Pages

ভালোবাসার সাত রং

                                                                                                                                                                                                               অনিন্দিতার ছুটির দিনের বিকেলেবেলাটা কাটে খুব সাদামাটাভাবে।
সারা সপ্তাহের কাজের পর ছুটি পেয়ে ইচ্ছে মতন নাক ডুবিয়ে ঘুমিয়ে নেয় সবাই।
মেয়ে তামান্না এমবিএ করে সম্প্রতি ব্যাংকে ঢুকেছে। প্রাইভেট ব্যাংক । যেমন বেতনের বাহার তেমনি হাড়ভাঙা খাটুনি। রাত আটটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। ছুটি পেলে খেয়ে না-খেয়ে ঘুমায়।
ছোটো ছেলে ইন্টার্নি ডাক্তার। সবাই কেবল ওর উপর কাজ চাপায়। সে নিজেও কাজ পাগল। কাজ পেলে সে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কাজটাই কেবল করতে থাকে। ছুটির দিনে সে-ও ঘুমায় পাগলের মতো। সময় মতো ডেকে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। নইলে পুরো দিন কোরবান করে দেবে ঘুমে।
আর রইলেন ইলিয়াস সাহেব। তিনি বারোশ স্কোয়ার ফিটের এই সুসজ্জিত এপার্টমেন্টটির গর্বিত কর্তা। অনিন্দিতার স্বামী। রিটায়ার করতে আর মাত্র দুবছর বাকি। পাসপোর্ট অফিসে কাজ করেন। প্রতিদিন এত পাসপোর্টে সই-সাবুদ করতে হয় যে বাড়ি ফেরার পর মানুষটির দিকে তাকালে রীতিমতো কষ্ট লাগে অনিন্দিতার। এই লোকটির জন্যে ছুটির দিন মানে স্বর্গোদ্যানে বেড়াতে যাওয়া। ঘুম না এলেও এমন আয়েস করে শুয়ে থাকে যে মনে হবে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ বুঝি সে।
এই পরিবারে অনিন্দিতার কেবল অফুরন্ত অবসর। সামান্য রান্নাবান্না আর ঘর গেরস্থালীর কাজ ছাড়া তেমন কিছু নেই করার। তাও ঠিকে ও স্থায়ী কাজের মানুষ থাকায় কোনো বাধ্য বাধকতা নেই কাজের। করলে করো , নইলে শুয়ে থাকো। কিঞ্চিৎ চোখ-কান খোলা রাখলেই হল। অবশ্য, একসময় হাত ভরা কাজ ছিল ওর । এতো কাজ যে করতে গিয়ে হিমসিম খেতে হতো। বাচ্চাদের পড়ালেখা করানো, নিয়মিত স্কুলে নিয়ে যাওয়া, ঘড়ির ঘন্টা-মিনিটের কাঁটা ধরে রান্না-বান্না করা, স্বামীর মন যোগানো, আত্মীয়-স্বজন ম্যানেজ করা, সামাজিকতা সব তো ওকে একাই সামলাতে হতো। তখন এত ফাঁকা সময় কই গালে হাত দিয়ে ভাববার?
এই পরিবারে অনিন্দিতা সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতেও একা । বাবুর্চি আর কাজের বুয়ার সাথে কয়েক ঘন্টা কাটানোর পর হাতে জমে থাকে অফুরন্ত সময়। এসময়টুকু সে ঘুমিয়ে , টেলিভিশন দেখে আর আত্মীয় -স্বজনের সাথে অবিরাম কথা বলে কাটায়।
ছুটির দিনগুলোতেও সে একা। কেননা, সবাই তখন গাঢ় ঘুমে মগ্ন। এতো ঘুম আসে কোথ্বেকে ভেবে আকুল হয় মন।
এসময়টায় মন খারাপ করে কখনো ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে কলোনীর দৃশ্য দেখে কিংবা নিজের রুমে গিয়ে টেলিভিশর ছেড়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখার পুররাবৃত্তি করে। দেখা হয়ে গেছে , তবু তাকিয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কী যে এর আবর্ষণ তা বলে বোঝানো দায়।
পঞ্চাশোর্ধর্ অনিন্দিতার সময় কাটে এভাবেই।

খ.
আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনে অনিন্দিতার পরিবারে যা হয় হয় আজো তাই চলছে। পিছনে সবাই ভূতুড়ে ঘুম ঘুমিয়ে নিচ্ছে আর সে বসে রয়েছে ব্যালকনির গ্রীল ধরে।
টেলিভিশন দেখে এসেছে এতোক্ষণ। চোখে ব্যথা হচ্ছে কড়া আলোর চাপে।
তবু কখনো দাঁড়িয়ে কিংবা কখনো পাতা চেয়ারে বসে নীচের দৃশ্য অবলোকন করতে থাকে।
ওদের এই কলোনীটা স্বাধীনতার পরপরই তৈরি হয়েছে। তখনো ঢাকা শহরটা বসবাসের যোগ্য ছিল ; কিলবিল করা অগুনতি মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়া শহরটাকে বছরের পর বছর ধর্ষণ করে মেরে ফেলেনি। তখনো কেউ ভাবত না যে বুড়িগঙ্গায় গোসল করা আর দশ বছরের জেল ফেরতের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সমান কথা ।
সূত্রাপুরের মিলব্যারাকের দিকে গিয়ে বুড়িগংগার পাড়ে বসলে সন্ধ্যার পর ঠিকই চাঁদের দেখা মিলত। নদীর মৃদু হাওয়া গায়ে মেখে চাঁদের দিকে চোখ রাখলে সত্যি সত্যি স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো সুখ অনুভব হতো অন্তরে।
ওদের কলোনীর পাকা উঠোনে দাঁড়ালেও চাঁদের দেখা মিলত। পায়ে - পায়ে তখন এতো বাড়ি-ঘর কোথায় ঢাকা শহরে? নারকোল , সুপারি আর বড়ো বড়ো গাছের ফাঁকে ঠিকই নববধূর মুখের মতো চাঁদ কথা কয়ে উঠত। গরমকালে ফ্ল্যাট বাসীরা উঠোনেই বারোটা বাজিয়ে ফেলত। এমনি কমনীয় পরিবশে তখন।
অথচ বেশিদিন আগের কথা তো নয়। ছিয়াত্তর সাতাত্তর সনের ঢাকা তখন। মুড়ির টিন ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো গণ-বাহন তখন আর কই। একটা একতলা বাড়ি , একটা কালো টেলিফোন আর একটা ভোক্স ওয়াগন যার আছে সে তো মহা বড়লোক। তার দিকে তাকায় কজন !
মানুষের সম্মান ছিল সমাজে। পাশাপাশি সম্পদেরও আভিজাত্য ছিল । কারণ, সেটি সবাইকে সবার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে অর্জন করতে হতো। সমাজ তখনো লুটেরা বণিকশ্রেণীর দখলে চলে যায়নি!
শুরু থেকে চোখের সামনে কতো যে পরিবর্তন হল এই কলোনির ফ্ল্যাট- মালিকদের। কোনো কোনো ফ্ল্যাটের ছয়বার পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়েছে মালিকানা।
কতো রকমের মানুষ এখন চোখে পড়ে। চিনতে পারে না অনিন্দিতা। মাঝে মাঝে দারোয়ানও খেই হারিয়ে ফেলে ।
অজস্র অচিন মুখ। ইচ্ছে করে না এখন আর নীচে নেমে বাতাস খেতে। বরং উপর থেকে কলোনীর ভেতর মানুষের আনগোনা দেখতে মন্দ লাগে না। না চিনুক, তবু অপিরচিত মানুষের একটা আকর্ষণ থাকে, যা রোধ করা সত্যি মুশকিল।
কে কিভাবে হাঁটছে , কোন্ ফ্ল্যাটে যাচ্ছে , কীরকম জামা- কাপড় পরেছে , কী গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করছে সব খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সময় কেটে যায় অনিন্দিতার।
বিকেল হতে না হতেই সবার আগে যে ছেলেটা নেমে এসে মাঝ উঠোনে গলা খাঁকারি দেয় ওর নাম রাসেল। জিমে যাওয়া শরীর স্বাস্থ্য। স্কিনটাইট গেঞ্জি গায়। মুখের গড়ন পুরনো দিনের ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো।
সে মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে ব্যায়াম করে আর গলা খাঁকারি দেয় জোরে জোরে। চোখ থাকে দুই নম্বর বিল্ডিংএর তিন তলার ব্যালকনির দিকে।
একটু পর বরফ খন্ডের মতো ফর্সা পেলব একটি মেয়ের চেহারা ভেসে আসে ঐ বারান্দায়। চোখাচোখি আর হাসাহাসি। আর কিছু হয় কিনা অনিন্দিতার জানা নেই। হয়তো হয় কিংবা হয়তো হয় না। হয়তো ফাস্ট ফুড খেতে মাঝে মধ্যেই পিজা হাটে চলে যায়। কথা হয় । গানের ডিভিডি বিনিময় চলে।
ওর এসব জানার কথা নয়। সে লিজা নামের মেয়েটাকেও চেনে না। আর রাসেল নামের ছেলেটাও ওর পরিচিত নয়। কারণ , ওরা দুজনই ভাড়াটে। ভাড়াটেদের ব্যাপারে এই ঢাকা শহরে কম মালিকদেরই আগ্রহ থাকে। ওরা শ্যাওলার মতো , ভেসে আসে , ফের চলে যায়। কোথায় , কোন্খানে তাদের ঠিকানা তা নিয়ে বাড়িওলারা মাথা ঘামায় না। যতো বড়ো লোক আর ক্ষমতাশালীই হউক না কেন ভাড়াটে , বাড়িওলাদের কম আগ্রই কাড়তে পারে তারা।
অনিন্দিতাও বিরক্ত হয়ে ভাবে,‘ কোথ্বেকে যে আসে সব আজবের দল। এসেই প্রেমের কলেজে ভর্তি হতে চায়। ফালতু। ’
রাসেলের পর পরই খ্যাপাটে বাড়িওলা হামদু সাহেব নিজের ফ্ল্যাট থেকে নেমে আসে নীচে। তিনি একা মানুষ। ছেলেমেয়ে সব বিদেশে। কোনোকালে আমলা ছিল। এখানে বিশাল ফ্ল্যাটে নিজে রেধে খায় আর পুরো কলোনী জুড়ে মাতব্বরি করে বেড়ায়।
ওকে দেখেলে সবাই লুকোতে চায়। অযাচিত ও অগুনতি প্রশ্নের ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে থাকে রীতিমতো। অপরিচিত ও ভাড়াটে হলে তো কথাই নেই।
রাসেল লুকোতে গিয়েও মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়। মুখোমুখি পড়ে যায়। ব্যস , পড়লেই হল, প্রতিদিন একই কথা।
‘হু আর যূ?’
‘স্যর আমার নাম রাসেল। ’
‘হয়্যার ডু যূ লিভ ইন? হয়্যার?’ হুংকার দিয়ে ওঠে হামদু সাহেব।
‘চাইর নম্বর বিল্ডিংএর তিন-এ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকি। ’
‘হুয়াট ইজ ইয়োর কুয়ালিফিকেশন? টেল মি? ’
‘এমবিএর ছাত্র। ’
‘স্পিক ইন ইংলিশ । ডোন্ট যূ নো ইংলিশ বিং এ স্টুডেন্ট অব এমবিএ? ’ বলে চেঁচাতে থাকে।
তিনতলার সেই বরফ কন্যা ততক্ষণে ব্যালকনি ছেড়ে সুড়–ৎ করে ঘরে ঢুকে গেছে। আর রাসেল ইঁদুরকলে আটকে থাকা ইঁদুরের মতো আপ্রাণ চেষ্টা করছে হামদু সাহেবের প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পেতে।
অনিন্দিতা উপরে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করে আর মনে মনে হাসিতে ভেঙে পড়ে।
এরকম কিছু মজাদার দৃশ্য ওর নির্জন আনন্দের উপকরণ।

গ. 
আজো এরকম এক মজাদার দৃশ্য দেখার আগ্রহ নিয়ে গ্রীল ধরে অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওর ঠিক পিছনে ঘরের ভেতর সবাই ঘুমে অচেতন। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
শুধু স্পি¬ট এসি দুটো থেকে সমুদ্রের ঢেউর শব্দ ভেসে আসছে অবিরাম।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর সে হেলান-চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয়। দৃষ্টি গ্রীল ছাড়িয়ে লনের উপর, শূন্য ও উদাসীন সেই দৃষ্টি।
রাসেল আর বরফকন্যার কথা চালাচালি হচ্ছে চোখে চোখে। মেয়েটি চাইলেই নেমে আসতে পারে নীচে। কথা বলতে পারে অনর্গল। অনেকেই বলে , আজকাল এসব নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। দল বেধে বেইলি রোডে গিয়ে ফাস্ট ফুড খাওয়া , বসুন্ধারার সিনেপে¬ক্সে গিয়ে ইংরেজি ছবি দেখা, গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে যাওয়া এসব তো এখন পান্তাভাত। সেখানে রাসেল-বরফকন্যার এই চোখাচোখির কেচ্ছা মোটেই যুগসম্মত নয় বলে অনিন্দিতার মনে হয়।
কিছুক্ষণ বাদে হামদু পর্বও শেষ হয়ে গেল। প্রতিবারই লোকটি কাউকে না কাউকে না-চেনার ভান করে এবং অকারণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে নাতি সমান ছেলেপিলেদের।
আজ এক-দুটো কথার পরই ছেড়ে দেয় রাসেলকে। হামলে পড়ে দারোয়ানের উপর। ‘ডু য়ূ নো মি? আই এ্যাম দ্য ওল্ডেস্ট ওনার অব দিজ কলোনী। হুয়াই ডোন্ট যূ শো মি রেসপেক্ট? হুয়াই ?’ বলে বলে পুরো কলোনী কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দারোয়ান যত বলে ‘স্যর, আমি আপনেরে দেখবার পাই নাই। তাই সালাম দিবার পারি নাই। ’ তত হামদু সাহেবের গলা চড়তে থাকে। একসময় গালাগালি শুরু হয়ে যায় , ওয়ার্থলেস-হোপলেস দিয়ে আরম্ভ হয়ে সমাপ্তি ঘটে স্টুপিড - রাসকেল -ডাফারে । গালাগালির যত না তীব্রতা তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি কন্ঠের শক্তি। যাতে দূর থেকেই মনে হবে এখানে কিছু একটা হচ্ছে।
অনিন্দিতা এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত। এসব আর এখন ওর মনে আনন্দ যোগায় না। সে পাতাবাহার গাছের মতো গ্রীলের ধারে অলস সময় কাটায়। ওর ঠিক পিছনে সাজানো গুছানো ঘুম-বাড়ি।
সেখানে প্রতিটি ঘরে এসির সোঁ -সোঁ বাতাসে ভাদ্রের প্রচন্ড গরমেও শীতের হাড়কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে , কম্বলে গা ঢেকে ঘুমিয়ে থেকেও এর থেকে নিস্তার মেলে না। ঘুম চোখে রিমোট নিয়ে মাঝে মাঝে তা কমাতে হয় !
অনিন্দিতা অলস চোখে একবার নীচে তাকায়। হামদুর গলাবাজি যত এগোচ্ছে তত খোকা য়ূ-ক্যালিপটাসের নীচে দাঁড়িয়ে রাসেলের অঙ্গ-ভঙ্গি বাড়ছে। ইশারায়-ইঙ্গিতে মেয়েটিকে যে সে কী বোঝাতে চাইছে তা ওর মগজে ঢুকছে না। মেয়েটির চোখে একটাই ভাষা , কৌতূহল। আর কিছু নয়।
এই মোবাইল আর কম্পিউটার যুগে এসব বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ ভীষণ বেমানান লাগছে অনিন্দিতার কাছে। রাসেলটা কি গেঁয়ো?
ওর নিজের কথা মনে হচ্ছে এ সময়টায়।
পচাত্তর ছিয়াত্তর সনের কথা। অনিন্দিতার বাবার বাসা সূত্রাপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাওয়া -আসা মুশকিল হওয়ায় ওকে থাকতে হচ্ছে রোকেয়া হলে। ইলিয়াসের নতুন চাকুরি। বাসা নেবার মতো টাকা নেই।সাত-আটজন মিলে রামপুরার দিকে কোনোরকমে মেসে বসবাস করে।
বিকেল হলেই অনিন্দিতার তখন উচাটন মন ঘরে রয় না। কখন ইলিয়াস চিরকুট পাঠাবে সেজন্য অপেক্ষা।
তারপর পাশাপাশি দুজনার বসে থাকা। দরকারী কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দুজনার কারো মুখে রা নেই। অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রয়েছে পাশপাশি। ভাল লাগার অদ্ভুত মাদকতা, কিভাবে যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামত নিজেরা টেরই পেত না।
ওকে একবার দেখলেই হত । শরীর মন সব চনমন করে উঠত। ক্ষণে ক্ষণে কান্না পেত। কোথ্বেকে যে এত কান্না আসত তা এখন ভাবলে হাসি পায়। সারাক্ষণ এক ধরনের বালখিল্যতা গ্রাস করে রাখত ওর সমস্ত শরীর-মন।
সেসব স্মৃতি এখন অনিন্দিতার কাছে প্রাগৈতিহাসিক আমলের কোনো অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়। এখন ছেলেরা চিরকুট কি বস্তু তা হয়তো জানেও না। হল থেকে বেরোতে বেরোতে একটা এসএমএস , হলের কিনারে এসে একটা এবং গেটে দাঁড়িয়ে একটা মিসকল। ব্যস , হয়ে গেল। রোদ নেই বৃষ্টি নেই ঘন্টার পর ঘন্টা হল গেটে দাঁড়িয়ে থেকে গররাজি এক বোর্ডারের কাছে চিরকুট গুঁজে দিয়ে অপেক্ষা করার স্মৃতি কি এখন কারো কারো কাছে হাস্যকর বলে মনে হবে না?
রাসেলটা কি ওদের সময়ের কেউ নাকি?
নইলে সে চোখাচোখি -দেখাদেখির মাঝে কী এমন মজা পায় ?
অনিন্দিতা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
সে বিরক্ত, চোখ বুঁজে তা থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ঘ.
এমনি সময় ঘটনাটা ঘটল।
ঘটনা ঠিক নয়।
অপরিচিত কিছু শব্দ। হামদুর হম্বি তম্বি নয়, আবার দারোয়ানের কাকুতি মিনতির মতোও লাগছে না।
অনিন্দিতার তন্দ্রা মতন পাচ্ছিল । চোখ খুলতে মন সায় দিচ্ছে না।
একই রকম দৃৃশ্য কল্পনা করে সে চোখ বুঁজে থাকবার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে।
একটু বাদে চেঁচামেচির ধরনে ওর সন্দেহ গাঢ় হয়।
সে দাঁড়িয়ে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ঘটনাটি।
অনিন্দিতা একেবারে থ।
দুজন হিজড়া জোর করে কলোনির ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
দারোয়ান যত তাড়া দেয় ওদের বের হয়ে যেতে তত ওরা চেঁচাতে থাকে,‘ ওই হারামীর ব্যাটা। বুঝস না , অনারকলি আইছে সেলিমের খোঁজে, বুঝস না বিনদাস কুনহানের।’ বলে দারোয়ানের গালে ঠোকর বসায়। পাশে দাঁড়ানো হামদু একেবারে চুপসে যায়। কোনো কথাই যেন মুখ থেকে বেরোচ্ছে না। একবার কিছু একটা বলতে গেল , ওমনি একজন হামদুর সামনে হাত -পা নেড়ে গান গেয়ে উঠল, বন্ধু তিনদিন তর বাড়িৎ গেলাম দেখা পাইলাম না/ আইতে যাইতে বারোয়ানা উশুল হইল না। ’
অন্যজন পাশ থেকে ধোঁয়া দেয়,‘কী যে কস, অহন আবার বারোয়ানা আছেনি? অহন পাঁচশ ট্যাকা।’ বলে সে হাত ঢুকাতে চায় হামদুর শার্টের পকেটে।
হামদু হম্বি -তম্বি ছেড়ে এক লাফে দূরে সরে আসে।
অনিন্দিতা মজা পায় দৃশ্যটা দেখে।
দারোয়ান ফের চেঁচায় ।
কিন্তু দারোয়ানের কথা ওদের কানে ঢোকে না। ওদের লক্ষ্য কেবল রাসেলের উপর।
রাসেল তখনো বরফকন্যার সাথে তাকাতাকি নিয়ে মশগুল । এরকম কাজে নিবেদিত থাকায় টেরই পায়নি কখন দুই হিজড়া এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
দারোয়ানের হাজারবার নিষেধ সত্বেও ‘জানেমন’ বলে ছুটে আসে রাসেলের দিকে।
সহসা চোখের সামনে ওদের দেখে রাসেল প্রথমে ভড়কে যায়। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারে না।
অনিন্দিতার বেশ লাগে রাসেলের এই অপ্রস্তুত হবার দৃশ্যটি।
রাসেলের ভ্যাবচ্যাকা খাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে একজন হিজড়া বলে ওঠে‘, ওর নাম আনারকলি। তর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে আছে। ’
‘আমি?’ আকাশ থেকে পড়ে রাসেল। সে চোখ বড় বড় করে দুজনার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় অসহায় লাগে রাসেলকে এসময়। অনিন্দিতা বেশ মজা পায় । হাসি এসে যায় ঠোঁটের কোণে।
আনারকলি নামের হিজড়াটি বেশ সেজেগুঁজে এসেছে। চুলে খোঁপা বেধেছে, ঠোঁটে মেখেছে লিপস্টিক, চোখে দিয়েছে কাজল আর চাপাভাঙা গালের হনুয় ঘষেছে লাল রঙ। শরীরে পেঁচানো রঙচঙে জর্র্জেট শাড়ি , পায়ে লাল ফিতার জুতো জোড়া আর মুখে পান। এই নিয়ে আনারকলি সলজ্জ চোখে রাসেলের দিকে একবার তাকাচ্ছে আবার পরক্ষণে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রেমের আতিশয্য বড় তীব্র হয়ে ওকে গ্রাস করে ফেলেছে। ছাড়া পাওয়ার কোনো রাস্তা খোলা নেই আনারকলি নামের হিজড়াটির সামনে।
সঙ্গী হিজড়াটি কন্ঠকে বিকৃত করে উত্তর দেয়,‘ ওমা, নাগর য্যান কিছু বোঝে না। দুইদিন আগে কফি খাইতে বেইলি রোডে গ্যালা, ওইখানেই তো আনারকলির মন কাইরা নিলা। এক দেহাতেই আনারকলির দেহ-মন সব কাইরা নিছ তুমি । মাইয়াডা খায় না, ঘুমায় না। খালি কয় তুমার কতা। বহুত কষ্টে জিগাইতে জিগাইতে তুমার ঠিকানা পাইছি। আর অহন তুমি কও আমরা কেডা? হায় বেরহম জানেমন, তুম কিত্না পাথ্বরদিল নিকলা! হায় পরওয়ারদিগার , হায় খোদা মেহেরবান!!’ বলে সে শরীরে হিলে¬াল তুলে নাচের ভঙ্গি করে।
অনিন্দিতার হো: হো: করে হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঘটনাটা কদ্দুর গড়ায় দেখার জন্যে সে ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে রয়েছে। কৌতূহলের নিুচাপ এত বেশি যে সময়ের সাথে সাথে রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়ছে সে। কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না সেখানে।
রাসেল বাঁচার জন্যে দারোয়ানকে ডাকতে লাগল,‘ আরে ভাই, ওদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ওদের দেখতে পচ্ছেন না? আজব কতগুলো মানুষ ভেতরে ঢুকে পড়েছে আর আপনি হাওয়া খাচ্ছেন?’
রাসেলের তাড়া খেয়ে দারোয়ানটি হাতে একটি লাঠি নিয়ে ছুটে আসে ওদের দিকে। কিন্তু কাছে এসেই কেমন যেন চিমসে যায়। হিজড়া দুজনার দিকে তাকিয়ে সে নিজে মিন মিন করতে শুরু করে।
রাসেল চেঁচায় ,‘ তাকিয়ে দেখছেন কি? তাড়াচ্ছেন না কেন এদের? রং দেখেন নাকি?’
এবার দারোয়ানটি চেঁচিয়ে ওঠে‘, বাইর হন , বাইর হন কাইতাছি। ’
কিন্তু হিজড়া দুজন দারোয়ানের কথায় মোটেই কর্ণপাত করছে না।
আনারকলির সঙ্গীটি ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে,‘ হুদা কি আমিই কতা কমুনি ? তুই তর ডারলিংরে কিছু কবি না?’
‘কি কমু আমি? আমার লজ্জা করে। ’ বলে সে ওড়নায় দাঁত কামড়ায়।
‘ক, কিছু একটা ক।’
‘আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ।’ বলে আনারকলি মাটিতে বসে পড়ে মুখচোখ হাতের তালু দিয়ে ঢেকে ফেলে।
একটু বাদে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলা নেই কওয়া নেই কাঁদতে থাকে । ঝরঝর করে চোখ বেয়ে ওর জল ঝরছে। এক পর্যায়ে রাসেলের হাতটি এক ঝটকায় নিজের সমতল বুকের উপর চেপে ধরে চীৎকার করে ওঠে,‘ আমার মত কেউ তুমারে এ্যাতখানি লাভ করতে পারবে না জানেমন।এ্যাই আনারকলি তুমার জন্য জান দিবে , সাত তলা থেইক্যা লাফ দিবে। সাপের বিষ খাইয়া মারা যাইবে। খোদা কসম, আমার দিকে চাইয়া একবার হাস, আমি চইল্যা যামু। জানেমন , একবার হাইসা বিদায় দ্যাও। ’
অনিন্দিতা এবার সত্যি সত্যি হেসে ওঠে। বাঁকা চোখে একবার তিনতলার বরফকন্যার দিকে তাকায়। সে বহু আগেই পালিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
এবার অনিন্দিতা তাকায় পাগলা হামদুর দিকে। সে এক পা -দু পা করে কখন যে সবার অগোচরে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেছে তা টেরই পাওয়া যায়নি।
কলোনির পুরো উঠোন জুড়ে রয়েছে দুজন হিজড়া আর রাসেল নামের এক ভাড়াটে যুবক। অপ্রস্তুত অপারগ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দারোয়ানটিও আছে সাথে। আর আছে অনিন্দিতার মতো বেশ কয় জোড়া কৌতূহলী চোরা চোখ , যারা
ব্যালকনির আড়াল থেকে মজা লুটতে চাইছে সংগোপনে।
অনিন্দিতা অপেক্ষা করছে এক চরম পরিণতির।
রোমিও -জুলিয়েটের মতো কোনো এক ক্যাটাস্ট্রফির জন্যে নিদারূণ অপেক্ষা ওর।
একটা রক্তারক্তি অবস্থা যা সবাইকে বিস্মিত , উদ্বেলিত ও হতচকিত করে দেবে।
র‌্যাব -প ুলিশ নিয়ে টানাটানি হবে, কলোনি জুড়ে বইবে প্রচন্ড টেনশন।
পত্রিকার পাতা দখল করবে এমন এক সংবাদ যা আপামর মানুষকে আমূল নাড়িয়ে ছাড়বে।
অনিন্দিতা কল্পচোখে দেখতে পাচ্ছে - আনারকলি ওর সেলিম ওরফে রাসেলের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে উন্মাদিনী হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সে একটি ধারালো ছুরি নিয়ে নিজের পেটে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করে বসে।
কলোনির উঠোন জুড়ে কেবল রক্ত।
ঘটনার আকস্মিকতায় কলোনির লোকজন হতভম্ব।
সাক্ষ্যের ভয়ে কেউ বেরোচ্ছে না। অনাগত শংকায় সমস্ত ফ্ল্যাটবাসী থরথর কাঁপছে।
অনিন্দিতা এর ব্যতিক্রম নয়।
ওর কপালেও একটু একটু করে স্বেদবিন্দু জমা হচ্ছে।

ঙ.
এসময় অনিন্দিতার কাঁধে কারো হাত পড়ে। সম্বিৎ ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় ইলিয়াসকে।
ঘুম চোখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
হাতে ধরা একটি লাল গোলাপ। স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে নি:সঙ্গ স্ত্রীর দিকে।
ইলিয়াসের হাতে ধরা গোলাপটির উপর নজর পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে অনিন্দিতা,‘ তুমি কি একটা? আবারও বেডরুমের বাগানে গিয়ে গোলাপ ছিঁড়েছো? কত কষ্ট করি আমি টবের গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখছি তা তুমি জানো?’
‘এই জন্যই তো নিয়ে এলাম। হ্যাপি বার্থডে টু য়ূ।’
সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার চোখ দুটো কুঁচকে যায়। নিজের জন্মদিনের কথা কোনোকালেই মনে থাকে না ওর। বাড়ির কেউ এ ব্যাপারে মাথাও ঘামায় না। ইলিয়াস তো জন্মদিন নিয়ে কোনোরূপ আদিখ্যেতা একদম সহ্য করতে পারে না। ওর কাছে এগুলো বৃটিশদের শেখানো একরকম ন্যাকামো অভ্যেস ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি কোনোকালে।
এতবছর পর পড়ন্ত বয়সে এসে সেই ইলিয়াস নিজে থেকে ওকে ফুল সাধছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা হিসাবে?
চোখে জল চলে আসে অনিন্দিতার। সে হাত বাড়িয়ে ফুলটি নিয়ে মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করে,‘ এটা কি আমার টবের ফুল?’
‘হ্যা।’
‘কী দরকার ছিল ফুলটি ছেঁড়ার?’ অনুচ্চ বন্ঠ অনিন্দিতার।
‘না ছিঁড়লেও এটি একদিন ঝরে পড়ত। তুমি কি একটি ফুল সারাজীবন টবের গাছে জীবিত রাখতে পারবে?’
‘তবু।’ অনিন্দিতার চোখের সামনে পুরনো দিনগুলো চেষ্টনাট গাছের পাতার মতো স্মৃতি হয়ে ঝরে পড়ছে। বিয়ের পরপর ইলিয়াস প্রায়ই ওকে ফুল এনে দিত। ঢাকায় তখন অত ফুলের বাহার ছিল না। হাইকোর্টের সামনে থেকে সংগ্রহ করে আনতে হত। সেই ফুল নিয়ে ওদের সে কি উচ্ছ্বাস ! দুজন দুজনার দিকে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাত। এখন সেসব কথা জোর করে মনে করতে হয়।
ছোট নদীর ধারে একদন্ড দাঁড়িয়ে তখন যে আনন্দ মিলত এখন অনেক বড় বড় উপহার সামগ্রী হাতে পেয়েও সেই অকৃত্রিম আনন্দ আর পাওয়া যায় না।
ভেতরকার সেই উচ্ছ্বাসটুকু যেন উবে গেছে। এখন ধার করে আনন্দ কিনতে হয়। নিজের ভেতর আর আপনা আপনি তৈরি হয় না !
এতো বছর পর আজ ইলিযাসের হাতে ফুল দেখে সেসব কথাই কেবল মনে হচ্ছে ওর।
একটুখানি হতচকিত , কিঞ্চিৎ অভিভূত অনিন্দিতা!
দীর্ঘ অদর্শনের পর আজ যেন পুরনোরূপে প্রিয় কোনো মানুষের দেখা পাওয়া গেল।
‘চল বেডরুমে চল। বসে গল্প করি। ’ ইলিয়াস বলে।
‘ নীচের উঠোনে রোমিও-জুলিয়েট চলছিল। দেখবে না?’
‘আমি তোমাকে চন্ডিদাস -রজকিনীর প্রেমপর্ব দেখাব । চলো। ’ বলে ইলিয়াস ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢোকে। তারপর ডাইনিং টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে অনিন্দিতাকে বলে,‘ কিচেনের ভেতর তাকাও। ’
সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার চোখ পড়ল সেদিকে। সে দেখতে পেল - ওর কাজের বুয়া সালেহা কিচেনের জানালা ধরে দাঁত বের করে বেঢপ রকমের হাসি হাসছে। মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে কিছু অঙ্গভঙ্গিও করছে। একবার মনে হল মোটা কোমর দুৃলিয়ে নেচে উঠল যেন সে।
অনিন্দিতার ঠোঁটের ডগায় ফিক করে এক টুকরো হাসি হেসে এসে গেল ।
ইলিয়াস ওর কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলে উঠল‘, এবার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাও। ’
ডাইনিংরূম থেকে তাকালে নজর সরাসরি ওদের কলোনির বাইরের রাস্তায় গিয়ে হোঁচট খায় । স্পষ্ট চোখে পড়ে সবকিছু। ওখানে মূক ও বধিরদের জন্যে একটি স্কুল রয়েছে। জায়গাটা ঘিরে রয়েছে আজস্র গাছগাছালির ছায়া , এ বৃক্ষভূক নগরে এমন ওয়েসিস মেলা সত্যি কঠিন । জায়গাটা যেহেতু কানাগলি সেহেতু বেশ নিরিবিলি আর নির্জনও বটে।
সেখানে একটা গাছের তলায় এক রিক্সাওলা বেশ আয়েশ করে বসে রয়েছে রিক্সার সীটে। পায়ের উপর ঠ্যাং, হাতে ধরা সিগারেট। ডান হাতে ঝুলানো চেন-ওলা ঘড়ি। গায়ে একটা কালচে রঙের গেঞ্জী আর লুঙ্গি, মাথায় ক্যাপ। সিগারেটে এক একটি টান দিচ্ছে আর মাথা বেঁকা করে তাকাচ্ছে সালেহার জানালা বরাবর।
বয়স সালেহার চেয়ে কম হবে বলেই অনিন্দিতার মনে হল।
সালেহার এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ে হয়েছে। একটি গ্রামে থাকতে মাত্র বার বছর বয়সে সম্পন্ন হয় আর বাকি দুটি ঢাকায় এসে আপনা-আপনি জুটে যায়।
সর্বশেষ জামাই বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়ার ভ্যান গাড়ি চালাত। বাঁজা বলে সে-ও ওকে ত্যাগ করে।
এখন এই রিক্সাওলাটি এসে জুটেছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় ওদের। কিঞ্চিৎ বিটকেলে লাগলেও অনিন্দিতার এজন্য ভাল লাগছে যে এতকিছুর পরও সালেহা ফের স্বপ্ন দেখতে চাইছে। ভারি কোমর দুলিয়ে , হেসে এবং নানারকমের অঙ্গভঙ্গি করে সে যেন এই কথাটাই বলছে বারবার!!
‘চলো। চন্ডিদাস- রজকিনী দেখা হল? ’ বলে ইলিয়াস ওকে বেডরুমে নিয়ে যায়।
দুজনার মুখে হাসির ছটা।
ওরা দুজন গিয়ে দাঁড়ায় বিছানার সামনে ।
ওদের বিছানার কাছে দেয়ালে টাঙানো রয়েছে দুজনার অনেকদিনের পুরনো হাসিখুশি বাধানো একটি ফটো।
ইলিয়াস বলে ,‘ মনে পড়ে? ’
অনিন্দিতা উত্তর দেয়,‘ হারাধন ফিরে পেলে এরকমই হাসিখুশি লাগে সবাইকে। ’ বলে ইলিযাসের চোখে চোখ রাখে।
‘তারিখটা মনে আছে?’ ইলিয়াস স্ত্রীকে বাজিয়ে দেখে।
‘১৯৭১ সনের ১৮ ডিসেম্বর। সূত্রাপুরের আমার বাবার বাসায় এই ছবিটা তুলেছিল নয়ন ভাইয়া। তোমার দাড়ি-টাড়ি ছিল। সেগুলো কামিয়ে তারপর আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে। ’
‘নয়ন ভাইয়া খুব যত্ন করে ছবিটা তুলেছিল, তাই না?’
‘হু। কার ভাই দেখতে হবে না?’
‘আচ্ছা তুমি ধরেই নিয়েছিলে যুদ্ধ থেকে আমি আর ফিরব না? তখন কী ভাবতে ? মরে গেছি আমি?’
‘জানি না অত। ’ অনিন্দিতার গলা থেকে সোহাগ ঝরে। কেন যেন অন্যরকম লাগছে সবকিছু। প্রতিদিনের গতবাধা অলস সময় থেকে ভিন্নতর ; মাত্র একটি ফুল ওকে বদলে দিয়েছে আমূল। শুকিয়ে থাকা নদী যেন সহসা ফুলে ফেঁপে বর্ষার ভরা নদীতে পরিণত হতে চাইছে!
‘এই ছবিটার দিকে তাকালে আজ কাল আমার অন্য রকম অনুভূতি হয় অনি। বলব?’ ইলিয়াস বলে।
‘বলো।’
‘ আজকাল কেন যেন প্রায়ই মনে হয় যদি তখন যুদ্ধের মাঠে শহীদ হতাম তাহলেই যেন ভাল ছিল ! ’
‘কেন?’ চোখ ঘুরিয়ে সারসরি স্বামীর দিকে তাকায় অনিন্দিতা। চোখে মুখে বিস্ময়। একজন পূর্ণ সুখী মানুষের হঠাৎ এমন মানসিক অবক্ষয় কেন অনিন্দিতা তা বুঝতে পারে না।
‘আমি সারাজীবন তোমার হিরো হয়ে থাকতে পারতাম। তোমার ভালবাসা কখনোই কমত না। জাতি শ্রদ্ধা জানাত। সমাজ মাথা নত করত। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সবসময় সবার আদর্শ হিরো হতে পারতাম। এই বৈচিত্রহীন পোকা মাকড়ের জীবন আর ভাল লাগে না। সত্যি ভাল লাগে না আমার!! ’! আবেগের অতিশয্য ওকে এতটাই আগ্রাসী করে তোলে যে ওর চোখ দুটো কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসে ।
ইলিয়াস চোখ থেকে চশমা খুলে মোছার চেষ্টা করে। এ যেন কাচ মোছা নয়; অন্য কিছু।
‘ক্লান্তি এসে গেছে , না? একটা কাজ করবা?’
‘কি?’ চশমার কাচ মুছতে মুছতে উত্তর দেয় ইলিয়াস।
‘আমরা কতক্ষণ এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি চল। দেখো, আমাদের ভেতর প্রেম এসে যাবে আগের মতন। তাকাও।’
ইলিয়াস মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। একটু বাদে ফটো বরাবর ওর কান্না -ঝাপসা চোখ দুটো তাক করে । ইলিয়াসের চোখের পাতা আর পড়ে না। তীক্ষè অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে পরখ করতে থাকে জীর্ণ ছবিটা।
‘শুধু তাকালে হবে না। ফিল কর , ফির করার চেষ্টা কর সেই সময়। ’ অনিন্দিতা বিড় বিড় করে ইলিয়াসকে বোঝায়।
ওরা এবার দুজন মিলে সত্যি সত্যি ফটো-ফ্রেমটা বরাবর দৃষ্টি স্থির করে রাখে এবং অপেক্ষা করতে থাকে কখন ওদের বোধের গভীরে শ্রাবণধারা বইবে।
ওরা তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চোখের পাতায় ব্যথা ধরে যায়।
কিন্তু নিষ্ফলা মাঠে বৃষ্টি আর নামে না!!

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন