Pages

ভালোবাসা কারে কয়...

ভালোবাসা—বিধাতার এক বিস্ময়কর মূল্যবান সৃষ্টি। ভালোবাসা চোখে দেখা যায় না। হৃদয়ে হৃদয় রেখে অনুভব করতে হয়। সব কল্যাণ বা মঙ্গলময় ও অকল্যাণ ঘটনার মূলে প্রেম-ভালোবাসা শব্দের রয়েছে নিগূঢ় অস্তিত্ব, নির্ভেজাল সম্পর্ক।
প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে ভালোবেসে যেমন সম্রাট শাহজাহান গড়েছিলেন কালের সাক্ষী প্রেমের নিদর্শন ‘তাজমহল’, অন্যদিকে হেলেন প্যারিসের প্রেম ঐতিহাসিক ট্রয় সভ্যতাকে করেছে ধ্বংস। সহস্র বছর ধরে প্রেম-ভালোবাসা যেমন সৃষ্টি করেছে শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, সৃজনশীল কাব্য-কাহিনী, স্মৃতিস্তম্ভ; তেমনি অন্যদিকে সংসার ভেঙে করেছে বৈরাগী, করেছে সন্ন্যাসী, ধর্মান্তর-দেশান্তর। যুগে যুগে ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে, প্রেমে মশগুল হয়ে রচনা করেছেন অজস্র কবিতা কত শত কবি।
তারপরও ভালোবাসা বা প্রেমের সঠিক সংজ্ঞা আজও মেলেনি, জানা যায়নি। তাই তো প্রতিটি ভ্যালেনটাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস একটি প্রশ্ন নিয়েই হাজির হয়— ‘ভালোবাসা কারে কয়?’ একি শুধুই যাতনাময়?
ভালোবাসা নিয়ে কালজয়ী উপন্যাস-গল্প-সিনেমা-নাটক-গান-কবিতা রচিত হলেও সত্যিকার প্রেম রহস্যময়, দুর্বোধ্য। আজও প্রেমের রহস্য এত সুকঠিন, সুবিশাল। প্রেম বিচিত্র বলেই পুরোপুরি জয় করা সম্ভব হয়নি। তাই তো এই শব্দটিতে সবার দুর্নিবার আকর্ষণ। আর আকর্ষণ থাকবে নাই-বা কেন? ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীতে আছে কিই-বা!
ভালোবাসা মানে কি হাতে হাত রেখে পার্কে ঘোরা? ভালোবাসা মানে কি কাঁধে বা কোলে মাথা রেখে গল্প বলা? ভালোবাসা মানে কি প্রেমিকার চুলের সুঘ্রাণ?
না! এসব শর্ত আমি মানি না।
তবে কি ভালোবাসা মানে দেহ সীমার বাইরে দুটি শুদ্ধ হৃদয়ের নির্মল আত্মীয়তা!
ভালোবাসা মানে নিজেকে কষ্টের আগুনে পুড়িয়ে মনকে খাঁটি সোনা করে গড়ে তোলা।
নাকি ভালোবাসা মানে রাধার ডাগর চোখের জল?
আর এ প্রশ্নের উত্তর জানা হয়নি বলেই একাকী কেটে গেল এতগুলো বর্ণিল বসন্ত, লাল টক্টকে অনেক ‘ভালোবাসা দিবস’। শুধু ‘ভালোবাসা’ শব্দের মানে খুঁজে পায়নি বলে আজও কাউকে বলা হলো না—
‘পৃথিবীর সব প্রেম দেব নর
আর বিশুদ্ধ অন্তর!
যদি বলো হেসে,
আর— এট্টুসখানি ভালোবেসে
চলো যাই-সখী, নিরুদ্দেশে।’
কখনও মনে হয় ভালোবাসা মানে মুক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের কলির মতো—‘তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও/আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে/আরো কিছু নাহি চাই গো।’
অর্থাত্ তুমি যাকে ভালোবাস তাকে মুক্ত করে দাও। সে যদি তোমাকে ভালোবাসে তাহলে তোমার কাছে ফিরে আসবে। এখানে ত্যাগই মুখ্য।
ডেল কার্নেগীর মতে, পৃথিবীতে ভালোবাসার একটিমাত্র উপায় আছে, সে হলো প্রতিদান পাওয়ার আশা না করে ভালোবেসে যাওয়া। অর্থাত্ সেই ত্যাগের গুণেই মহীয়ান হওয়ার কথা।
রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘প্রেম এমনই বস্তু যা শুধু মস্তিষ্কে নয়, বুকের প্রতিটি রক্তকণিকার মধ্যে উপলব্ধি করতে হয়। তিনি সারাজীবন মানসী প্রতিমার ধ্যানেই মগ্ন থেকেছেন। তাকে স্পর্শ করতে পারেননি। প্রিয়ার বিরহে কাতর কবি নজরুল ইসলামও ধরতে পারেননি রহস্যময়ীর শাড়ির আঁচল। তাই তো তিনি লিখেছেন—
‘নাই-বা পেলাম আমার কণ্ঠে তোমার কণ্ঠহার
তোমায় আমি করিব সৃজন এ মোর অহংকার।’
প্লেটো বলেছেন—প্রেমের পরশে প্রত্যেকে কবি হয়ে ওঠে। কয়েক লাইন কবিতা লেখার অপচেষ্টা করে আমি যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছি, এটাও প্রেমের পরশে কি-না বলা মুশকিল। প্রেম এবং পুরুষ দুটোই রহস্যময়! পুরুষেরা অবশ্যই ভিন্ন কথা বলে থাকেন। জে.বি. ইয়েটস বলেছেন, যে পুরুষ একটি নারীকে বুঝতে পারে, সে পৃথিবীর যে কোনো জিনিস বুঝতে পারার গৌরব করতে পারে। তারা পুরুষ বলেই হয়তো নারী হৃদয়ের রহস্য খুঁজেছেন। কিন্তু পুরুষের জটিল মন সমুদ্রের চেয়েও একটু বেশি গভীর নয় কি? যার কখনও তল খুঁজে পাওয়া যায় না, গভীরতা পরিমাপ করা যায় না। রহস্য উদ্ঘাটন এক জনমে তো নয়ই, আর জনমেও সম্ভব কিনা ভাবার বিষয়। পুরুষের মন কখনও মনে হয় হেমন্তের আকাশ; যা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। যেখানে কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি, কখনও করে অনাসৃষ্টি। যে আকাশে কল্পনায় শুধু মেঘ হয়ে ভাসা যায়, ঘুড়ি হয়ে ওড়া যায়! বাস্তবে তাকে কখনও ছোঁয়া যায় কি? মনে হয়, দূরে মাটির সঙ্গে মিশেছে কোথাও, তবু ধরতে তারে পারিনি আমি আজও। যুগে যুগে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে রচিত হয়েছে কত কবিতা, কত গান। প্রেমের তরে কেউ হয়েছে কোরবান। তারপরও ‘ভালোবাসা’ শব্দটির শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েই গেছে। কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, মনীষীরা প্রেমের বিভিন্ন বিচিত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ভালোবাসাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তারপরও ভালোবাসা সমুদ্রের তলদেশের মতোই আজও রহস্যময় হয়েই দেখা দেয়। নিম্নে প্রেমের কিছু সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো।
* মানুষের একটি শাশ্বত ও মহান প্রয়োজন হচ্ছে প্রেম।
—আনাতোল ফ্রাঁস
* ভালোবাসার কোনো অর্থ নেই, কোনো পরিমাপ নেই।
—সেন্ট জিরোথী
* যেখানে প্রেম নেই, সেখানে সত্যি নেই। কেবলমাত্র তারই মূল্য আছে যে কোনো কিছুকে ভালোবাসে, ভালোবাসা না থাকলে নিজের অস্তিত্ব না থাকারই শামিল। —ফয়ের বাখ
* খ্যাতির চেয়ে ভালোবাসা ভালো। —বেয়ার্ড টেলর
* যাকে সত্যিকারে ভালোবাসা যায় সে অতি অপমান, আঘাত করলে, হাজার ব্যথা দিলেও তাকে ভোলা যায় না।
— কাজী নজরুল ইসলাম
* ভালোবাসা যে পেল না, আর ভালোবাসা যে কাউকে দিতে পারল না, সংসারে তার মতো দুর্ভাগা আর নেই। —কীটস
* প্রেম হচ্ছে সবকিছুর শুরু, মধ্য এবং অন্ত। —লার্কভেয়ার
* ভালোবাসা তালাবদ্ধ হৃদয়ের দুয়ার মুহূর্তে খুলে দেয়। —টমাস মিডলটন
এখানে আশার বাণীর সুর শোনা যায়। তার মানে ভালোবাসা এমনি এক অদৃশ্য শক্তি যার ক্ষমতাবলে পৃথিবীর অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। ভালোবেসে পাথরেও ফুল ফোটানো সম্ভব; অনেকটা এরকমই।
* একমাত্র ভালোবাসাই সারাতে পারে সব রোগ। ভালোবাসার আকাশেই জ্বলে হৃদয়ের শুকতারা। প্রেম জীবনে ধ্রুবতারা। —গ্যাটে
* সোনায় যেমন একটু পানি মিশিয়ে না নিলে গহনা মজবুত হয় না, সেরকম ভালোবাসার সঙ্গে শ্রদ্ধা, ভক্তি না মেশালে সে ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
—নিমাই ভট্টাচার্য
প্রেম জীবনকে করে ঐশ্বর্যবান, হৃদয়কে করে বিশাল। সার্থক ভালোবাসা দুঃখ-যন্ত্রণা জয়ের মহৌষধও বটে। ধন-সম্পদ ফুরিয়ে যায়, আরাম-আয়েস অন্তর্হিত হয়, আশা শুকিয়ে যায়, রূপ-যৌবন সময়ের ব্যবধানে বিবর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা অবিনশ্বর। ভালোবাসা স্বর্গীয়। মানুষ মরণশীল। তাই মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হয়। ভালোবাসা অমর। তাই তো সোফোক্লিস বলেছেন—হে প্রেম, তোমার শক্তি অপ্রতিরোধ্য, তুমি মরণের পরেও হয়েছো জয়ী। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুগে যুগে ফ্যাশনে ও রুচিতে পরিবর্তন এসেছে, বদল এসেছে ভালোবাসা প্রকাশের ধরনেও। তাই বলে প্রেমের তাত্পর্য, পবিত্রতা ভুলে গেলে হবে না। ইদানীংকার বিশেষ করে টিনএজ ছেলেমেয়েরা প্রেমের সঠিক অর্থ এবং যথার্থ মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়ে সাময়িক আবেগে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে
দেহকেন্দ্রিক প্রেমের দিকে বেশি ঝুঁকছে বা ঝুঁকতে চায়। ফলে তারা না বুঝে বিপথগামী হচ্ছে এবং অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়ে সত্যিকার প্রেমের অপমান-অবমূল্যায়ন করছে।
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন—যে ভালোবাসা দু’জনের দেহকে দু’দিক থেকে আকর্ষণ করে মিলিয়ে দেয় সে ভালোবাসা নয়, সেটা অন্য কিছু বা মোহ আর কামনা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, প্রেম হচ্ছে দুটি আত্মার নির্মল আত্মীয়তা।
শেক্সপিয়র বলেন, প্রেম চোখ দিয়ে দেখে না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। প্রেম হাতে হাত রেখে নয়, কোলে মাথা রেখে নয়, চুলের ঘ্রাণ শুঁকে নয়; হৃদয়ে হৃদয় রেখে অনুভব করতে হয়। মন দিয়েই মন ছুঁয়ে দেখতে হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-শেক্সপিয়রের সঙ্গে একমত হয়ে ছন্দে ছন্দে বলতে চাই—
‘হাতে হাত রাখি না আমি/মনে মন রাখি/
মনের রঙে মন মিশিয়ে/ শুদ্ধ ছবি আঁকি।’
মানুষ সৌন্দর্যপিপাসু। সুন্দর সব সময় মানুষকে টানে, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু বাইরের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে মনকে ছোট করা উচিত নয়। সময়ের ব্যবধানে রূপ-যৌবন এক সময় বিবর্ণ হয়ে যাবে। মন—যার মধ্যে সযত্নে লুকানো রয়েছে কর্তব্য-বিশ্বাস-ভালোবাসা। এগুলো হচ্ছে শিকড়, তাই চিরসবুজ। দেহসীমার মধ্যে প্রেমকে সীমাবদ্ধ করা নিতান্তই বোকামি। সত্যিকার সৌন্দর্য শুধু মনের চোখ দিয়েই দেখা সম্ভব।
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক লিও তলস্তয় যিনি তার প্রিয়া ভ্যালেরিয়া আর্সেনেভকে উদ্দেশ করে বলেন—‘এরই মধ্যে তোমার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গেছি আমি। কিন্তু বাইরে নয়, তোমাকে ভালোবাসার শুরুটা হোক ভেতর থেকে। তোমার ভেতরটা দেখতে চাই আমি। ভালোবাসতে চাই ভেতরের তোমাকে। তোমার রূপ এক ঝলকে ঝলসে দিতে পারে যে কাউকে। মুহূর্তের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে যে কোনো পুরুষের হৃদয়। তাই রূপ দিয়ে তোমাকে চেনা যাবে না। তোমাকে চিনতে চাই আত্মা দিয়ে।
লিউ তলস্তয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আত্মাকে উপলব্ধি করতে চাই। ভেতরের মানুষটাকে আবিষ্কার করার দুর্গম ইচ্ছা বারবার মনকে তাড়া করে। তাই কবি-দার্শনিকদের মতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ছন্দের মিল খুঁজে ফিরি। অজস্র শব্দে সাজাই কবিতার লাইন—
‘প্রেম কি কেবল রূপের মোহ/জানিস তোরা কেহ?
তুষের আগুনে জ্বললেও হৃদয়/শুদ্ধ রাখিস দেহ।
ভালোবাসা ভালো বটে/মহাদামি আরো
রূপে মুগ্ধ হয়ে সখা/মন ভাঙিস না কারো।’
প্রেমের সংজ্ঞা যা-ই হোক—প্রেম শাশ্বত, প্রেম পবিত্র, প্রেম স্বর্গীয়। ভালোবাসা আছে, থাকবে প্রিয়-প্রেয়সীর হৃদয়জুড়ে, স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে, বন্ধুত্বে, ভাই-বোনের নির্ভেজাল সম্পর্কে, বাবা-মার নির্ভেজাল স্বার্থহীন আদর-যত্নে। শুভাকাঙ্ক্ষী, কোনো কাছের মানুষের শাসনে-বারণে। শুধু ভালোবাসা দিবসটি ঘিরেই ভালোবাসাবাসি নয়, সত্যিকার ভালোবাসা স্থায়ী হোক সবার অন্তরে, সবসময়ের জন্য।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন