Pages

"এই সময়, সেই সময়"

                                                                                                                                                                                "আচ্ছা আমি খুব সুন্দর,তাই না ?"

 "

"কি ব্যাপার হা করে তাকিয়ে আছেন কেনো, প্রতিদিন আপনি আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকেন, বিরক্ত হয়ে গেছি, হুহ।"

রাজু থতমত খেয়ে গেলো, মুন্নির আকস্মিক এই প্রশ্নের তান্ডবে সে কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। প্রতিদিন মুন্নির স্কুলের সামনে ঠায় দাড়িয়ে থাকে সে।হ্যা, মুন্নিকে সে ভালোবাসে। স্কুলের স্পোর্টস প্রোগ্রামে মুন্নিকে প্রথম দেখেছিল রাজু। সেদিন থেকেই ভালোবাসতে শুরু করেছে সে মুন্নিকে। মুন্নি সবেমাত্র অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী আর রাজু অল্প লেখাপড়া করার পরই বুঝতে পেরেছে আসলে ঐটা তার দ্বারা সম্ভব না, তাই এইচ এস সি পাশ করেই একটা কাজে লেগে পরে । মুন্নি অনেক চঞ্চল টাইপের একটা মেয়ে সেই তুলনায় রাজু অনেকটা লাজুক।



সেদিনের পর থেকে মুন্নির সামনে যেতো না রাজু, লুকিয়ে লুকিয়েই দেখতো।কিন্তু এভাবে আর কতদিন, রাজু সিদ্বান্ত নিলো মুন্নিকে সে তার ভালোবাসার কথা এবার বলেই দিবে। একদিন মুন্নি স্কুল থেকে যাচ্ছিল, রাজু পিছন থেকে ডাক দিলো।

"এই মুন্নি,শোন"
"আপনে আমার নাম জানলেন কিভাবে?"
"তোমার বান্ধবীর কাছ থেকে"
"নাম চোর"
"আচ্ছা শুনো তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে"
"বলে ফেলেন, আমি আপনার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি"
"সত্যি?!"
"আরে হ্যা, নাহলে আমি এখানে তালগাছের মত দাড়িয়ে থাকব কোনো?"
"আচ্ছা বলছি, তোমাকে যেদিন থেকে দেখেছি, সেদিন থেকেই ভালোবেসে ফেলেছি, দিনগুনেছি তোমার অপেক্ষায়, ভালোবেসেছি তোমার চাঞ্চল্য, ভালোবেসেছি তোমার প্রতিটি হাসির প্রতিটি ঝলক, তোমাকে আমি ভালোবাসি"
"আমিও আমার আব্বু আম্মুকে এরকমই ভালোবাসি, একদম জীবনের প্রথম দিন থেকে "
"আরে তুমি বুঝনা কেনো, বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর একটা ছেলে একটা মেয়ের ভালোবাসা সম্পূর্ন আলাদা"
"ওহ আচ্ছা, ওইটা আমার বুঝার বয়স হয় নি"
"বুঝতে চেষ্টা কর, বুঝতে পারবা"
"কি যে বলেন না ভাইয়া, আমি যাই, বাসায় ফিরতে দেরি হলে আম্মু টেনশন করবে"
"ওকে, উত্তরটা কবে দিবা ?"
"আসলে আমি এইসব ফিলিংস বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না , বিয়ের বয়স হলে বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিবে। কাহিনী শেষ ।"
রাজু স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইল, মুন্নি চলে গেলো।


"রাজু কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, পৃথিবীটা তার কাছে মুন্নির মতই নিষ্ঠুর মনে হল। মুন্নি কেনো একবার বুঝতে চেষ্টা করল না তাকে, এই ভেবে চোখের জলে সিক্ত হয় রাজু। আর কিছু করার থাকে না। সে একদিন মুন্নিকে একটা চিঠি লিখে বসে।

"মুন্নি,
তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে, জানো খুব কষ্ট হয়েছে। সেদিন থেকে প্রতিটি নির্ঘূম রাত কেটেছে চোখের জলের সাথে গল্প করেই। কিন্তু আর তো পারছি না। তাই কষ্ট গুলোকে ভুলতে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি। অবশেষেও আমি তোমায় ভালোবাসি।
ভালো থেকো।
ইতি রাজু"

চিঠিটা পড়তে পড়তে মুন্নির চোখে থেকে কোন এক অজানা কারনে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পরল। যদিও ভালোবাসা কি তা বুঝত না মুন্নি, তার মনে হয়েছিল একটা জীবন শুধুমাত্র তার কারনে যদি অকালে ঝরে যায় তখন সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।


মুন্নি রাজুর সাথে দেখা করল কোন এক নির্জন বিকেলে।
বিশাল একটা বট গাছের নিচে দুজন বসল
মুন্নি শুধু একটা কথা বলল,
"আপনি এইসব আজে বাজে কিছু করবেন না, আমি আপনার পাশেই থাকব।"
রাজুর মনটা অনেক দিন পর একটু শীতল হাওয়ার ছোয়া পেলো ।


শুধুমাত্র একটি জীবন বাচানোর তাগিদেই মুন্নির কাছে অজানা এই ভালোবাসা নামক বস্তুটার অভিনয় করে যেতে লাগলো মুন্নি। রাজু বলত, সে শুধু শুনতো ।

সময় এভাবেই গড়িয়ে যায়। মুন্নি এস এস সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়।এর মধ্যে মুন্নি অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে, সেও রাজুকে ভালোবাসে। দুজনার ভালোবাসার গভীরতায় হারিয়ে যেতো দুজন। ভালোবাসার দিন গুলি প্রতিটা মুহুর্ত পরম মধুরতায় কাটত তাদের। মুন্নি অত্যন্ত সহজ সরল একটা মেয়ে ছিলো, রাজুর কথা সে তার আম্মুর কাছে বলল একদিন। অত্যন্ত আদুরে এই মেয়েটার উপর ছোট্রবেলা থেকে কখোনো কঠর হতে পারেনি তার মা। তাই সেদিনও পারল না , শুধু বলল-
"সবকিছু ভেবে চিন্তে করো"
মুন্নি বলল-"আমি তোমার লক্ষী মেয়ে না? আমি খারাপ কিছু করতেই পারি না। রাজু আমার জন্য অনেক ভাবে। ও আমাকে তোমাদের মতই ভালোবাসে।"
মুন্নির মা মেনে নিল সবকিছু।


দুজন দুজনার ইচ্ছা গুলোকে অনেক গুরুত্ব দিত। খুটিনাটি ঝগড়াও হত তবে সেটা সাময়িক। অনেক রাত জেগে কথা বলত দুজন আবার সকাল হলেই দেখা হত। রাজু মুন্নিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেত। মুন্নির এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হল।


রাজু একদিন মুন্নিকে বলল-
"চল বিয়ে করে ফেলি , পাঁচটা বছর তো প্রেম করেই কাটিয়ে দিলাম। এভাবে অবাধ মেলামেশা করছি আমরা, সবাই খারাপ বলবে।"
"আসলেই কথাটা ঠিক বলছ , আমারও আর ভাল্লাগে না, চলো বিয়েটা করেই ফেলি, একটা বাবু হবে আমাদের, তুমি বাবা হবে আমি মা হব, হি হি হি"
রাজু মুন্নির হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে বলে-
"লক্ষী বউটা আমার"
"হিমম, সবসময়ই"


রাজুর পরিবার থেকে মুন্নির পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে বিয়ে হয় ওদের। শুরু হল নতুন স্বপ্নবোনা, নতুন আলপনা আঁকা। খুব সুখেই কাঁটে ওদের দিনগুলি।

নতুন সংসার , নতুন জীবন , নতুন কতগুলো মানুষের সাথে বসবাস । সবকিছু সাজাতে হবে নতুন করে , মুন্নি নিজের মত করে সাজাতে চায় তার স্বপ্নের পৃথিবী । স্বপ্নের নকশী কাথা বুনতে সে ব্যস্ত হয়ে পরে । চটপটে মুন্নি একদিন রাজুকে বলে -
"তোমার সাথে আমার যে কথা ছিলো , তুমি কিন্তু রাখতেছো না"
রাজু অবাক হয় না , কারন মাঝে মাঝে এমন ধুমকেতুর মত কিছু কথা বলে চমকে দেওয়াটা মুন্নির অভ্যাস । অনেক দিন ধরে রাজু এই স্বভাবের সাথে পরিচিত । তাই সে অবাক না হয়ে বলে-
"বলে ফেলো কি কথা"
"ওমা , তুমি ভুলে গেছো ?আমাদের না দুজন মিলে সংসারটা সাজানোর কথা , তুমি তো আমাকে হেল্পই কর না ,পচা একটা"
রাজু মুন্নির কাধের উপর হাত রেখে বলে
"সংসারটা তোমার মুন্নি , তোমার মত করে সাজাও । আমি তোমার পাশে আছি ।"
"এতো সুন্দর করে কথা বলার কি আছে , আমাকে একটু বকাও দিতে দিবানা"
মুখটা বাঁকিয়ে বলে মুন্নি
রাজু একগাল হেসে বলে
"ওরে সোনা বউটারে তুমি আগে থেকে প্ল্যান করে রাখছিলা যে আমাকে বকা দিবা । কিন্তু ম্যাডাম সমস্যা হলো আমিতো তোমাকে তোমার থেকে বেশি বুঝতে পারি"
"আমিও চাই তুমি আমাকে আমার থেকে বেশি বুঝ ।"
রাজুকে জড়িয়ে ধরে বলে মুন্নি
অনন্ত সুখের ভেলায় ভাসে দুজন ।


মুন্নি নিজের মত করেই সাজাতে লাগলো ভালোবাসার উদ্যান খুব যত্ন করে । কিন্তু রাজুর মা তার কাজগুলোতে প্রায়ই আপত্তি করতেন । রাজুর মা মুন্নির উড়ন্ত স্বভাবটা পছন্দ করত না । মুন্নি চেষ্টা করে নিজেকে পাল্টাতে কিন্তু যেই মেয়েটি ২১ বছর একইভাবে বাচতে শিখেছে খুব সহজে সে নিজেকে কিভাবে পাল্টে ফেলবে । তাই মুন্নিকে সহ্য করতে হত অনেক কটু কথার যন্ত্রনা ।



একা একা নিরবে কাঁদে মুন্নি , রাজুকে কখোনো বুঝতে দিতনা । সে লক্ষ্য করে রাজু যেন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । মুন্নির সাথে তেমন কথা বলেনা , অনেক রাতে বাড়ি ফেরে অফিস থেকে । রাজুর এই পরিবর্তনের কারন খুঁজতে দিশেহারা হয়ে যায় মুন্নি । কারনটা সে একদিন খুজে পায়ও , মুন্নি জানতে পারে পরিবারের এই অশান্তির কথা , মুন্নির নানা রকম দোষের কথা সবকিছু রাজুর কানে দিতো রাজুর মা । অশান্তির কারন আর দোষগুলো মুন্নির বলেই রাজু মনের যন্ত্রনার আগুন নেভাতে রাজু নেশাগ্রস্ত হয়ে পরেছিল ।
মুন্নি সবকিছু জানতে পেরে নির্বাক হয়ে যায় , কাঁদতেও যেনো ভুলে যায় ।



একদিন রাতে রাজু বাসায় ফেরার পর মুন্নি বলে
"রাজু তুমি এসব কেনো করছ । দেখবা আমি তোমার লক্ষী বউ হয়ে যাবো , তোমার মা যা বলবেন আমি তাই শুনব । প্লিজ তুমি আগের মত হয়ে যাও"
রাজু ভ্রূ কুন্চিত করে বলে
"তোমাকে আমি এতো অবহেলা করি তুমি বুঝনা তোমার কি করতে হবে , তোমার হাতে পায়ে ধরি আমাকে তুমি তোমার বাধন থেকে মুক্তি দাও"
মুন্নি রাজুর দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে বলে
"আমার চোখে চোখ রেখে বলোতো তাহলে তুমি ভালো থাকতে পারবা ?"
রাজু কঠিন দৃষ্টিতে মুন্নির দিকে তাকিয়ে বলে-
"হ্যা পারব"
মুন্নি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাজুর দিকে কিছু বলতে পারে না ।

পরের দিন সকালে মুন্নি তার মায়ের কাছে চলে আসে । প্রায় একমাস কেটে যায় , এর মাঝে রাজুর বাড়ি থেকে অথবা রাজু কোন খবর নেয়নি মুন্নির ।মুন্নি অতিরিক্ত ভেঙ্গে পরে । সারাদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে , মুন্নিকে স্বান্তনা দিতে পারেনা কেউ ।


সকালে একটা চিঠি এসেছে কোর্ট থেকে । হ্যা,সেটা রাজুর পাঠানো ডিভোর্স পেপার ছিলো । মুন্নিকে রাজু ফোন দিয়ে বলে
"ডিভোর্স পেপারটা পাঠালাম"
এরপর ফোনটা কেঁটে দেয় রাজু ।
মুন্নি অনেক্ষন বসে থাকে পেপারটা সামনে নিয়ে , কলমের একটা আচরে শেষ হয়ে যাবে সকল স্বপ্ন । কিন্তু সেদিন রাতের কথাগুলো বারবার সামনে চলে আসে মুন্নির । রাজু মুক্তি চেয়েছিল মুন্নির কাছে তাই শেষ পর্যন্ত মুন্নি ইতি টানল
তার ভালোবাসার সকল বাধনের । পাথরে পরিনত হয় মুন্নি ।


আসলেই কি মুক্তি দিতে পেরেছিল সে রাজুকে ? তার মন থেকে ? শুধু কাগজ কলমেই কি তাদের সম্পর্কটা আবদ্ধ ছিলো ? এসব কথা ভেবে সারাদিন চোখের জল ফেলে মুন্নি । সেদিনের পর থেকে রাজুর আর কোন ফোন আসেনি মুন্নির কাছে ।


এরপর থেকে আর কোনদিন হাসেনি মুন্নি । সেই হাস্যজ্জল মেয়েটা কেমন যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে । এই সময় আর সেই সময়ের পার্থক্য কতটা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আজো তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে । সেই প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু তার দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না            

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন