Pages

ভালোবাসার পরিচয়

RAFIQ SIR

ভালোবাসা! এ এক অসাধারণ অনুভূতি। পৃথিবীর সব সম্পর্ক আর পরিচয় শক্তপোক্ত হয় তখনই, যখন সেখানে থাকে ভালোবাসা। ভালোবাসা শব্দটা বুঝতে শেখার আগেই আমরা ভালোবাসতে শুরু করি। আর তার সূচনা হয়, যখন সন্তান হয়ে মাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিই। ভালোবাসা তো তাই, যা বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। কিন্তু, প্রকৃতিগত কারণেই ভালোবাসা কখনোই একমাত্রায় স্থির থাকে না। কখনো গাঢ় হয়, আবার কখনো অবহেলা তাকে ফিকে করে দেয়।

যখন আপনি কাউকে ভালোবাসবেন, সেই ভালোবাসা আপনাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করবে। ক্রমেই সেই ভালোবাসা হয়ে উঠবে আপনার জীবনের পথচলার চালিকা শক্তি। লক্ষ্য করে দেখুন, আপনি যাদের ভালোবাসেন, তাদের অনুকরণ করেন, তাদের আদেশ অনুসরণ করেন, তারা যা কিছুতে খুশি হয়, তাই করার চেষ্টা করেন। আবার যা কিছু তাদের কষ্ট দেয়, তা থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তাদের ভাবনায় আপনার অন্তর প্রশান্ত হয়, আবার তাদের সান্নিধ্যে থাকা সময়গুলো হয় দিনের সবচাইতে মধুর সময়। তাদের কোন সংবাদ আপনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। আর এই অনুভূতির প্রকটতা যখন তীব্রতর হয়, পৃথিবী অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করে আপনার বদলে যাওয়া। ভালোবাসা আপনার প্রায়োরিটিগুলোকেও পরিবর্তন করে দেবে। আগে যা গুরুত্বহীন মনে হত, সেটাই হয়ত হয়ে উঠবে মহা গুরুত্বপূর্ণ। এই ভালোবাসা হতে পারে কোন মানুষ, কোন উদ্দেশ্য, ভালো চাকুরী, গাড়ি কিংবা কোন লেটেস্ট গ্যাজেট।

মানবজাতির প্রতি রহমাতঃ
আমরা সকলেই আমাদের নবী মুহাম্মাদﷺ কে ভালোবাসি জীবনের চেয়েও বেশি। যার মাহাত্ম্যের কথা হোক মুসলিম কিংবা অমুসলিম, উভয় দিককার দার্শনিক আর বিদ্বানদের দ্বারা স্বীকৃত। সঙ্গী-সাথীদের কাছে যেমন ছিলেন একজন ভালো বন্ধু আবার ছিলেন পথপ্রদর্শক; স্ত্রীগণের জন্য একজন প্রেমময় স্বামী; কন্যাদের নির্ভরতার সুশীতল ছায়া; উম্মাহ’র এক যোগ্য অধিনায়ক, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং সফল সংস্কারক- যিনি সবচেয়ে অসভ্য এক বেদুইন জাতিকে পরিণত করেছিলেন ইতিহাসের সর্বোচ্চ সুশৃঙ্খল এক জাতিতে।
আল্লাহর একত্ববাদ নিয়ে তার প্রচারিত বাণী সকল যুগের সব সমস্যারই সমাধান প্রদানে সক্ষম। কিন্তু আমরা কতজন সত্যিকার অর্থেই তাঁর এই মহান শিক্ষার মাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টা করেছি? আমরা কি আসলেই জানি, কি ছিল তাঁর বাণী? তাঁর মাধ্যমে কুর’আনে আমাদের জন্য যে জীবন ব্যবস্থা পাঠানো হয়েছে, আমাদের জন্য আজও রয়ে গেছে শুধুমাত্র বিপদের সময় তিলাওয়াতের বই হিসেবেই। অথবা, বিয়ে-শাদীর এক্সক্লুসিভ গিফট হিসেবেই। আমরা কতজন, বিপদে কিংবা সুখের সময় কুর’আনের কাছ থেকে পরামর্শ নেবার জন্য ছুটে যাই?
রসূল ﷺ কখনোই মিথ্যা বলতেন না, কোনো মানুষ এমনকি কোনও প্রাণীর সাথেও প্রতারণা করেননি, কখনো ওয়াদা ভাঙেননি। ক্ষমা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম এক সেরা গুণ। তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তায়েফের সেই গোত্রপ্রধানকে যিনি তাঁকে চরমভাবে অপমানিত করেছিল এবং সেই সকল লোককে, যারা তাকে পাথর মেরে রক্তে রঞ্জিত করেছিল। তিনি শুধু ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি তাদের জন্য দুয়াও করেছিলেন। তিনি সামাজিক বৈষম্য আর সকল প্রকার জাতিগত ব্যবধানের দেয়ালকে ধূলিসাৎ করেছিলেন তার বিদায় হজ্জের ভাষণে।
“অনারবদের ওপর আরবদের প্রাধান্যের কোনো কারণ নেই। মানুষ সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট। জেনে রাখো, নিশ্চয়ই এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, আর জগতের সব মুসলমান মিলে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসংঘ।”

তিনি ন্যায়ের সর্বোত্তম নিদর্শন ছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, অপরাধের শাস্তি শুধুমাত্র গরীব দুঃস্থদের দেয়ার কারনেই পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছিল। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন আমাদের প্রতিবেশীদের (হোক সে মুসলিম কিংবা নন মুসলিম) সাথে সর্বোত্তম ব্যাবহার করতে। প্রতিবেশীর হক আদায়ের প্রতি আল্লাহর আদেশের কড়াকড়ি আরোপ করা দেখে, একবার তিনি মনেই করে ফেলেছিলেন আল্লাহ হয়ত সম্পদের অংশীদার হিসেবে প্রতিবেশীকেও অন্তর্ভুক্ত করে দিবেন। তিনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে কাঁদতেন আর তাঁর অনুসারীদের তাগিদ দেন তারা যেন এক থাকে এবং ভাষা, জাতি আর গোত্রে বিভক্ত না হয়ে যায়।

“স্মরণ রেখো, আজকের এই দিন, এই মাস যেমন মহিমান্বিত, মক্কার হেরেম যেমন পবিত্র, প্রতিটি মুসলমানের ধনসম্পদ, সবার ইজ্জত-সম্ভ্রম এবং প্রতিটি মুসলমানের রক্তবিন্দু তোমাদের কাছে সে রকমই পবিত্র। আগের বিষয়গুলোর পবিত্রতা নষ্ট করা যেমন তোমরা পরিত্যাজ্য ও হারাম বলে জানো, তেমনি কোনো মুসলমানের সম্পদ, সম্ভ্রম ও জীবনের ক্ষতি সাধন, তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ, মহাপাপ।”

সংখ্যালঘু অমুসলিমরাও তাঁর রাজ্যে শান্তিতে বাস করতেন। ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক মর্যাদা আর সম্মান যাই হোক না কেন, তিনি সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছিলেন। এক সময় যেখানে মেয়ে শিশুর পিতা হওয়া সম্মানহানিকর বলে মেয়ে শিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া হত, সেই সমাজে তিনি নারীজাতির সম্মানকে সমুন্নত করেছিলেন এমন মাত্রায় যেখানে, নারীর সর্বোত্তম মর্যাদাকে নিশ্চিত করা হয়েছিল। কখনো মায়ের সেবা ও তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে, স্ত্রী’র যত্ন নেয়ার মাধ্যমে কিংবা কখনো কন্যাকে ভালোবাসার মাধ্যমে বেড়ে তোলার মাধ্যমে। তিনি শিখিয়েছিলেন যে, আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করে এবং ব্যয় করে তাঁর সম্পদের ভালো অংশগুলো থেকে, যে ইয়াতীমের ঘরের ব্যবস্থা করে আর যে বিধবাকে জীবনধারণে সাহায্য করে।

নিশ্চিতভাবেই, কেউ যদি রসূলﷺ কে ভালোবাসার দাবি করেন, কারো অধিকার নেই সে ভালোবাসার দাবিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করার। এ কথা ঠিক, তবে আমাদের উচিত এই ব্যাপারে নিজেদের অন্তরের সততাকে নিজেরাই যাচাই করে দেখা। যখনই আমরা নিজেদেরকে তাঁর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেব, আমরা স্বীকার করি বা নাই করি, অটোমেটিকেলিই তখন আমরা তাঁর আনীত জীবনাদর্শের প্রতিনিধি হয়ে যাব। ভালোবাসার দাবিদার তো ভালো কথা, কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি সত্যিই রসূলﷺ এর কাছ থেকে আমাদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান চাই?
আসুন না, সকলেই আমরা রসূলﷺ কে অনুসরণ করার মাধ্যমে তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসার প্রমান করি। চলুন, তাঁর চমৎকার সব ঘটনাগুলো মনে গেঁথে নিই আর অন্যের কাছে বর্ণনা করি আমাদের কাজের মাধ্যমে। আসুন, নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি, আসলেই কি তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসার দাবিতে আমরা সত্যবাদী? নাকি শুধু মুখের বুলিতেই সে ভালোবাসা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে? তাঁর আনুগত্যের মধ্যেই আছে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, তাঁর ক্ষমা আর তাঁর দয়া।
(হে নবী) তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসো, তাহলে আমার কথা মেনে চলো, (আমাকে ভালোবাসলে) আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের এবং তিনি তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
– সুরাহ আলে ইমরান ।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন