Pages

"পায়েল...."

                                                                                                                                                                                                                                     নীলিমার হাতে যখন নুপুর যুগল তুলে দিলাম, ও হাতে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু আরেকটা হাত চোঁখের অশ্রু মুঁছতে ব্যস্ত ছিল তার। আর আমার? কথায় আছেনা 'অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর' আমিতো পাথর হয়ে গেছি সেই ৪ বছর আগেই।


নুপুরগুলো হাতে নিয়ে নীলিমা আমাকে প্রশ্ন করল ৫ জোড়া তো হয়ে গেছে, আর কত কিনবে?

- যতদিন আমি বেচে আছি।

আর কিছুই জানতে চাইল না চুপচাপ নূপুর যূগল আলমিরাতে রেখে দিল।


প্রতি বছর এই ৭ এপ্রিল আমি এক জোড়া নূপুর নিয়ে ঘরে ফিরি, গত ৪ বছর ধরে। ইচ্ছে করলে এখন আমি প্রতিদিন এক জোড়া নূপুর ও কিনতে পারব। অথচ এই নূপুর ই আমাকে সারাজীবন কাঁদিয়ে বেড়াবে।

৯ বছর আগের কথা, সেদিন ভোরের আলো না ফুটতেই নীলিমার কড়া নাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গল, এত ভোরে তাকে দেখে অবাকই হলাম! সাধারনত আমার মেসে সে আসেনা। তার বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে যা করার আমাকে এখনি করতে বলছে সে। না হয় এটাই তার আর আমার শেষ দেখা বলে হুমকি দিচ্ছে আমায়।


কিছু বুঝে উঠার আগেই কাজী অফিস, বিয়ে সব কিছুই হয়ে গেল।

নীলিমাকে নিয়ে গেলাম বাড়িতে সৎ মার চেয়ে বাবাকে পাষন্ড মনে হচ্ছে আজ, আমিতো সব বুঝি বাবা সৎ মায়ের ভয়েই সেদিন তাড়িয়ে দিল আমায়, একবার নব পুত্রবধূটা কেও দেখলোনা ভাল করে। আর মা এমন ভাবে দেখছে যেন আমার অপরাধটা তার আপন ছেলের হেরোইন সহ ধরা পড়ে জেল এ যাবার চেয়ে গুরুতর অপরাধ!


নীলিমার বাড়ির পথ তো আরও আগে বন্ধ হয়ে গেছে, তাছাড়া তার বাড়ি যাবার প্রশ্নই উঠেনা। ফিরে এলাম ঢাকা শহরে, ফ্ল্যাট নেয়া তো আর সম্ভব না কবুতরের খুপরির মত একটা রুম নিলাম, সেখানেই দুজনের সুখের সংসার গড়ে তুললাম।

চাকরির জন্য ঘুরছিলাম তো আরও আগে থেকে, কিন্তু এবার তো আবশ্যক হয়ে গেল। কিন্তু এটা তো আগে জানতাম সোনার হরিণ এখন মনে হচ্ছে হীরার হরিণ, শেষ পর্যন্ত আগের ২ টা টিউশনির পাশাপাশি আরও দুইটা টিউশনি পেলাম। নিলীমাও কমাস পর একটা কিন্ডার গার্ডেন এ জয়েন করল। টোনাটুনির সংসার ভাল ভাবেই চলছিল।

বছর ঘুরতেই আমাদের কবুতরের খূপরি আলো করে একজন এল, নাম রাখলাম পায়েল। টোনাটুনির সংসার পরিনত হল তিনজনের পরিবারে। আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো আমাদের পায়েল। একবার আমার বা নিলীমার পরিবারের কেউ আমাদের খোঁজও নিলো না।

দুজনের আয়ের পাশাপাশি কিছু জমা ও হয়েছে আমাদের। সেই জমা টাকা আর ক্ষূদ্র লোন পেলাম এক বন্ধুর সহযোগিতায়। শুরু করলাম ছোট খাট ব্যবসা, গাজীপুর থেকে ডিম সংগ্রহ করে ঢাকার আড়তে সাপ্লাই দিতাম, শুনতে খারাপ হলেও ব্যাবসা মন্দ না। ভালই লাভবান হতে লাগলাম।

এতদিনে বড় বড় আড়তদার দের সাথে ভালই জানাশুনা হয়ে গেছে, ব্যবসার জন্য এখন আর পূঁজির অভাব হয় না। ডিমের পাশাপাশি মূরগীর ব্যবসাও চালু করলাম। কবুতরের খূপরী ছেড়ে ফ্ল্যাট বাড়ি তে উঠে গেছি সেতো কবেই। আমার সৎ মা এখন আমাকে নিজের ছেলের চেয়ে বেশী দরদ দেখান্, বাবার কথা না ই বা বললাম। পায়েল কে স্কুলে ভর্তি করালাম, সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চলছিল। হঠাৎ কয়েকটি দেশে বার্ড ফ্লু'র প্রাদূর্ভাব দেখা দিল। বাংলাদেশে এর প্রভাব না থাকলেও গুজব এর কারনে সবাই এ মূরগী ডিম খাওয়া বন্ধ করে দিল। অনেক বড় একটা লোকসান খেলাম, এক দিকে আড়তদারদের পাওনা, ব্যাংক লোন সব মিলিয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা।

কদিন পরে পায়েলের জন্মদিন, এখন সে তার নামের অর্থ ও জানে, পায়েল মানে নূপুর। জন্মদিনে তার দাবী সোনার নূপুর। এটা তেমন কিছু ছিলনা আমার জন্য, কিন্তু এমন এক পরিস্থিতি তে আছি সংসার চলে বাকীতে। এর মধ্যে পায়েল অসুস্থ হয়ে পরল। বিপদ যখন আসে তখন চারিদিক থেকে আসে।

এই অসুস্থতার মাঝেও মেয়েটা তার জন্মদিন আর আমার দেয়া নূপুর কিনে দেয়ার কথা মনে রেখেছে। হাসপাতালের বেডে শুইয়ে আমাকে বলছে বাবা কাল তো আমার জন্মদিন, তুমি আমার নূপুর আনবে তো, সোনার নূপুর?

মিথ্যা বলা ছাড়া আর কি আছে আমার কাছে তখন্, মেয়ে কে বললাম আনব। পরদিন হাসপাতালে যাবার পথে কসমেটিকের দোকান থেকে এক জোড়া ইমিটিশনের নুপূর কিনে নিলাম। ছোট মানুষ বুঝতে পারবেনা, আসল না নকল । নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে ফাঁকিবাজি করতে নিজেকে অনেক অপরাধী লাগছে, কিন্তু কি করব আর তো কোন উপায় নেই। মেয়ে টা গেলেই তো বলে উঠবে বাবা আমার নুপূর এনেছ? কি জবাব দিব। নিজেকে এই ভেবে শান্তনা দিলাম একটু গুছিয়ে উঠলে সোনার নয় আমার মেয়েকে হীরার নুপূর কিনে দিব।

নুপূর জোড়া পকেটে পুরতেই নিলীমার ফোন পেলাম কান্না জড়িত কন্ঠে বলছে -ওগো তুমি তাড়াতাড়ি আস, পায়েল শুধু তোমাকে ডাকছে, কিভাবে ছুটে গেলাম শিশু হাসপাতাল পর্যন্ত নিজেও জানিনা। আমি গিয়ে দেখলাম আমার নিলীমা চিত্কার করে কাঁদছে, একটা বিছানার চাঁদরে ঢেকে আছে আমার পায়েলের ছোট্ট দেহ খানি, এখন তো সে চুপ করে থাকার কথা না, তার তো নুপূরের জন্য হাত বাড়ানোর কথা। তবে কি জানতো সে আমি তাকে ফাঁকি দিতে নকল নুপূর এনেছি তাই আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে? বিধাতা... কেন এই নিস্পাপ পায়েলের দিকেই তোমার নজর গেল? পায়েল কি দোষ করেছিল যে এই অল্প বয়সেই তার বাবার হাতে নুপ্পু ( পায়েল নুপুরকে নুপ্পু বলতো) না পরেই হারিয়ে গেল না ফেরার দেশে। বিধাতা...ও বিধাতা...এখন কে আমাকে বাব্বা...বাব্বা বলে আমার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পরবে?

ইচ্ছা হচ্ছিল না ব্যবসায় ফিরে যেতে, কিন্তু পাওনাদারদের টাকা কিভাবে শোধ দিব ঐ দিকে সরকার ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ট্রি ব্যাবসায়ীদের লোন দিল সহজ শর্তে। ঘুরে দাড়ালাম আবার এখন আর আমি সাপ্লায়ার নই, কাওরান বাজারের সফল আড়তদারদের একজন। অভাব শুধু একটাই বাব্বা..বাব্বা ডাকার মত কেউ নেই। এখনও আমি প্রতি ৭ এপ্রিল এক জোড়া নুপূর নিয়ে ঘরে ফিরি, মনে হয় আমার পায়েল ঘরে আসলেই আমাকে ডেকে বলে উঠবে- বাবা আমার নুপূর এনেছ? 

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন