উপরের বাতাসে গন্ধ ছড়ায় — এক একটি জীবন্ত মানুষের গায়ের গন্ধ যেমন এক একরকম — এক একটি সমাধি থেকে ভেসে আসা ফুলের গন্ধও তেমনি আলাদা আলাদা। আমি তাই এই রাতে সমাধিক্ষেত্রের মাটির গভীরে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকা মানুষ আর এই পৃথিবী পৃষ্ঠের জাগ্রত মানুষকে একসঙ্গে মিলাতে পারি। আমার প্রেমগান জীবিত ও মৃতের মাঝখানে কোনো বিভেদ রচনা করে না। আমার প্রেমগান জীবিত-মৃত সকলকেই লক্ষ করে —
প্রেম-পাথারে যে সাতারে
তার মরণের ভয় কি আছে
নিষ্ঠা-মনে প্রেম করিয়ে
এক মনে বসে রয়েছে॥
শুদ্ধ-প্রেম রসিকের ধর্ম
মানে না বেদ-বিধির কর্ম
রসরাজ রসিকের ধর্ম
রসিক বই আর কে জেনেছে॥
শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ
পঞ্চতে হয় নিত্যানন্দ
যার অন্তরে সদানন্দ
নিরানন্দ জানে না সে॥
গান গাইতে গাইতে কবি যখন গ্রেভইয়ার্ডের আরও গভীরে ঢুকে যেতে থাকেন ঠিক তখনই সে গ্রেভইয়ার্ডের ভেতর থেকে রোমিও এবং জুলিয়েট জুটি প্রকাশিত হন। তারা কবিকে অনুসরণ করে কণ্ঠে গান তুলে নিতেই তিনি চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকান —
কবি : কে কে?
রোমিও : আমি রোমিও।
কবি : কিন্তু আমি যে রোমিওকে জানি সে তো বহুকাল আগে…
জুলিয়েট : আত্মহত্যা করেছে।
কবি : হ্যাঁ।
জুলিয়েট : সত্য কথা । কিন্তু এও তো সত্য আত্মহত্যার ভিতর দিয়ে আমরা প্রেম ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছি। যতদিন মানুষ আর তার হৃদয় থাকবে ততদিন আমাদের প্রেম পরম দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকবে।
কবি : তুমি নিশ্চয় জুলিয়েট?
জুলিয়েট : ঠিকই ধরেছেন।
কবি : কিন্তু…তোমরা…এইভাবে উপরে উঠে এলে কী করে!?
রোমিও : আপনার মিষ্টি মধুর সঙ্গীতে। আর একটু আগেই আপনি যে আমাদের সমাধিক্ষেত্রের ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে মৃত আর জীবিতদেরকে একসঙ্গে মেলালেন। আপনার এমন মিলনে আমরা কিন্তু বেশ খুশি হয়েছি…তাই না জুলিয়েট?
জুলিয়েট : হু…খুব খুশি হয়েছি।
রোমিও : এখন বলেন — আমাদেরকে দেখে আপনি খুশি হননি?
কবি : না। আমি তোমাদের ঘৃণা করি। তোমাদের প্রেমকীর্তিকেও আমি অস্বীকার করি।
রোমিও : কী বলতে চান?
কবি : কী আর বলবো! প্রেমক্ষেত্রে তোমরা উভয়েই ছিলে চঞ্চল ও অস্থির। অস্বীকার করতে পারো রোমিও — এই জুলিয়েটকে দেখার আগে — তুমি যে রোজালিনের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলে?
রোমিও : কেন? একথা তুলছেন কেন?
কবি : কেন তুলবো না! সমাধি থেকে আজ যে শুধু জুলিয়েটের হাত ধরে উঠে এসেছো! এখন বলো — রোজালিনকে তুমি কোনোদিনই বাসোনি ভালো!
রোমিও : না, তা বলতে পারবো না — আমি সত্যিই তাকে অন্তর থেকে কামনা করেছিলাম, কিন্তু সে আমার…আমার জীবনে সে একটা দুঃসহ কষ্ট ছিল…।
জুলিয়েট : ছি রোমিও ছি! আমি তোমার মতো একটা মিথ্যুক প্রতারকের জন্যে আত্ম-উৎসর্গ করেছি! ছি!
রোমিও : জুলিয়েট, জুলিয়েট, শান্ত হও।
জুলিয়েট : না, তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না।
রোমিও : কেন জুলিয়েট? আমি কি তোমাকে ভালোবাসি নাই? আমাদের প্রেম কি সত্য নয়?
জুলিয়েট : তবে, কেন তুমি তোমার জীবনের এমন সত্য আমার কাছে গোপন করেছিলে? কেন? এরকম ছলনা তুমি আমার সঙ্গে না করলেও পারতে?
রোমিও : না জুলিয়েট, আমার কোথাও কোনো ছলনা ছিল না। একথা সবাই জানতো — আমার বন্ধু বেনভোলিও জানতো, জানতো মারকুশিও, এমনকি ফাদার ফ্রায়ারও…বিশ্বাস করো জুলিয়েট, সেকথাটা কেবল তোমাকেই বলে উঠতে পারি নাই।
জুলিয়েট : বুঝেছি বুঝেছি আমি সব বুঝেছি — ছি রোমিও, ছি — যে-কথা সবাই জানতো সে-কথা আমাকে জানালে কী এমন ক্ষতি হতো তোমার! বলো — তুমি কি ভেবেছিলে রোজালিনের প্রতি তোমার প্রেমের কথা জানলে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না! ভালোবাসতাম না!
রোমিও : ব্যাপারটা তা নয় জুলিয়েট। আসলে, তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর, তোমার সাথে কথা বলার পর বুঝেছি প্রেম কী বস্তু…! আর এও বুঝেছি রোজালিনের প্রতি আমার যেটা ছিল সেটা আসলে প্রেম নয় — আমার চোখের মুগ্ধতা মাত্র।
কবি : মুগ্ধতা! তুমি কোনটাকে মুগ্ধতা বলছো! মিস্টার রোমিও, এইবার কিন্তু আমাকে কথা বলতে হচ্ছে…। এই তুমিই কিন্তু সেদিন বলেছিলে — ‘আমার এই দুই চোখের দোহাই, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ধ্যান রোজালিন, আমি বিশ্বাস করি ওর থেকে সুন্দর ত্রিভুবনে আর নেই, আমি তাই রোজালিনের প্রতিই নিষ্ঠাবান থাকছি — যদিও সে আমাকে বাসেনি ভালো, তবু বিশ্বাস একসময় সে আমার প্রেমনিষ্ঠার কাছে পরাজিত হবেই…আর সেই জয়ের আনন্দ নিয়ে আমি সংসার পাতবো কেবলমাত্র রোজালিনের সঙ্গেই…।’
মিস্টার রোমিও, এখন বলো — এই মনকথা এই প্রতিজ্ঞা তোমার ছিল না! হায় কী অপূর্ব তোমার প্রেমনিষ্ঠা! সেদিনের ভোজসভায় রোজালিনের প্রেমনিষ্ঠ রোমিও, তুমি তো সং সেজে রোজালিনকেই দেখতে গিয়েছিলে, নাকি? আর সেখানে গিয়ে তোমার ওই দুই চোখের দোহাই লাফিয়ে পড়ল জুলিয়েটের দেহের উপর…! বাহ, চমৎকার! এই তোমার প্রেমনিষ্ঠা! ভোজসভায় জুলিয়েটের সাক্ষাত পেয়ে একমুহূর্তেই রোজালিনকে ভুলে গেলে! হায় প্রেম নিষ্ঠা!
রোমিও : আপনার কথা কি শেষ?
কবি : আপাতত। এখন বলো, আমি সব মিথ্যে বলেছি — সব মিথ্যে।
রোমিও : না, আপনি ঠিকই বলেছেন…রোজালিনকে আমি সত্যিকারের প্রেমনিষ্ঠা থেকেই অন্তরে স্থাপন করেছিলাম।
কবি : তবে সমস্যা হলো…।
রোমিও : আমাকে বলতে দিন।
কবি : ঠিক আছে, তাই বলো। আমি তো তোমার…না না, তোমাদের কথা শোনার জন্যে সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি। বলো বলো — প্রাণ খুলে বলো। তবে, একটা কথা —
রোমিও : আবার কী কথা?
কবি : মিথ্যা বলবে না। মিথ্যাবাদীকে আমি ঘৃণা করি।
জুলিয়েট : মিথ্যাবাদীকে আমিও…
রোমিও : জুলিয়েট, আমাকে কথা বলতে দাও।
জুলিয়েট : কী বলবে তুমি!
রোমিও : জুলিয়েট!
জুলিয়েট : ঠিক আছে, বলো।
রোমিও : এই যে মিস্টার, আমি জানি না আপনি কে? তবে, শুনুন, আমাকে ভুল বুঝবেন না…
কবি : বলুন, আমি শুনছি।
রোমিও : আসলে কী জানেন, জুলিয়েটকে দেখার পর আমি নতুনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি…।
কবি : নতুন সিদ্ধান্ত!
রোমিও : হ্যাঁ নতুন সিদ্ধান্ত, আর সেটা ঘটেছিল জুলিয়েটের অদ্ভুত এক জাদুকরি আকর্ষণে এবং তারই সমর্থনে। আমি সেই প্রথম বুঝি — এক নিষ্ফল প্রেমনিষ্ঠায় মাসের পর মাস অর্থহীনভাবে রোজালিনকে ভালোবেসে গেছি…জুলিয়েটকে দেখামাত্র আমার সেই মোহভঙ্গ ঘটে। তবে, এও সত্য — আমি রোজালিনকে একসময় যথার্থ অর্থেই ভালোবাসতাম, কিন্তু এই আমার প্রকৃত প্রেম সম্ভব হয়েছে কিন্তু এই জুলিয়েটের সঙ্গে, জুলিয়েটের সাথে।
কবি : মিথ্যে, সব মিথ্যে…জুলিয়েট তোমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে তুমি সত্য গোপন করছো…আসলে, জুলিয়েটের প্রতি তোমার কোনো প্রকৃত প্রেম ছিল না, যা ছিল রোজালিনের প্রতি।
রোমিও : জুলিয়েট, তুমি তো রোজালিনকে চিনতে…বলো ওর সঙ্গে তুমি কি কোনোদিন আমাকে দেখেছো…জুলিয়েট বলো?
জুলিয়েট : না, কিন্তু এতে প্রমাণিত হয় না যে, তোমার জীবনে আমিই একমাত্র।
রোমিও : জুলিয়েট! …তুমিও আমাকে ভুল বুঝলে!
জুলিয়েট : ভুল কি ঠিক তা আজ আমার বোঝার সাধ্যকে অতিক্রম করে গেছে।
রোমিও : তাহলে শোনো — এই দুটি চোখ তখন শুধু একপাক্ষিকভাবে এই আমাকে রোজালিনের প্রতি আসক্ত রেখেছিল। কিন্তু রোজালিন কোনোদিনই আমাকে বাসে নাই ভালো, এমন কি সে এই আমার দিকে ফিরে তাকায়নি…উহ সে কী অসহ্য যন্ত্রণা! যে আমাকে ভালোবাসে না, আমার দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকায় না, তার জন্যে হৃদয় নিয়ে বসে থাকার সে যে কী যন্ত্রণা…তা তুমি বুঝবে না জুলিয়েট! এখন বলো — এটা কি কোনো প্রেম? না জুলিয়েট, তোমার সঙ্গে আমার যা হয়েছে, তারপর ওটাকে কি কখনো প্রেম বলা যায়? বলো জুলিয়েট বলো…কথা বলছো না কেন? বলো…।
জুলিয়েট : তোমার কথার চমৎকারিত্বে আমি প্রথম থেকেই মুগ্ধ…এরপর…আর কী শুনতে চাও আমার কাছে?
জুলিয়েলের শ্লেষবাক্যে রোমিও কিছুক্ষণের জন্য বাক্য হারিয়ে ফেলে। তারপর একটুখানি স্বাভাবিক হয়ে ঠাণ্ডা গলায় জুলিয়েটকে প্রবোধ দিতে চান।
রোমিও : জুলিয়েট, একটা কথা শোনো, একটু মন দিয়ে শান্ত হয়ে শোনো — আর একবার শুধু একবার আমাদের জীবনের ঝড়ো ভালোবাসার দিকে তাকাও।
কবি : চমৎকার রোমিও চমৎকার! তোমাদের ভালোবাসাকে চমৎকার বিশেষণে বিশেষায়িত করলে, বড়োই চমৎকার! তোমার কথার সূত্রে ভবিষতের মানুষ জানলো নতুন একটি কথা — রোমিও এবং জুলিয়েট ‘ঝড়ো ভালোবাসা’ করেছিল, ‘ঝড়ো ভালোবাসা’য় মরেছিল।
রোমিও : থামুন আপনি, থামুন।
কবি : ঠিক আছে থামছি। রোমিও বলো বলো আরও বলো, আজ তো শুধু তোমাদের কথাই শুনবো।
রোমিও : হ্যাঁ তা-ই শুনবেন। কেবল একটুখানি দয়া করুন, আমার কথাটা বলতে দিন। দয়া করে আমার কথার মাঝে আর কোনো কথা বলবেন না।
কবি : তথাস্তু। দেখি কতটুকু বলতে পারো! আর কতটা মিথ্যে দিয়ে ভোলাতে পারো ওই সরলা জুলিয়েটকে! দেখি।
তীর্যকভাবে কথা বলতে বলতে কবি সরে দাঁড়ান। রোমিও কবির যে তীর্যক কথায় অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুই বলতে পারেন না। বরং তিনি জুলিয়েটের পাশে এসে বলেন —
রোমিও : জুলিয়েট, ওই লোকটা আমাদের শত্রু, দেখছো না — তোমার সামনে আমাকে কেমন ব্যঙ্গ করছে!
কবি : আরো নিবিড় হয়ে জুলিয়েটকে আগলে ধরো। তারপর কথা বলো।
রোমিও : থামুন আপনি।
কবি : পারলে আরো উত্তেজিত হও, আমি জানি মানুষ উত্তেজিত হলে ভেতরের আসল মানুষটা বেরিয়ে আসে। আমি তোমার সেই রূপটা তোমার ওই জুলিয়েটের সামনে প্রকাশ করে দিতে চাই, পৃথিবীর সব মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিতে চাই।
রোমিও প্রচণ্ডভাবে রেগে কবির দিকে ছুটে যেতে গিয়ে কেন যেন থেমে যান। তারপর অত্যন্ত অস্থির আবেগে কেঁপে কবির দিকে তীক্ষ্ণ-তীর্যকচোখে তাকিয়ে নিজেকে এক প্রকার সংযত করে নেন। শেষে তিনি জুলিয়েটের দিকে ফিরে তাকান এবং কাছে গিয়ে বলেন —
রোমিও : জুলিয়েট, তুমি কী বুঝতে পারছো — ওই লোকটা একটা বদ্ধ-উন্মাদ…আমাদের শক্র…কী কথা বলছো না কেন?
জুলিয়েট : আজ আমার সব কথা হারিয়ে গেছে।
রোমিও : শোনো, আমি আমার পূর্বপ্রেমের কথা নিশ্চয় তোমাকে বলতাম হয়তো। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, সে সময়টা আমার জীবনে আসেনি। জুলিয়েট, জুলিয়েট, তুমি তো জানো, আমরা আমাদের অতিঅল্প সময়ের যুগল প্রেমের মাঝখানে কোনো অবসর পাইনি। অবসর পেলে আমি আমার সব কথা তোমাকে বলতাম — নিশ্চয় হয়তো।
জুলিয়েট : নিশ্চয়, হয়তো! বাহ বেশ, বেশ রোমিও, আমি জানি, ‘নিশ্চয়’ আর ‘হয়তো’ এই শব্দ দুটি পরস্পর বিরোধী কথা বলে…বেশ রোমিও বেশ, আজ তোমার কথার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে — অবসর পেলেও তুমি ওই গোপন-সত্যটা আমাকে বলতে না, কোনোদিন বলতে না। শুধু শুধু মিথ্যা বলে কী লাভ রোমিও!
রোমিও : জুলিয়েট জুলিয়েট জুলিয়েট, তুমি বিশ্বাস করো…।
জুলিয়েট : সরে যাও তুমি। আমাকে একটুও স্পর্শ করবে না।
রোমিও : জুলিয়েট!
জুলিয়েট : হ্যাঁ, স্পর্শ করবে না।
রোমিও : জুলিয়েট, ভুলে যেয়ো না, একদিন তুমি আমার এই হাতের স্পর্শেই শিহরিত হয়েছিলে — সে কথা ভুলে যেয়ো না।
জুলিয়েট : না, একেবারেই ভুলে যাচ্ছি না যে, ওই হাতের স্পর্শ-ছলনাই সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছে আমাকে!
রোমিও : ভুল জুলিয়েট, সব ভুল। আমার কথার আদ্যোপান্ত শুনলে তোমার সব ভুল ভেঙে যাবে। জুলিয়েট, একবার, শুধু একবার মনে করে দেখো, — রাতে তোমার সাথে দেখা। কোন অচেতনে জানি তোমার হাতে লেগে গেল আমার হাত, সেই স্পর্শ শিহরনকে নিয়ে হলো কথা।
জুলিয়েট : আর সে রাতেই তুমি আমার সরল-মুগ্ধতার সুযোগ নিয়ে উঠে এসেছিলে আমার শোবার ঘরের বেলকনিতে…।
রোমিও : হ্যাঁ, আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠে গিয়েছিলাম তোমার বেলকনিতে…কেননা, তখন তুমি আমার স্পর্শ-ভালোবাসার কথাই ভাবছিলে…তোমার সেই ভাবনা আমাকে পাগল করে দিয়েছিলো জুলিয়েট…পাগল করে দিয়েছিলো…আজও ধন্য মানি তোমার সেই ভাবনাকে…।
জুলিয়েট : আমার সেই ভাবনার সঙ্গে একটি কচি মনের পবিত্র-সরলতার যোগ ছিল…।
রোমিও : সত্যিকারের ভালোবাসা কাকে বলে সেই রাতে আমি টের পেয়েছিলাম জুলিয়েট।
জুলিয়েট : আমি তখন একটুও ভাবতে পারি নাই যে কোনো প্রেমিকের মধ্যে একবিন্দু মিথ্যের আশ্রয় থাকতে পারে…।
রোমিও : শুধু একটুখানি কথা বলতে — তোমার বেলকনিতে উঠে গিয়েছিলাম আর বুঝেছিলাম সত্যিকারের ভালোবাসার ভেতর কেমন অস্থিরতা মিশে থাকে…।
জুলিয়েটের সঙ্গে রোমিও’র এমন কথার মধ্যে কবি আর স্থির থাকতে পারেন না। তিনি রোমিও-র দিকে এগিয়ে বলেন —
কবি : না না, মিথ্যে ভালোবাসার সঙ্গেই অস্থিরতা মিশে থাকে।
রোমিও : মানে?
কবি : কেননা, মিথ্যে ভালোবাসা নগদ-প্রাপ্তির জন্য মরিয়া হয়ে থাকে, যত দ্রুত সম্ভব অর্জন আর ভোগে বিশ্বাস করে। কারণ, মিথ্যে ভালোবাসাতে হারানোর ভয় একটু বেশি থাকে। না-কি বলো রোমিও?
রোমিও : আমি আপনার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না।
কবি : আমি জানি, বুঝলেও তা তোমার স্বীকার করার কথা নয়।
রোমিও : কী বলতে চান আপনি?
কবি : বলছি। আচ্ছা বলো তো তোমার ওই ‘ভালোবাসা’, ‘অস্থিরতা’ আবার ‘ঝড়ো ভালোবাসা’ এ সবের মধ্যে নিশ্চয় কোনো পার্থক্য নেই?
রোমিও : তা থাকবে কেন?
কবি : জানি, প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয় চতুর মানুষেরা।
রোমিও : আপনি আমাকে চতুর বলছেন!
কবি : হ্যাঁ, বলেছি। এবং আবারো বলছি আপনি চতুর। কেননা, আপনি প্রথম থেকেই আমার সব কথাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছেন।
রোমিও : না আমি আপনার কোনো কথাকেই পাশ কাটিয়ে যাইনি।
কবি : তাহলে স্বীকার করো — তোমার ওই তথাকথিত ‘ভালোবাসা’, ‘অস্থিরতা’, আর ‘ঝড়ো ভালোবাসা’ এ সবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
রোমিও : আমি জুলিয়েটকে ভালোবেসে অস্থিরভাবে ওকে পেতে চেয়েছিলাম।
কবি : ব্যাস, আমার উত্তর পেয়ে গেছি। এখন — শোনো, শোনো সত্যিকারের ভালোবাসার সঙ্গে কোনো অস্থিরতা মিশে থাকতে পারে না। কেননা, সত্যিকারের ভালোবাসায় হারাবার কোনো ভয় থাকে না, আবার মনের মানুষটাকে নিশ্চিত পাবার বিষয়েও কোনো সন্দেহ থাকে না। তাই সত্যিকারের ভালোবাসার গতি বা চলন হয় অস্থির নয়, ধীর-স্থির। এই মুহূর্তে তুমি আমার গানটির কথা মনে করতে পারো — ‘নিষ্ঠা মনে প্রেম করিয়ে/এক মনে বসে রয়েছে।’ সত্যিকারের ভালোবাসা এমনই স্থিরতাকে মানে। আরেকটু শোনো ওই গানটা — ‘প্রেম-পাথারে যে সাতারে/তার মরণের ভয় কি আছে/নিষ্ঠা-মনে প্রেম করিয়ে/এক মনে বসে রয়েছে॥’
কবি তার এই গান গাইতে গাইতে আবার একটু দূরে সরে যান। আর রোমিও তার আগের কথার ধারাবাহিকতা রেখে জুলিয়েটকে বলেন —
রোমিও : জুলিয়েট, তুমি আমি দুজনেই খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। মনে করে দেখো জুলিয়েট, শুধু আমি নই, তুমিও আমার জন্য কেমন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলে, আমিও তোমার জন্য। একটুও বিরহ আমাদের সহ্য হয়নি। সকাল হতে না হতেই আমি আমার অস্থির প্রেমের উপায় বাতলে নিতে ছুটে গিয়েছিলাম চার্চে।
জুলিয়েট : আমি সেদিন সরল বিশ্বাসের কাছে পরাজিত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কী যে করেছিলাম!
রোমিও : কিছুক্ষণ পর তুমিও ছুটে গিয়েছিলে একই স্থানে — মানে চার্চে। সেখানে সেই সকালে ফাদার ফ্রায়ার আমাদের দুজনার দুটি হাতকে একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বিয়ের কারণে, বিয়ের মন্ত্রে। মনে নেই তোমার?
জুলিয়েট : মনে আছে। কিন্তু তারপর?
রোমিও : তারপর তোমার ভালোবাসা আমার এই পোড়াকপালে সইলো না জুলিয়েট, সইলো না…।
জুলিয়েট : আর ভান করো না রোমিও! আর না। আমি বলি শোনো — তারপর সেই সকালে তুমি আমাদের পরম-আত্মীয় টাইবল্টকে হত্যা করে পালিয়ে গিয়েছিলে, এটাই আসল কথা।
রোমিও : না, জুলিয়েট, না। আমি সেইদিনও বলেছি, আজও বলছি — আমি টাইবল্টকে হত্যা করিনি। বরং টাইবল্টের আক্রমণ হতে নিজেকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম।
জুলিয়েট : আর তখনই টাইবল্ট তোমার হাতের তরবারিতে খুন হয়েছিল, সেটা ছিল তোমার অনিচ্ছাকৃত। জানি তো!
রোমিও : বিশ্বাস করো, এটাই সত্য। আমি তাকে হত্যা করিনি, আত্মরক্ষার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে সে আমার হাতের তরবারিতে খুন হয়েছিল।
রোমিও-র কথার মধ্যে কবি চিৎকার করে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসেন –
কবি : বাহ্ বেশ রোমিও! জানি, প্রতারকেরা এরকমই বলে — ‘আমি তাকে হত্যা করিনি, সে আমার হাতের তরবারিতে খুন হয়েছিল।’
রোমিও : থামুন আপনি।
কবি : রোমিও!
রোমিও : না, ওই মুখে আর আমার নাম উচ্চারণ করবি না।
কবি : রোমিও!
রোমিও : বেরিয়ে যা এখান থেকে।
কবি : রোমিও!
রোমিও : আর একটাও কথা নয়, যা এখান থেকে।
কবি : না, আমাকে ধাক্কা দেবে না।
রোমিও : তুই না গেলে, তোকে ধাক্কা দিয়েই বের করে দেবো।
কবি : আমার সাথে ভদ্রতা করে কথা বলো।
রোমিও : ভদ্রতা! এই তুই কে, যে তোকে সালাম করে কথা বলতে হবে! যা বলছি, যা এখান থেকে।
কবি : দেখেছো দেখেছো মিসেস রোমিও, তোমার হাসব্যান্ডের কেমন ব্যবহার! আমার সাথে কেমন অসৎ খারাপ ব্যবহার করছে দেখো।
রোমিও : আর কোনো কথা না, যা এখান থেকে।
কবি : মিসেস রোমিও, দেখো দেখো, কেমন ব্যবহার তোমার স্বামীর!
রোমিও : মুখ বন্ধ কর।
কবি : কারো মুখে হাত দিয়ে নিজের চরিত্রের দুর্বলতা চেপে রাখা যায় না — মিস্টার রোমিও।
রোমিও : আমার চরিত্র নিয়ে তুই কথা বলার কে!
কবি : মিস্টার রোমিও, আমি আবার বলছি — আমার সাথে ভদ্রতা করে কথা বলো — আই অ্যাম এ পোয়েট, আই মিন কবি, আমার সঙ্গে ভদ্রতা করে কথা না বললে — এখানে আজ তোমার সব সহপাঠী বন্ধুদের ডেকে এনে জুলিয়েটকে শুনিয়ে ছাড়বো — জুলিয়েটকে ভালোবাসার আগে তুমি রোজালিনকে কতটা ভালোবাসতে।
জুলিয়েট : তার আর প্রয়োজন হবে না, আমি আজ আমার প্রেমিক বা স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে সবটুকু বুঝে গেছি।
রোমিও : না জুলিয়েট, তুমি কিচ্ছু বোঝোনি, কিচ্ছু না। আসলে কী জানো, একটি দিনের জন্যেও আমি আমার সব কথাকে তোমার কাছে বলার সুযোগ পাইনি জুলিয়েট।
জুলিয়েট : কেবল সুযোগ পেয়েছিলে মেকি আর মিথ্যে প্রেমের কথাগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলে শোনাতে।
রোমিও : আমাকে এইভাবে আর আহত করো না জুলিয়েট।
জুলিয়েট : তুমি একজন মিথ্যেবাদী, আমার সত্য কথাতে তুমি আজ আহত হলে আমার কিচ্ছু করার নেই।
রোমিও : আহ্ জুলিয়েট, এরকম কথা বলার চেয়ে আমাকে হত্যা করো।
জুলিয়েট : আমি তোমার মতো নিষ্ঠুর নই।
রোমিও : নিষ্ঠুর! কে নিষ্ঠুর? আমি না তুমি? দিনের বেলায় টাইবল্ট খুন হবার পর রাতের বেলায় আমি যখন তোমার কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম তখন তুমি বলেছিলে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, তুমি বলেছিলে — ‘যথার্থ প্রেমিক যদি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো মারাত্মক অপরাধও করে ফেলে তবে তার প্রেমিকার উচিত তাকে ভুল না-বোঝা।’ আজ কোথায় তোমার সেই কথা! কোথায়, জুলিয়েট!
জুলিয়েট : কথাটা ঠিকই আছে, কিন্তু আজ আমি জেনে গেছি — তুমি সেদিন যথার্থ প্রেমিক না।
রোমিও : জুলিয়েট!
জুলিয়েট : বলো? কী বলতে চাও?
রোমিও : আমি যথার্থ প্রেমিক ছিলাম না!
জুলিয়েট : না।
রোমিও : না! তাহলে শোনো, তুমিই আমাকে তোমার কাছে যথার্থ প্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ দাওনি, এখনও দিচ্ছো না।
জুলিয়েট : ভুল, রোমিও, ভুল।
রোমিও : না এটাই সত্য।
জুলিয়েট : গলার জোরে সত্য ঘোষণা করলেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না।
রোমিও : জুলিয়েট, আমি ভুলে যাইনি যে, সেদিন আমাদের দুজনার মধ্যে কথা ছিল, আমরা আমাদের প্রেম-দুঃখের অবসান ঘটাবো এক মধুর মিলনে। আর তাই আমরা এক অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার নিয়তিকে মেনে নিয়েছিলাম সামান্য বিরহকে স্বীকার করে নিয়ে। তুমি আমার স্বেচ্ছানির্বাসনের অন্তরায়ের ভেতর আমার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছিলে — আমরা এক মধুর মিলনের অপেক্ষায় থাকবো। কিন্তু তুমি তোমার কথা রাখোনি, জুলিয়েট কথা রাখোনি।
জুলিয়েট : আমি কথা রাখিনি!
রোমিও : হ্যাঁ, তুমি কথা রাখোনি। তুমি আমাদের মধুর মিলনের জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারোনি, একটুখানি কষ্ট স্বীকার করতে পারোনি।
জুলিয়েট : কী যা তা বলছো! আমি জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়েছি তোমার সঙ্গে মিলনের জন্য।
রোমিও : মিথ্যে কথা। কিচ্ছু করো নি তুমি। কিচ্ছু না। বরং আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজে আত্মহত্যা করে আমাকেও আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিলে…।
জুলিয়েট : আর মিথ্যে বকো না, আমি তোমাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করিনি, বরং তুমিই আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছো। আর মিথ্যে বলো না।
রোমিও : কোনটা মিথ্যে, জুলিয়েট? আমি মাঞ্চুয়ায় নির্বাসনে যাবার পর তুমি আত্মহত্যা করোনি?
জুলিয়েট : না, আমি তোমার সঙ্গে মিলনের জন্য একটা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলাম মাত্র।
রোমিও : মিথ্যে কথা।
জুলিয়েট : না মিথ্যে নয়, আমি মিথ্যে বলছি না।
রোমিও : তাহলে নিশ্চয় — আমি মিথ্যে বলছি — মাঞ্চুয়ায় নির্বাসনে যাবার পর আমি বন্ধু বালথাসারের মাধ্যমে খবর পেয়েছিলাম যে — তুমি নাই। তোমার মৃতদেহকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রেভইয়ার্ডে। এটা মিথ্যে? বলো — আমি যে চোখের নিমিষে সুদূর মাঞ্চুয়া থেকে এই গ্রেভইয়ার্ডে ছুটে এসে তোমার কবর খুঁড়ে — তোমার যে মৃতদেহকে বের করে এনেছিলাম — সেটা মিথ্যে? নাকি বলো — তোমাকে মৃত দেখে আমি যে আত্মহত্যা করেছিলাম — সেটা মিথ্যে? বলো বলো — আমার জন্য অপেক্ষা না করে কেন তুমি আত্মহত্যা করেছিলে? কেন?
জুলিয়েট : বিশ্বাস করো, আমি তখনও আত্মহত্যা করিনি! আমি তোমার আগে আত্মহত্যা করিনি — তোমার আগে মরিনি। তুমি ভুল বলছো রোমিও। ভুল।
রোমিও : না জুলিয়েট, আমি ঠিকই বলছি। কেননা, কবর খুঁড়ে তোমাকে আমি মৃত পেয়েছিলাম। আমার এই হাতের স্পর্শ আর চোখের দৃষ্টি শক্তি সেদিন একটুও ভুল করে নাই জুলিয়েট, একটুও না।
জুলিয়েট : ভুল, রোমিও, ভুল, সব ভুল, তুমি ভুল করে আত্মহত্যা করেছিলে।
রোমিও : না, আমার আত্মহত্যার ভেতর কোনো ভুল ছিল না।
জুলিয়েট : ছিল, রোমিও, ছিল। কেননা, তোমার আত্মহত্যার পর আমার চেতনা ফিরে এসেছিল।
রোমিও : এ আমি বিশ্বাস করি না।
জুলিয়েট : বিশ্বাস করো রোমিও, আমার চেতনা ফিরে এলে — এই আমার দেহের উপর তোমাকে নি®প্রাণ পড়ে থাকতে দেখে নিজের জীবনকে নিরর্থক মনে হয়েছিল।
রোমিও : বাহ্ জুলিয়েট, বাহ্! তোমাকে ধন্য মানি, আমার আত্মহত্যার কথা শুনে তুমি তাৎক্ষণিকভাবে যে মিথ্যে আর বানোয়াট গল্প বানাতে শুরু করছো — তাতে আমি মুগ্ধ!
জুলিয়েট : মিথ্যে নয় রোমিও — তোমাকে মৃত দেখে তোমারই কোমর থেকে ভোতা একটা ছুরি খুলে নিয়ে এই বুকে বিদ্ধ করে আমি যে আত্মহত্যা করেছিলাম, এটা মিথ্যে নয়।
রোমিও : তোমার এই প্রতিভার কথা আগে আমি জানতাম না! মিথ্যে আর কাল্পনিক গল্প বানাতে তুমি যে এতো ওস্তাদ — তা আজ এতোদিন পর জেনে আমি তোমার প্রতি নতুন করে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি!
জুলিয়েট : বিশ্বাস করো, আমি তোমায় কোনো মিথ্যে-কাল্পনিক গল্প বানিয়ে বলিনি। বলেছি আমাদের নাটকীয় জীবনের সত্যকাহিনী।
কবি এবার চিৎকার করতে করতে জুলিয়েটের সামনে এসে দাঁড়ান এবং বলেন –
কবি : জুলিয়েট, জুলিয়েট — আমিও তোমাদের নাটকীয় জীবনের সত্য কাহিনীটাকে একটু খুলে খুলে শুনতে চাই, শোনাতে চাই তোমার রোমিওকে। কী জুলিয়েট, বলবে না?
জুলিয়েট : কী বলতে চাইছেন?
কবি : না, তেমন কিছু না, আজ শুধু বলে যাও তোমার প্রথম গান-প্রথম আখ্যান, যার অন্তরাটুকু রচিত হয়েছিল তোমার প্রথম মৃত্যুর আগে।
জুলিয়েট : মানে?
কবি : প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে — আজ নয়, ওতে রোমিও আর তোমার মাঝের গভীর ফাঁককে বোঝা সম্ভব নয়। আজ বলো, তোমার প্রথম মৃত্যুর আগের কথাগুলো।
জুলিয়েট : কেন?
কবি : উত্তরটা একটু পরে দিই? তার আগে বলো, তোমার প্রথম মৃত্যুর আগে কী ঘটেছিল?
জুলিয়েট : কী সব বলছেন আপনি! প্রথম মৃত্যু, দ্বিতীয় মৃত্যু…আমি যে এর কিছুই বুঝতে পারছি না।
কবি : পারবে পারবে, সব বুঝতে পারবে…আগে বলো, রোমিও নির্বাসনে চলে গেলে তোমার জীবনে কী এমন ঘটেছিল যে তুমি প্রথম মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছিলে? প্রথম নয়, ওটাই ছিল তোমার আসল মৃত্যু…না-কি বলো?
জুলিয়েট : কী বলছেন আপনি? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।
কবি : বোকা মেয়ে, এইটুকু বুঝতে পারছো না!
জুলিয়েট : না।
কবি : তাহলে শোনো, রোমিও কিন্তু তোমাকে মৃত-ই জেনেছিল এবং গ্রেভইয়ার্ডে মাটি খুঁড়ে মৃত-ই পেয়েছিল তোমাকে।
জুলিয়েট : না না, এ হতে পারে না, ফাদার ফ্রায়ারের দেওয়া প্রতিশ্র“তি কখনো মিথ্যে হতে পারে না।
কবি : ফাদার ফ্রায়ারের দেওয়া প্রতিশ্র“তি! হে হে…সে তোমাকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল…হে হে…। শুনে রাখো, সে ছিল একটা মিথ্যুক, প্রতারক…।
রোমিও : থামুন। আমি আর কিছুই শুনতে চাই না।
কবি : কেন রোমিও? তোমার আবার কী হলো?
রোমিও : একটা সৎ ও ভালো মানুষ সম্পর্কে আপনি মুখ সামলে কথা বলুন।
কবি : আমার বিবেচনায় তিনি সৎ নন, ভালো মানুষও নন, তিনি একটা খারাপ এবং নিকৃষ্ট মানুষ।
রোমিও : না, তিনি সৎ এবং আদর্শবান মানুষ।
জুলিয়েট : তাঁর মতো ভালো মানুষ এখনও এ পৃথিবীতে নাই।
রোমিও : আপনি জানেন না — তিনি আমাদের জন্য কী করেছেন!
কবি : কী করেছেন?
রোমিও : আমাদের দুই পরিবারের মধ্যকার দীর্ঘদিনের অহেতুক দ্বন্দ্ব-বিরোধকে উপেক্ষা করে তিনি গোপনে জুলিয়েট আর আমাকে বিবাহ দিয়েছিলেন।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন