Pages

নিষিদ্ধ ভালবাসা

ভুমিকা

প্রেম মানুষের জীবনে বলে আসেনা। এই গল্পের প্রধান চরিত্র একটি ছেলে, যে প্রান দিয়ে ভালবাসত তার প্রেমিকাকে। তাদের ভালবাসা ছিল, পৃথিবীর দুই মেরুর মতন, একজন উত্তর মেরু আর একজন দক্ষিণ মেরু। দু’জনের মাঝের টান ছিল এতটাই প্রবল, যেন চুম্বকের অদৃশ্য আকর্ষণ। দু’জনার ভালবাসায় কোন ফাঁকি ছিল না, কোন প্রতারণা ছিল না, একে অপরকে নিজেদের প্রানের চেয়ে বেশি ভালবাসত। যেমন দুই মেরু একত্র হতে পারেনা এই পৃথিবীর জন্য, সেই রকম এই দু’জনার ভালবাসার মাঝে আসে কঠিন পৃথিবীর ন্যায় অন্যায়। সেই রকম এক গল্প এই ছেলেটার, যে আপনাদের সামনে নিজের জীবনের কিছু ঝরা পাতা খুলে নিয়ে এসেছে, আপনাদের শোনাতে।

আমন্ত্রন
সন ২০০০, নভেম্বর মাসের শেষের দিকে, আমি তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এই পৃথিবীর বুকে আমার বাইশটা বসন্ত কেটে গেছে। বাবা মায়ের এক মাত্র ছেলে আমি, অভিমন্যু তালুকদার। কলকাতায় শীত এমনিতে একটু দেরি করেই আসে। শীতের সকাল, চারদিকে একটু কুয়াশা আর ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু মন টাকে কেমন ভাললাগা ভালবাসায় ভরিয়ে দেয়। দিন টা ছিল রবিবার, হাতে কোন বিশেষ কাজ ছিল না তাই বসার ঘরে বসে খবরের কাগজের পাতা উলটাচ্ছিলাম এক কাপ চা নিয়ে। আমাদের বাড়ি দু’তলা, নিচের তলায় ভাড়াটে আর দোতলাটা আমাদের। মা রান্না ঘরে রান্না করছিল আর বাবা প্রত্যেক দিনের মতন বাজারে গিয়েছিলেন। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।
মা রান্না ঘর থেকে ডাক দিয়ে বলল “অভি একবার নিচে গিয়ে দেখত কে এলো? হয়তো খবরের কাগজ ওয়ালা টাকা নিতে এসেছে।”
নিচে নেমে দরজা খুলতেই দেখি সামনে একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক এবং একজন ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে।
আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিলেন যে আমার মা বাড়িতে আছেন কি না? আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দেই যে মা বাড়িতে আছেন। বসার ঘরে বসার সময় ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন যে তিনি আমার এক দুর সম্পর্কের মামা হন, সাথে তার স্ত্রী।
মা বসার ঘরে ঢুকেই চমকে গেল “কিরে শশাঙ্খ কি খবর? কত দিন পরে দেখা, আর এটা তোর বউ, মেঘনা? ভালো ভালো। এত দিন পরে মনে পড়লো আমাদের কথা?”
মা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, শশাঙ্খ আমার দুর সম্পর্কের মামা। তাদের বাড়ি বসিরহাট অঞ্চলে, কোলকাতা থেকে দুরে, গ্রামে। শশাঙ্খরা তিন ভাই, তিন বোন। ছোটো ভাই সুব্রতর বিয়ে, তাই নেমন্তন্ন করতে এসেছে। সব থেকে ছোটো বোন এখন অবিবাহিতা আর ভাইয়ের বিয়ের পরে ছোটো বোনের জন্য ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে।
আমার মা স্কুল টিচার, মায়ের স্কুল আর তাদের বাড়ি কাছাকাছি। মা যখন নতুন নতুন স্কুলে পড়াতে শুরু করে, তখন বেশ কয়েক বছর মা তাদের বাড়িতে ছিলেন। সেই সব অনেক পুরানো কথা। কথায় কথায় আর জানতে পারলাম যে, আমার জন্মের বছর দু’এক আগে, আমার মায়ের দুর সম্পর্কের মাসি, শশাঙ্খর মা, তার কনিষ্ঠ সন্তানের জন্ম দেন। শশাঙ্খের ছোটো বোন, শুচিস্মিতা। বাড়ির সবার ছোটো বলে শুচিস্মিতা সবার আদরের।
আমার জন্ম হয়েছিল মায়ের মাসির বাড়িতে, কিন্তু আমার যখন ***** বছর বয়স তখন আমরা কলকাতায় চলে আসি, তাই আমার সেই ছেলেবেলার কোন কথা মনে নেই।
মা আমাকে গল্প বলত, কি ভাবে শুচিস্মিতা আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত আমের বাগানে, পুকুর ধারে। খেলত আমার সাথে। ওর চেয়ে আমিই ছোটো ছিলাম তাই আমাকে নিয়েই ওর খেলা চলত। কিন্তু আমার সেই সব ছোটো বেলার কথা কিছুই মনে ছিল না। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম ওদের গল্প।
গ্রামে সবার অনেক বড় বড় সংসার হয়ে থাকে, শশাঙ্খদের ও বড় সংসার, সবাই একসাথে থাকে একান্নবর্তি পরিবার। শশাঙ্খর একটি পুত্র সন্তান আছে, স্কুলে পড়ে।
মা জানিয়ে দিলেন যে সুব্রতর বিয়েতে আমরা যাবো, আমন্ত্রন রক্ষা করতে। আমার জেনে বেশ ভালো লাগলো যে অনেক অনেক দিন পরে কোন আত্মিয়ের বিয়েতে যাবো। আমি জীবনের বেশির ভাগ সময় বাংলার বাইরে কাটিয়েছি। পড়াশুনা বাইরে, শুধু কলেজ করতে তিন বছর কলকাতায়। তাই বিয়েতে যাবো শুনে বেশ আনন্দিত হয়ে উঠলাম। তার সাথে সাথে মনের কোণে উঁকি মারল এক বার শুচিস্মিতার সাথে দেখা করার। কে সেই কন্যে যার সাথে আমি ছোটো বেলায় অনেক খেলেছি? মনের ভেতরে এক আকুল ইচ্ছে জেগে ওঠে শুচিস্মিতাকে দেখার।
প্রথম দেখা
সুব্রতর বিয়ে, ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। বিয়ের দিন সকাল বেলা, বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, সোনালী রদ্দুর মাখা সকাল বেলায় আমরা বেড়িয়ে পড়েছিলাম মায়ের মাসির বাড়ি যাবার জন্য। দমদম থেকে বসিরহাট অনেক দুর, বাস কিছুক্ষণ পরে শহর ছাড়িয়ে ধান ক্ষেতের মাঝখান থেকে দৌড়তে শুরু করে। জানালার ধারে বসে আমি সেই ছেলেবেলার ধুয়ে যাওয়া কথা স্মরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শুচিস্মিতা, নাম শুনে যেন মনের কোণে উঁকি মেরে ছিল এক ভাললাগার ভাষা। কেমন দেখতে মেয়েটা, যে আমার সাথে ছোটো বেলায় খেলত, আম কুড়াত আম বাগানে, পুকুর পাড়ে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। শীতের সময়ে আমাকে বুকে চেপে ধরে ঠাণ্ডা দুরে সরিয়ে রাখত। আমি হারিয়ে গেছিলাম আমার পুরানো স্মৃতি রোমন্থনে, কিন্তু বিশেষ কিছু মনে পড়ে না আমার।
এমন সময় মা ডাক দিলেন “বসিরহাট কাছাকাছি আসছে, এর পরের স্টপে আমাদের নামতে হবে।” বসিরহাটের দু’টো স্টপ আগেই আমরা নেমে পড়লাম, মা জানালেন যে মায়ের মাসির বাড়ি বাস রাস্তা থেকে মাইল তিনেক দুরে, আমাদের হেঁটে যেতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে এখানে রিক্সা পাওয়া যায় না?
তার উত্তরে বাবা বেশ গম্ভির গলায় জানিয়ে দিলেন “ব্যাটা, গ্রামে এসেছিস, গ্রামের হাওয়া বাতাস অনেক শুদ্ধ, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নে। এই হাওয়া তো আর দমদমে পাবি না।”
পিতৃ বাক্য, কে বা খণ্ডন করিতে পারে। তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই ঠিক আছে পায়ে হেঁটে না হয় যাবো।
অনেক খানি হাঁটার পরে আমরা মায়ের মাসির বাড়ি পৌঁছলাম। বাড়িটা সত্যি বেশ বড়, পুরানো আমলের গ্রামের বাড়ি। মায়ের মামা অনেক জমিজমা ছিল, বেশ বড় চাষি ছিলেন। অনেক আগে তিনি দেহ রক্ষা করেছেন। তিনি চলে যাবার পরে, শশাঙ্খর দাদা, সুমন্ত বাড়ির হাল ধরেন এবং বাকিদের মানুষ করেন। নিজে আর পড়াশুনা করতে পারেননি, কিন্তু বাকি সবার পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। তিনি এখন চাষবাস দেখেন। বিয়ের বাড়ি চারদিকে লোকে লোকারণ্য, সানাই বেজে চলেছে, মানুষের কোলাহল, চেঁচামেচি তারাহুর যেন সবার লেগে আছে। আমি একদম নতুন এই রকম পরিবেশে, এই প্রথম কোন আত্মিয়ের বিয়ে বাড়িতে গেছিলাম আমি। সবাই আমার অচেনা অজানা। মা আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন পরিবারের বাকিদের সাথে। আমার মন পরে ছিল শুচিস্মিতা কে দেখার জন্য। জিজ্ঞেস করতে দ্বিধা বোধ করছিলাম, কি করে জিজ্ঞেস করি যে শুচিস্মিতা কোথায়? লোকে কি ভাববে। অবশেষে মা মেঘনা মামি কে জিজ্ঞেস করলেন যে শুচিস্মিতা কোথায়। আমার তো নাম টা শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। মেঘনা মামি উত্তর দিলেন যে যেহেতু শুচিস্মিতা বাড়ির সবার ছোটো তাই হবে হয়ত বন্ধু বান্ধবীদের সাথে কোথাও গল্প করছে বা দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে। ঠিক সেই সময় এক দল মেয়ে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।
মেঘনা মামি ওদের মধ্যে একটা মেয়েকে ডেকে বললেন “পরী এদিকে আয়, দেখ উলুপি দি এসেছে।”
ঐ দলের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে এসে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল, আমি ভাবলাম তার মানে এটাই শুচিস্মিতা।
মা মেয়েটির চিবুকে হাত দিয়ে মাথায় একটি ছোটো চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করে বললেন “তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস রে।” মেয়েটি মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।
আমি আড় চোখে শুচিস্মিতার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, উপচে পড়া যৌবন সুধা পান করতে থাকলাম। মেয়েটি বেশ ভালো দেখতে, মাঝারি গড়ন, বেশি পাতলা নয় বেশ গোলগাল দেখতে। গায়ের রঙ যেন মাখনের মতন ফর্সা আর ত্বক মাখনের মতন মসৃণ। মাথার চুল বেশ ঘন কালো, লম্বা মনে হল, ঘাড়ের কাছে একটা খোঁপায় বাঁধা তাতে আবার জুঁই ফুল গাঁথা। পরনে ঝলমলে হাল্কা গোলাপি রঙের হাতকাটা সালোয়ার কামিজ। সকালের সূর্যের রদ্দুর যেন পিছলে পড়ছে হাতের ত্বকের ওপরে। মুখাবয়াব ডিম্বআকৃতি, হাসলে দুই গালে টোল পরে তাতে হাসিটা আর বেশি মিষ্টি দেখায়। বাঁকা কাজল আঁকা ভুরু দুটি যেন কালো চাবুক, চোখ দুটি বেশ বড় আর দুষ্টুমিতে ভরা, টিকালো নাক। গলায় একটি পাতলা সোনার চেন ঝিকিমিকি করছে, সাথে একটি সোনার লকেট। কানে সোনার দুলে দুটি মুক্ত বসান। মাথা নাড়িয়ে হাসার ফলে কানের দুল দুটি বেশ নড়ে চড়ে উঠছে সাথে আমার বুকের ভেতরটা হেলেদুলে উঠছে।
আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে মাকে জিজ্ঞেস করে “এটা নিশ্চয় তোমার পুত্র, অভিমন্যু?”
মা উত্তর দিলেন “হ্যাঁ, তোর মনে আছে, ছোটো বেলায় কত খেলতিস তোরা। তুই যেখানে জেতিস সাথে ওকে নিয়ে জেতিস?”
আমার দিকে একটা মিচকি হেসে বলে “বাঃ বা, অনেক বড় হয়ে গেছে তো।” আমি তো থ হয়ে ছিলাম এতক্ষণ ওর রূপ দেখে, গলার স্বর শুনে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে একটু হেসে দেই ওর দিকে।
মায়ের দিকে ফিরে বলল “উলুপিদি আমি পরে তোমার সাথে কথা বলব, আমার না অনেক কাজ।” তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি আমাকে পরী ডাকতে পারো, সবাই আমাকে তাই ডাকে।”
মেঘনা মামি ওর দিকে তাকিয়ে বললেন “তোর তো কোন কাজ নেই শুধু আড্ডা মারা ছাড়া”
কথা শুনে মেঘনা মামিকে জড়িয়ে ধরে পরী বলল “আরে বউদি, এটা তো আমাদের মজা করার সময়।” বলেই বাকি সব বান্ধবীদের সাথে হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। আমার নাকে লেগে রইল শুধু জুঁই ফুলের গন্ধ। আমি তো পাগল প্রায়।
মা এবং মামি কিছুক্ষণ পরে আমাকে ছেড়ে ভিড়ের সাথে মিশে গেলেন। আমি কি করি, কাউকে তো চিনিনা। এমনিতে আমি একটু মুখ চোরা স্বভাবের ছেলে ছিলাম, লোকের সাথে মিশতে আমার সময় লাগতো। বাড়ির বিশেষ কাউকে চিনিনা জানিনা তাই এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে উঠে গেলাম।
ছাদে উঠে কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে এদিক ওদিক দেখতে থাকলাম, গ্রামের সৌন্দর্য। দেখতে দেখতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখি সেই মেয়েদের দল, বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। অত গুলো মেয়েদের মাঝে পরী কে যেন ঠিক একটা রাজরানির মতন দেখতে লাগছিল। যেন কোন রাজকন্যে সখি পরিবেষ্টিত হয়ে কেলি করছে। আমি ওপর থেকে দাঁড়িয়ে আবার পরীর রূপের চমকে হারিয়ে গেলাম। দৃষ্টি যেন নড়েনা দুই সুগোল বক্ষ থেকে। চেপে বসা কামিজ বুকের অবয়াবের ছবি জানান দেয়, পাতলা হয়ে আসা কোমর তার পরেই নিটোল নিতম্ব। মনের ভেতরে যেন ছ্যাঁক করে উঠলো। পাপী মন, যাবে কোথায়, মেয়ে দেখলে হল আর কি। আপন মনে হেসে ফেলি, একি আমি কি আমার দুর সম্পর্কের আত্মীয়া, মায়ের দুর সম্পর্কের বোনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি?
কিছু পরে মেয়েদের দলটা বাড়ির উঠান থেকে ভেতরে হারিয়ে যায়। সারাটা বিকেল কিছুই করার নেই। আমি একা একা ঘুরে বেড়াতে থাকি ছাদে।
সৌন্দর্যের সম্মোহন
নিঃসঙ্গ একা একা ছাদের ওপরে আমি ঘুরে বেড়াতে থাকলাম। বারে বারে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরীর বিমুগ্ধ সৌন্দর্য। মনে হল যেন প্রথম দেখায় আমি প্রেমে পড়ে গেছি। হটাৎ করে মনের এক কোণে ভয় ঢোকে, যদি পরী আমার সাথে কথা না বলে? তারপরে ভাবলাম, কেন কথা বলবে না, আমি তো এক দুর সম্পর্কের আত্মীয় হই। শীত কালের রাঙ্গা সূর্য পশ্চিম আকাশের কোলে ঢলে পড়েছে। বিয়ে বাড়ি আলোয় আলোকিত, চারদিকে মানুষের ভিড়, সবাই সেজেগুজে বরযাত্রী যাবার জন্য তৈরি। সবাই যেন নিজেদেরকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য উন্মুখ। নিচে নেমে জানতে পারলাম যে, কনের বাড়ি অনেক দুর, রাণাঘাট নামে একটি জায়গা। বসিরহাট থেকে প্রায় ঘন্টা চারেকের পথ। বিয়ের লগ্ন সেই মধ্যরাত্রে। বাঙালি বাড়ির বিয়ে বলে কথা আর আমি নিজে বাংলার বাইরে কাটালে কি হবে, আমি ধুতি পাঞ্জাবী পড়তে ভালবাসতাম খুব। তাই সেদিন আমি ঘিয়ে রঙের তসরের পাঞ্জাবী আর ঘিয়ে রঙের ধাক্কা পাড়ের ধুতি পড়েছিলাম। সুব্রত ছাড়া আর কেউ ধুতি পরেনি তাই নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগছিল, সবাই তাকিয়ে দেখছিল আমাকে। আমি একটু অসস্থিতে পড়ে গেছিলাম। অত লোকের মাঝে আমি বড় একা বোধ করছিলাম, বিশেষ কাউকে চিনতাম না তাই, গল্প করার লোক খুঁজে পাইনি। একদিকে দাঁড়িয়ে শুধু পরীর কথাই বারবার মনের মধ্যে ঘুরেফিরে চক্কর দিচ্ছিল।
এমন সময়, পেছন থেকে কেউ আমার হাতা ধরে টান মারে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটি বাচ্চা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে।
আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি “কি হয়েছে?”
ছেলেটার মুখের দুষ্টুমির হাসি আমাকে উত্তর দিল “আমি দুষ্টু, আমার নাম দুষ্টু আমি তোমার শশাঙ্ক মামার ছেলে।”
আমি হেসে দুষ্টুর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললাম “বাঃ বেশ তো। কি ব্যাপার ডাকছ কেন?”
—“আমার ছোটো পিপি পরী, তোমাকে উঠানে ডাকছে।”
আমি জিজ্ঞেস করি “কেন?”
সরল মুখে শয়তানির হাসি হেসে উত্তর দেয় দুষ্টু “আমি কি জানি, নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নাও।” বলেই দৌড়ে পালিয়ে গেল।
আমি তো আহ্লাদে আটখানা, মনের ভেতরে ময়ুর পেখম তুলে নাচতে শুরু করে দিয়েছে, এক দেখায় যাকে ভালবেসে ফেলেছি সে ডাকছে আমাকে। প্রবল উত্তেজনায় ডিসেম্বরের ঠাণ্ডার মধ্যে কপালে ঘাম দিতে শুরু করে দিয়েছে। উঠানে নেমে দেখলাম যে পরী আরও অন্য অনেক মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে, সাথে আমার মা আছেন। বুকের মধ্যে ভাললাগার বেলুনটা হটাৎ করে চুপসে গেলো। ক্ষণিকের জন্য মনমরা হয়ে পড়লাম।
আমায় দেখে মা কাছে ডাক দিয়ে বললেন “কি রে, সাড়া দিন কোথায় ছিলিস তুই?”
পরী মায়ের দেখাদেখি হেসে আমায় জিজ্ঞেস করল “হ্যাঁ অভিমান্যু, কোথায় ছিলে সারাদিন? দেখা পাইনি তোমার।”
আমি তো মুখ ফস্কে প্রায় বলে ফেলেছিলাম যে, তোমার কথা ভাবছিলাম সারাদিন, কখন একটু দর্শন দেবে।
মা জানিয়ে দিলেন যে বরযাত্রীর বাস সন্ধ্যে ছ’টায় ছাড়বে, আমি যেখানে থাকি না কেন আমি যেন সময় মতন বাসে চেপে যাই।
মায়ের কথা শুনে পরী আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে মাকে আশ্বাস দিয়ে বলল “চিন্তা করোনা উলুপিদি, ছোটো বেলায় যেমন চোখে চোখে রাখতাম, ঠিক সেই রকম করে রাখব।”
আমি পরীর দিকে তাকিয়ে দেখি, সুন্দরী কি সুন্দর করে সেজেছে। পরনে কালো সিল্কের সাড়ী, তাতে সোনালী সুতোর কাজ। চুলে খোঁপা, কানে সোনার দুল ঝলমল করছে। আমার মনে হল যেন, স্বর্গের কোন অপ্সরা মর্ত্যে নেমে এসেছে। হাতের ছোঁয়া পাওয়া মাত্রই আমার রোমকূপ গুলো খাড়া হয়ে গেল। নাকে সেই জুঁই ফুলে সুবাস লাগতেই মন আকুল হয়ে উঠলো। পাশে দাঁড়িয়ে পরী, আমার চেয়ে ইঞ্ছি চারেক ছোটো হবে, আমার কাঁধের কাছে মাথা। মুখ পানে চেয়ে দেখি, রূপ যেন ফেটে পড়ছে। টিকালো নাক, বাঁকা ভুরু, কাজলে আঁকা দু’নয়ন, গোলাপের পাপড়ির মতন নরম ঠোঁট দুটি। মনে হচ্ছিল যেন এখুনি জড়িয়ে ধরি। আমার হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে আমায় বলল ওর পাশে হাঁটতে।
উঠানে ওপর দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম, আমার বাঁ পাশে পরী। আমার তো কথা বন্দ, সুন্দরী এক নারী আমার পাশে হাঁটছে এই ভেবে, চেয়েও যেটা বেশি সেটা হচ্ছে যে আমি তো ওর রূপের জালে জড়িয়ে প্রেমে পড়ে গেছি।
পরী আমায় জিজ্ঞেস করল “তোমার ছোটো বেলার কথা কিছু মনে নেই?”
নির্বাক আমি, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম “না”।
পরী কথা বলে চলেছে, আমি চুপ করে শুনে চলেছি “তুমি নাকি পড়াশুনায় অনেক ভালো?”
বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়া দেই আবার “হ্যাঁ”
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল “তোমাকে এই ধুতি পাঞ্জাবীতে দারুন দেখাচ্ছে। সব সময় পড় এইরকম ড্রেস?”
আমার কানে তো পরীর মিঠে আওয়াজ ভ্রমরের গুঞ্জনের মতন লাগছিল, আমি কথা কি বলব শুধু শুনে যাচ্ছিলাম।
“আমি বি.এস.সি পড়েছি, ফিসিক্স নিয়ে। তুমিও তো এক স্ট্রিমে তাই না।”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই “হ্যাঁ”
হটাৎ করে পরীর গলার স্বর একটু ভারী হয়ে আসে “আমি আর পড়তে চাই, এম.এস.সি। কিন্তু আমার বাড়ির লোক আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। উলুপিদি কে দাকার আইডিয়া আমার ছিল। উলুপিদি পড়াশুনা করে স্কুল টিচার হয়েছেন, আমাদের স্কুলে পড়াতেন উলুপিদি। আমিও উলুপিদির মতন পড়াশুনা করে স্কুল টিচার হব। আমি জানি উলুপিদি বললে আমার মা না করবে না।”
পরী হাঁটছে আমার পাশে আমার হাত ধরে, কোমল আঙ্গুলের পরশে শরীরে শিহরণ খেলে বেড়াচ্ছে মাঝে মাঝে। কখন কখন আমার আঙ্গুল গুলো ওর নরম আঙুলের সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আলতো ছোঁয়ায় আমার শিরদাঁড়ায় মাঝে মাঝে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ নেচে চলে যাচ্ছে। ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই আমার চোখ আটকে গেল উদ্ধত বুকের ওপরে, শারীর আঁচলের নিচে ঢাকা কোমল বক্ষ, বক্ষ মাঝে গভীর খাঁজ, উফফ সেই গভীর খাঁজ দেখে মাথা ঠিক রাখা দায়।
পরী থামেনি, কথা বলেই চলেছে “আমি তোমার মাকে, সব জানিয়েছি আর উলুপিদি বলেছেন যে সময় মতন আমার মায়ের সাথে কথা বলবেন। আমি জানি আমার মা, উলুপিদির কথা অমান্য করবে না। আমি শুনেছি যে উলুপিদি নাকি আমাকে ছোটো বেলায় নিজের মেয়ের মতন ভালবাসত, আর আমার মা উলুপিদির কথা শুনত। জানিনা এর মাঝে কি হয়েছে, কেন এতদিন ধরে আমাদের বাড়ির কেউ উলুপিদির খোঁজ নেয়নি। কিছু দিন আগে যখন মা উলুপিদির কথা বলেছিল তার সাথে বলেছিল যে তোমার মাকে খুব মিস করে আমার মা। আমি জানি তোমার মা যদি আমার মাকে কিছু বলে তাহলে আমার মা সেটা অমান্য করবে না।” তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে “কি অভিমন্যু, আমার মা আমাকে পড়তে দেবে? বল না।”
এতক্ষণ ধরে পরীর কথা শুনছিলাম ঠিক তবে মনটা অন্য কিছুতে পরেছিল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নেই, ভাবতে থাকি কি উত্তর দেব।
আমার কাছে কোন উত্তর না পেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু রেগে যায় পরী “সেই তখন থেকে শুধু আমি কতাহ বলে যাচ্ছি, তুমি কি বোবা, কথা বলতে জাননা? শুধু তখন থেকে গাধার মতন মাথা নাড়িয়ে চলেছ। কিছু তো হ্যাঁ কিংবা না, উত্তর তো দেবে নাকি?”
বলে ফেলি যা হবার হবে, বুকের মাঝে রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমি বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ফেল “পরী; তুমি না, খুব সুন্দরী দেখতে।” বলার পরেই আমি চোখ বন্দ করে নেই, গালে আসন্ন চপেটাঘাত বরিষণ হতে চলেছে এখুনি, তার প্রতীক্ষায়।
সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পরী, আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল “আমার কোন কথা শোননি তাহলে? আর এমন বদমাশ ছেলে আমি জীবনে দুটো দেখিনি। জানো কি সম্পর্কে আমি তোমার মাসি হই?” তারপরে আমার হাতে আলতো করে চাঁটি মেরে বলল “তুমি না সত্যি খুব বদ।”
উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আমরা, এদিকে আলো একটু কম, পরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
আমি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সর্ব শক্তি যোগাড় করে বলি “আমি সত্যি বলছি, তোমার সব কথা আমি শুনছিলাম, কিন্তু জানো, তুমি না ভারী সুন্দরী।”
আমার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ফেলে পরী, হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে পড়ছে “থ্যানক্স ফর কমপ্লিমেন্টস। ভারী বদ তুমি, সেটা মানতে হবে।”
আমি জিজ্ঞেস করি “তোমার বান্ধবীরা কোথায় গেল? কাউকে তো সাথে দেখছি না।”
পরী জানাল যে ওর বান্ধবীদের বউভাতে নিমন্ত্রন করা হয়েছে তাই কেউ সাথে নেই; আর যেহেতু বাড়ির সব থেকে ছোটো তাই বান্ধবীরা চলে যাওয়ার পড়ে খুব একা একা মনে হচ্ছিল ওর। কথা শুনে মনে হল হাত বাড়িয়ে পরীর দু’হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নেই। ঠিক সেই সময়ে আমার মা ডাক দিলেন যে বাস ছাড়ছে আমাদের বাসে উঠতে হবে। কপাল চাপড়ে মনে মনে বললাম হে ভগবান, এখুনি কি মায়ের ডাক দেওয়ার ছিল?
পরী আমার দিকে তাকিয়ে বুঝে গেছিল যে, আমি হাত বাড়িয়েছি ওর দিকে। সেটা বুঝে মিচকি হেসে দৌড়ে চলে গেল বাসের দিকে। যাবার আগে ফিসফিস করে বলে গেল “আমি বাসে ওয়েট করব কিন্তু…”
প্রথম চুম্বন
সবার সাথে আমি বাসে উঠে পড়লাম। বেশ বড় লাক্সারি বাস। বাব মা, আত্মীয় সজ্জন সবাই বসে। বরযাত্রী ভর্তি বাস কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে। আমার চোখ থেকে থেকে শুধু পরীকে খোঁজে, কোথায় গেল। কিছুক্ষণ পরে পরী কে দেখতে পেয়ে যেন ধড়ে প্রান ফিরে পেলাম আমি। যাক, বাবা আছে তাহলে।
আমাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে “অভিমন্যু এদিকে এসো, আমি বসার জায়গা দেখে রেখেছি।”
আমি প্রভুভক্ত গাধার মতন চুপ করে পরীর পাশে গিয়ে বসে পরি। জানালার দিকের সিটে পরী আর তার পাশে আমি। বাস চলতে শুরু করে। বাসের মধ্যে এত চেঁচামেচি সবাই যেন হাটে এসেছে, চেঁচিয়ে কথা না বললে নিজের কথাই কানে যায় না। এই চেঁচামেচির মধ্যে থেকে মা বলে উঠলেন যে নিয়ে বিয়েবাড়ি পৌঁছতে অনেক দেরি, সবাই গানের খেলা খেললে সময় কেটে যাবে। সবাই এক কথায় সায় দেয়, হ্যাঁ হ্যাঁ হয়ে যাক একটু নাচ গান। কিন্তু প্রশ্ন, শুরু কে করবে। বাসের মধ্যে যারা বয়স্ক তারা বলে উঠলেন যে কচিকাঁচারা শুরু করুক।
পরী চুপটি করে আমার গা ঘেঁসে বসে, বাসের দুলুনিতে মাঝে মাঝে হাতে হাত ঠেকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পরী আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায় আর কোন কথা না বলে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। আমি তো প্রমাদ গুনছিলাম বসে বসে, সন্ধ্যেবেলায় মনে হয় আমি একটা এটম বম্ব ফেলেছি তাই চুপ করে থাকাটাই বিচক্ষণের কাজ।
এমন সময়ে সামনের থেকে কেউ চেঁচিয়ে ওঠে “আরে, পরী কোথায়, পরী? বাস ছাড়ার পড়ে কোন সারা শব্দ নেই। পরীর তো এমন হবার কথা নয়।”
আমি পরীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম “এই যে, কি হয়েছে, এত চুপচাপ কেন? আমি কি কিছু উল্টোপাল্টা বলেছি যার জন্য রাগ করে বসে আছো? সবাই তোমাকে খুঁজছে, কিছু তো বল।”
আমার দিকে শ্যেন দৃষ্টি হেনে কাতর স্বরে বলল “আমি ভাবলাম যে তুমি আমার কথা শুনছিলে। কিন্তু তুমি আমার একটা কথা শোননি। তুমি কিছু বোঝো না। আমি পড়তে চাই, আমি উলুপিদির মতন স্কুল টিচার হতে চাই।”
“আই এম সরি পরী, কিন্তু সত্যি বলছি আমি তোমার সব কথা শুনেছি। এবারে তো উত্তর দাও, সবাই তোমাকে খুঁজছে।”
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ডাগর চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু টলমল করছে। তার সাথে আমার হৃৎপিণ্ডটা কেমন যেন টলমল করে উঠলো। দীপ্তিময় রমণী আমার পরী, জানে কি করে মনের ভাব লুকাতে হয়।
নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে “এই যে আমি, কে খুঁজছে আমাকে?” পরীর আওয়াজ শুনে সবাই সামনে ডাকে।
সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে বলল “বেরতে দেবে তো নাকি?”
সিট গুলোর মাঝে জায়গা খুব কম, সামনের সিটের সাথে নিজেকে চেপে ধরে বের হবার চেষ্টা করে পরী। আমার হাতের ওপরে পরীর নিটোল নিতম্বের ছোঁয়া লাগে। সেই ছোঁয়া পেয়ে আমার শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ খেলে যায়। বের হওয়ার সময়ে পরীর পিঠ আমার থুতনি ছুঁয়ে যায়, মখমলের মতন ত্বক পরীর। আমি ওর পাতলা কোমর ধরে ওকে বের হবার জন্য সাহায্য করি। কোমরে আমার হাতের পরশ পেয়ে কেঁপে ওঠে পরী। আমি ইচ্ছে করে পরীর কোমল কটিদেশে আলতো করে চাপ দেই।
আমার দিকে ঘুরে তাকায়, নাক কুঁচকে দুষ্টু হেসে বলে “দুষ্টুমি হচ্ছে? আমি এখুনি আসছি।”
বরের ছোটো বোন, বাড়ির সব থেকে ছোটো মেয়ে, চুলবুলি পরী সবার প্রিয়। গলা বড় মিষ্টি তার ওপরে আবার সুন্দর গান করতে পারে পরী। আত্মীয় সজ্জনের ভিড়ে হারিয়ে যায় পরী। সামনের সবাই ছোটো বড় রা গান নাচ শুরু করে দিয়েছে। রাতের অন্ধকার কেটে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বরযাত্রীর বাস। আমি চুপ করে বসে দেখতে থাকি পরী কে, মাঝে মাঝে ভাবি, হারিয়ে গেল নাকি। না আমারই ভুল, পরী আমার দিকে মাঝে মাঝেই তাকিয়ে দেখছিল আর চোখ দিয়ে ইশারা করে আমায় ডাকছিল। আমি অসামাজিক প্রাণী, সবার সাথে ঠিক করে মিশতে সময় লাগে তাই বারেবারে ইশারা করে ওর ডাক প্রত্যাখান করে দিচ্ছিলাম। বাসের মধ্যে নেচে নেচে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে কিছুক্ষণ পরে। কোন একজন বললেন নাচ ছেড়ে নিজের সিটে বসে গানের খেলা করতে।
পরী আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে গান শুরু করে “পিয়া তু আব তো আজা, সোলা সাওন আকে বেহকে……” গানের সাথে সাথে আমার দিকে তাকিয়ে যেন বুঝাতে চাইছিল, কি রকম মানুষ তুমি, এত ডাকছি তাও আসনা?
গান শুনে আর পরীর তাকানো দেখে অনেকেই আমার দিকে তাকাতে শুরু করে দিল, আমি একটু খানি মাথা নিচু করে এদিক ওদিকে তাকাই। বাসে বাবা মা, মামা মামিরা সবাই বসে আর পরী যা জুড়েছে তার মধ্যে।
গান শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র আমার মনে হল, না কিছু করা দরকার, অনেক হয়েছে চুপ করে বসে থাকা। আমি বুকের মাঝে সাহস যোগাড় করে গেয়ে উঠলাম “তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম, প্যার হোতা হ্যায় দিবানা সনম……” তৎকালীন সব থেকে প্রচলিত সিনেমার গান।
আমার হেড় গলার গান শুনে পরী অবাক হয়ে যায়, তার সাথে বাসের বাকি লোকজন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। সবার মুখে যেন একটা প্রশ্ন কে এই ছেলেটা।
পরী সবার প্রশ্ন দেখে আমার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে, উত্তর দেয় “ইনি হলেন অভিমন্যু, উলুপিদির ছেলে।” তারপরে মায়ের দিকে তাকায়।
বাসের অনেকেই মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে “আরে উলুপিদি, তোমার ছেলে তো অনেক বড় হয়ে গেছে।”
পরী ততক্ষণে আমার পাশে চলে এসেছে, আমার হাত ধড়ে বাকি সবার উদ্দেশ্যে বলে যে সবাই যখন গানের খেলা খেলছে তখন আর দাঁড়িয়ে থাকা কেন, সবাই নিজের নিজের সিটে বসে খেলতে পারে। এই কথা শুনে তো আমি যেন হাটে স্বর্গ পেলাম, বাপরে, সবাই যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেছিল পরীকে। এবারে আমি একটু ওর পাশে বসতে পারবো। যে যার নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ে, গানের সুর এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসতে শুরু করে। আমি বাইরের দিকে পা রেখে সিটে বসে। পরী আমার পেছনে, সিটের ওপরে হাঁটু মুড়ে বসে, আমার দু’কাঁধে হাত দিয়ে ভর করে বসে। আমি কোমল বক্ষের স্পর্শ অনুভব করি ঘাড়ে, আমার মাথার ওপরে থুতনি রেখে হাত দুটি কাঁধের দু’পাশ দিয়ে সামনে ঝুলিয়ে দেয়। বাসের দুলুনিতে আমার ঘাড়ে পরীর কোমল বক্ষের ঘর্ষণে বেশ গরম হয়ে যায়। গানের খেলা যথারীতি চলতে থাকে। মাঝে মাঝে আমার চুলে বিলি কেটে দেয় পরী।
আমি একবার দেখলাম যে মা আমাদের দিকে আড় চোখে একবার দেখে নিল যে আমরা কি করছি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে, এক এক করে সবাই ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে যায়। পরী জিজ্ঞেস করে সবাই কে যে কারুর কি আর গান গাওয়ার মতন শক্তি নেই? মা বললেন যে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, সবাই যেন একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়। রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, আমরা আর আধ ঘন্টার মধ্যে রানাঘাট পৌঁছে যাবো। বিশ্রাম না নিলে বিয়ে বাড়িতে সবাই কে ভুতের মতন দেখাবে। আমার মা স্কুল টিচার, গলায় আওয়াজে সবাই চুপ করে মেনে নিলেন।
বাস হুহু করে রাতের অন্ধকারের বুক চিরে ছুটে চলেছে গন্তব্য স্থলের পানে। পরী জানালার পাশে, আমার ডান কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে থাকে। জানালা, একটু খানি খোলা, ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে লাগে, মাঝে মাঝে ঠাণ্ডায় কেঁপে ওঠে পরী। কোন গরম জামা কাপড় আনেনি, নিজের সাজ ঢেকে যাবে তাই। ছোটো দাদার বিয়ে, নিজেকে তো স্বর্গের অপ্সরার সাথে পাল্লা দিয়ে সাজিয়েছে। আমি ওর মৃদু কম্পন অনুভব করে বুঝতে পারলাম যে ওর ঠাণ্ডা লাগছে। আমার কাঁধের মায়ের দেওয়া কাশ্মিরি শাল খানি ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম।
আমি ডান হাত দিয়ে ওর কাঁধ স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করলাম “কি হল এত চুপচাপ কেন?”
আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল “আমি না একদম বোকা। এত ঠাণ্ডা জেনেও কিছু আনিনি।”
আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম “তুমি শুধু মাত্র বোকা নও, তুমি সুন্দরী গাধি।”
নাক কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে “ধুত, তুমি না একদম বদ।”
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি কি?” আমি জিজ্ঞেস করেলাম পরীকে।
“কি” বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে উলটো জিজ্ঞেস করল।
“তোমার কলেজ কেমন ছিল?”
“তেমন কিছু না, এই কেটে গেছে।” ঠোঁট উল্টে উত্তর দেয় পরী।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ধুম করে জিজ্ঞেস করে বসি “তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল না কলেজে?”
পরী আমার দিকে, বড় বড় চোখ করে মুখ তুলে তাকাতেই আমাদের মুখ দুটি পরস্পরের একদম কাছে চলে এসেছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল “এই রকম প্রশ্ন করার মানে?” আমার সারা মুখের ওপরে পরীর উষ্ণ প্রশ্বাস ঢেউ খেলে বেড়ায়।
আমি উত্তর শুনে চাহনি দেখে তোতলাতে শুরু করে দিলাম “মানে মানে, আমি এই বলছিলাম যে, তুমি সুন্দরী, তার ওপরে বুদ্ধিমতী, সেই জন্য আমি ভাবলাম যে তোমার অনেক বয়ফ্রেন্ড থাকবে নিশ্চয় কলেজে।”
নাক কুঁচকে আমার দিকে দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে বলে “হুম, কোথাও কি কিছু জ্বলছে নাকি? কিছু পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে? আমাকে চুপিচুপি করে দেখা হচ্ছে তাই না দুষ্টু ছেলে। দেখে নে অভি।”
অভি, আমার নাম ওর মুখে আমার নাম অভিমন্যু থেকে অভি হয়ে গেছে, আমি তো আহ্লাদে আটখানা। বুকের মধ্যে খুশী যেন আর ধরেনা।
আমি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম “আরে না না, আমি তো এমনি এমনি জিজ্ঞেস করেছি, আমি কেন কারুর নামে জ্বলে পুরে মরব” কিন্তু সত্যি সত্যি আমি কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন ওই অজানা অচেনা মানুষটির ওপরে, যদিও তখন উত্তর দেয়নি পরী।
“না না, আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই” আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম “কলেজে অনেক বন্ধু বান্ধবী ছিল, কিন্তু কেউ এই রকম ভাবে স্পেশাল ছিল না। অনেক ছেলেরা ঘোরা ঘুরি করেছে আমার চারপাশে কিন্তু কোনদিন আমার সেই রকম কিছু মনে হয়নি, যাকে বলবে একটা টান বা অন্য কিছু। আজ পর্যন্ত সেই রকম কাউকে চোখে পরেনি আমার।”
“তার মানে তুমি কি তোমার চার পাশে সব দরজা জানালা বন্ধ করে বসে আছো, কাউকে মনের ভেতরে ঢুকতে দেবে না বলে?” আমি ধুম করে জিজ্ঞেস করে ফেলি।
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে “আমি আজ পর্যন্ত সেই রকম কাউকে পাইনি” আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কথা বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কি বলতে চাইছে। আমার দিকে মিষ্টি হেসে উত্তর দিল “আমি আজ পর্যন্ত বলেছি, এখন পর্যন্ত বলিনি কিন্তু…… বুদ্ধু ছেলে।” বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলে।
মনের প্রাঙ্গনে যেন ময়ুর নেচে ওঠে, তাহলে প্রেমে পড়েছে পরী, হাতে যেন স্বর্গ পেলাম আমি।
আমি জিজ্ঞেস করি “আচ্ছা একটা কথা বল, বিকেল বেলা উঠানে অত কথা শুনাতে গেলে কেন আমায়?”
“আমার কেমন যেন হটাৎ করে মনে হল তোমায় বলি, তাই বলে ফেললাম, কেন জানিনা।” তারপরে মিষ্টি করে বকার সুরে বলল “এখন চুপ করো, আমাকে একটু শুতে দাও।”
আমার গা ঘেঁসে, ডান কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো পরী। আমি ডান হাত দিয়ে ওর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলাম, শীত কালে আমার গায়ের উষ্ণতা পেয়ে আরও যেন আমার পাশ ঘেঁসে বসল। আমি আলতো করে ওর কোমরের কোমল ত্বকে হাত বোলাতে লাগলাম। বাসের ভেতরের নিষ্প্রভ আলোতে, পরীকে যেন ঠিক এক জলপরীর মতন দেখতে লাগছিল, স্বর্গ থেকে মর্তে নেমে আমার কোল ঘেঁসে চুপটি করে শুয়ে আছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সামনের দিক থেকে কেউ বলে উঠলো যে কনের বাড়ি আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে বাস।
আমি পরীকে আলতো করে নাড়িয়ে দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলাম “ওঠ, এসে গেছি প্রায়, নামতে হবে তো”
ঘুম জড়ানো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে “না এত তাড়াতাড়ি কেন, আমি একটু ঘুমাব।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কনের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। পরী তখন পর্যন্ত আমার কাঁধে মাথা দিয়ে শুয়ে।
মা আমাদের সিটের পাশে এসে পরী কে ডাক দিলেন “পরী, সোনা মা আমার, দেখ আমারা এসে গেছি নামতে হবে এবারে ওঠ।” মায়ের কথা শুনে মনে হল, মা সত্যি অনেক ভালবাসে পরী কে, মনে হয় নিজের মেয়ের মতন ভালবাসে।
মায়ের ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে উঠে বসে পরী, উলটো হাতে মুখ খানি মুছে নিয়ে নিজের ছোটো পার্স থেকে সাজার জিনিস বের করে নিজেকে ঠিক করে নেয়। বাস থেকে সবাই নেমে গেছে, বাসে শুধু আমি আর পরী বসে। ওকে ছেড়ে আমি কি করে নামি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, পরী নিজের মেকআপ নিয়ে খুব ব্যাস্ত।
আমার ভেতরে প্রবল একটি ইচ্ছে জাগে, মনে হয় এই খালি বাসের মধ্যে জড়িয়ে ধরে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে নেই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে, পরীর দিকে ঝুঁকে পড়লাম। মাথার ওপরে আমার উষ্ণ প্রশ্বাস অনুভব করে আমার দিকে মুখ উঁচু করে তাকায়, আমাদের চার চক্ষু এক হয়। আমি ওর গভীর কালো চোখের মাঝে ভালবাসার ছোঁয়া দেখতে পাই। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের চার পাশে, আমি বুকের ভেতর থেকে শেষ সাহস টুকু গুছিয়ে নিয়ে ঝুঁকে পড়ি ওর মাথার ওপরে। কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বুক ভরে ওর মাথার আঘ্রাণ নিজের ভেতরে টেনে নেই।
তারপরে আর কিছু জানিনা, আমি চুমু খেয়ে আর পেছনে দেখিনা, এক লাফে বাস থেকে নেমে পড়ি।
কান্না হাসির খেলা
আমি বাস থেকে নামতেই, দেখি মা আমাকে ডেকে এক কোনায় নিয়ে গেল। আমার বুকের মাঝে ঝড় শুরু হয়ে যায়, এই বুঝি সব জানাজানি হয়ে গেছে আর তার খেসারত এখন গুনতে হবে। বুকের ধুকপুকানি সহস্র গুন বেড়ে যায়। তার বদলে মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, বড় যাত্রী রাত এগারোটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে ফিরে যাবে বসিরহাট, আমি ফিরতে চাই না আমি এখানে থাকতে চাই। আমি জানালাম, যে হেতু বাঙালি বিয়ে আমি অনেক দিন পরে দেখছি, সেজন্যে আমি রাতে থাকতে চাই। মা আমাকে থাকার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন। আমি তো জেনে বেশ খুশী হলাম যে মা আমার আর পরীর কথা কিছু জানেন না।
কনের বাড়িতে বর যাত্রী উপস্থিত। সানাই বাজছে, চারদিকে হইহল্লা বেশ একটা রমরমা ব্যাপার স্যাপার। আমার চোখ থেকে থেকে পরী কে খোঁজে, কিন্তু মেয়েটা ভিড়ে কোথাও হারিয়ে গেছে। বরের ছোটো বোন, তার রকম সকম আলাদা, বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। আমি একা একা একদিকে দাঁড়িয়ে বিয়ে বাড়ির ভিড় আর সাজসজ্জা উপভোগ করছিলাম।
এর মধ্যে এক সময়ে পরী আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল “কি গো, চুপ করে বসে কেন?” কথা বলার সময়ে লক্ষ্য করলাম যে আমার দিকে না তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল কথা টা।
উত্তরে বললাম যে “তোমার সাথে সব সময়ে অনেক মেয়েরা থাকে, আমি খুব অড ফিল করি। তুমি এঞ্জয় করো।”
“ঠিক আছে, বসে থাকো। তবে সময় মতন খেয়ে নিও, এগারটার মধ্যে বাস ছাড়বে। সবাই বাড়ি ফিরে যাবে শুধু, বড়দা আর সুব্রতদার দুই বন্ধু থাকবে।”
আমি বললাম যে, আমার মা আমাকে রাতে থাকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন, আমি রাতে বিয়েবাড়ি তেই থাকছি।
অনেক ক্ষণ পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল “কি? তার মানে কি আমাকেও থাকতে হবে?”
আমি ওর দিকে হেসে বললাম “সেটা তো তোমার ইচ্ছে, আমি কি করে জানবো তুমি থাকবে কি না।”
“ঠিক আছে সময় হলে দেখতে পারবে।” পরী আমার দিকে একটু কটমট করে তাকিয়ে উত্তর দিল।
কিছুই করার নেই, আমি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে বরযাত্রীর খাওয়া শেষ হয়, সবাই বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত। এর মধ্যে দেখি পরী বায়না ধরেছে যে সে রাতে থাকবে। আমি বুঝতে পারিনি যে এই রকম কিছু একটা করবে।
মা বললেন “পরী, কোন মেয়েরা রাতে থাকছে না, তুই কি করে থাকবি বল। তোর মা কি বলবে তাহলে?”
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে “আমাকে নাকি তুমি তোমার মেয়ের মতন ভালবাসো। প্লিস রাতে থাকতে দাও, প্লিস প্লিস।”
আমাকে কাছে ডেকে মা বললেন “এই ছেলে, পরী রাতে থাকতে চায়, ওর দিকে নজর রাখিস।”
আমার মনের অবস্থা ঠিক বর্ষা কালের চাতক পাখীর মতন, জল খুঁজে পেলাম মনে হল। খুশী টাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখে, বাধ্য ছেলের মতন মাথা নেড়ে বললাম যে ঠিক আছে আমি নজর রাখব। মনের ভেতরে ফুলঝুরি ফুটছিল, হয়ত অবচেতন মনে যেটা চেয়েছিলাম সেটা পেয়ে গেছিলাম বলে।
পরী মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে “আমার সোনা দিদি। আমি একদম ঠিক থাকব।”
কিছু পরে বরযাত্রী বাসে চেপে বেড়িয়ে পরে বসিরহাটের দিকে। বরযাত্রী চলে যাবার পরেই দেখি পরী আবার ভিড়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি যে মেয়েটা আমার শাল গায়ে দিয়ে বিয়ের মন্ডপের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। চলন যেন এক মাদকতা মাখানো ছন্দ, শরীরে কেমন একটা দুলুনি লেগে। পেছন থেকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন জড়িয়ে ধরি।
রাত গভীর হয়ে চলে, বিয়ে বাড়ির লোকজন ধিরে ধিরে কমে আসে। রাতে থাকার মতন আমি, পরী, বড় মামা সুমন্ত আর সুব্রতর দুই বন্ধু। বিয়ের লগ্ন আসন্ন, রাত বারোটা বাজে। আমি আর পরী দু’জনে ছাদনা তলায় দাঁড়িয়ে, আগুনের দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে পরীর আঙ্গুল আমার হাত ছুঁয়ে যায়, থেকে থেকে আমার শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে বেড়ায়। আমার দিকে না তাকিয়ে পরী আমার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। দু’জনেই বিবাহের অগ্নির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৌন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে এক মহিলা এসে পরী কে জিজ্ঞেস করে যে শোবে নাকি? আমি আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি যে ও মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় যে যাবে না।
কিছুক্ষণ পরে আমি ওকে জিজ্ঞেস করে যে আমার সাথে একটু হাঁটবে? সম্মতি জানায়, আমি আর পরী রাতের অন্ধকারে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ধিরে ধিরে হাঁটতে থাকি। ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা, আমার শাল টাকে গায়ের ওপরে ভালো করে জড়িয়ে নেয়, হাত দুটি বুকের কাছে ভাঁজ করা। কারুর মুখে কোন কথা নেই, চুপচাপ দু’জনে নিস্তব্ধ রাতে হেঁটে চললাম। শীত কালের রাত, চারদিক চুপচাপ, আমার বুকের মাঝের জায়গাটা হটাৎ করে কুব খালি মনে হয়। মনে হল খালি খালি হেঁটে চলেছি, কেউ এক’জন কে কথা শুরু করা উচিৎ।
আমি আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে, এত চুপচাপ কেন?”
নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল পরী, মৃদু কম্পিত স্বরে উত্তর দেয় “কি হয়েছে! যেন তুমি কিছু জানোনা কি হয়েছে।”
“আমি কি করেছি” প্রশ্ন করি আমি।
“আচ্ছা, যেন তুমি কিছুই করো নি” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে “জানো আমার কি হয়েছিল? আমার ওপরে যেন একটা বজ্রবিদ্যুৎ ঝলসে পড়েছিল।”
আমি কম্পিত স্বরে বলি “আমি কেমন যেন হয়ে গেছিলাম, আমার খুব ইচ্ছে করছিল তাই হটাৎ করে……”
পরী তখন পর্যন্ত মাথা উঠিয়ে আমার দিকে তাকায়নি, নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে আমার পাশে “নড়াচড়ার শক্তিটুকু ছিলনা আমার। তুমি নেমে যাবার পরে, অনেকক্ষণ আমি চুপ করে বসেছিলাম। আমার শরীর কাঠ হয়ে গেছিল, কেমন যেন অবশ হয়ে গেছিলাম আমি।”
আমি আলতো করে দু’কাঁধ ছুঁয়ে রাস্তার মাঝে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি, চিবুকে তর্জনী ঠেকিয়ে আলতো করে ওর সুন্দর চেহারা তুলে ধরি। দু’চোখ বন্ধ, চোখের পাতা সুন্দর করে সাজানো লম্বা পালকে, আমি তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টে ঐ সুন্দর মুখপানে। ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে, আসন্ন কিছু আশার আকাঙ্খায়। হাত দুটি ভাঁজ করে বুকের ওপরে রাখা, শাল গায়ের সাথে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে। আমি একটু ঝুঁকে যাই ওর সুন্দর মুখের ওপরে আমাদের ঠোঁট জোড়া খুব কাছে। আমি সারা মুখে ওর উষ্ণ প্রশ্বাস অনুভব করি, এত কাছে দাঁড়িয়ে আমরা, আমি যেন ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পাই। বুকের মাঝে উত্তাল তরঙ্গ বারংবার আছাড় খাচ্ছে যেন, পরীর বক্ষদ্বয় নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে ক্রমাগত ওঠানামা করছে আমার চোখের সামনে। দৃষ্টি থেকে থেকে আটকে যায়, বুকের খাঁজে। আমি মাথা নামিয়ে নিয়ে আলতো করে নাক দিয়ে ওর নাক ছুঁই, দু’জনেই ঘেমে গেছিলাম। ওর নাকের ঘাম আমার নাকে স্পর্শ করে, কেঁপে ওঠে পরী। ঠোঁট দুটি স্পর্শ করার প্রবল কামনা জাগে মনের গভীরে। পরী দাঁড়িয়ে, যেন কিছু শুনতে চায় আমার কাছে কিংবা নিবিড় চুম্বনের অধীর অপেক্ষায়। আমি সাহস যোগাড় করে উঠতে পারিনা সেই চুম্বনটি আঁকার জন্য।
এমন সময় হটাৎ করে পরী চোখ খোলে। দু’নয়নে অশ্রু টলমল করছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, নাকের ডগা লাল। ধরা গলায় বলে ওঠে “না, না। এটা সম্ভব নয় অভি। তুমি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।” মাথা নামিয়ে, চোখে জল নিয়ে আমার সামনে থেকে দৌড়ে চলে যায় পরী।
আমি দাঁড়ায়ে একলা, সেই রাতের অন্ধকারে। বুকে মধ্যে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পরে। নিজেকে খুব একা মনে হয়, যেন এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমি যেন অজানা এক গ্রহে হারিয়ে গেছি। একটা সিগারেট ধরাই আমি। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরতে থাকে, “আমি কে? আমি কি? কে এই অভিমন্যু?” বুকের কোন এক কোনা থেকে উত্তর আসে “জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক মানুষ, তুমি” আমার দু’চোখে জল চলে আসে, সেটা কি সিগারেটের ধোঁয়ায় না পরাজয়ের, জানিনা বা জানতে চেষ্টা করিনি আমি। আমার কি অধিকার আছে কারুর সন্মান কারুর ধারনা অথবা অনুভুতিকে যন্ত্রণা দেবার। আমার কোন অধিকার নেই, শুচিস্মিতার কে অসম্মান করার বা তার হৃদয়ে যন্ত্রণা দেবার। আমি হেরে গেছি এই পৃথিবীতে, নিজের কাছে। আমি আমার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ার প্রেমে পড়েছি, সে আমার প্রেমে পড়েছে। আমাদের সম্পর্ক সমগ্র সভ্যতার চোখে নিষিদ্ধ। আমাদের এই সভ্যতা সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় জীবনে, তাকে এড়িয়ে কি করে জীবন কাটানো সম্ভব? কিছুতেই সেটা সম্ভব নয়।
বিধ্বস্ত পরাজিত, বুকের মাঝে এক তোলপাড় নিয়ে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াই। ঠিক সেই সময়ে আমাকে কেউ ডাক দেয়, মাথা উঠিয়ে দেখি, সুব্রতর এক বন্ধু আমাকে ডাকছে। বিয়ের পালা শেষ, বর কনে এবারে খেতে বসবে তাই ডাক পড়েছে আমার।
প্যান্ডালে ঢুকে দেখি, পরী এক কোনায় মাথা নিচু করে এক দৃষ্টিতে নিভে যাওয়া আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। নাকের ডগা লাল চোখের পাতা ভারী, চোখের কোনে জল। মনে হল ফুঁপিয়ে কাঁদছে, থেকে থেকে মৃদু ভাবে পিঠ ওঠানামা করছে। আমি প্রমাদ গুনলাম, আমি কেন এলাম, কেন ওকে কাঁদিয়ে দিলাম। যা ঘটে চলেছে সেটা ঠিক না ভুল জানিনা।
এমন সময়, কনের মা এসে পরী কে জিজ্ঞেস করে “কি হল, একা একা কেন বসে? তোমাকে সবাই খাওয়ার টেবিলে খুঁজছে। তোমার নতুন বউদি তোমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করে বসে আছে।”
ডাক শুনে, পরী সোজা হয়ে বসে, চোখের জল মুছে মিষ্টি হাসে। কনের মা, ওকে নিয়ে খাবার জায়গায় ঢুকে পরে। আমি ও পেছন পেছন ঢুকে পড়লাম খেতে। ঢুকে দেখি, ও নতুন বউয়ের পাশে বসে বেশ গল্প করছে হাসছে। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল যে সেই পুরানো নারী, যে এইখানে এসেছিল, সে যেন হারিয়ে গেছে। আমি একটা কোনায় বসে চুপ করে খাওয়া সেরে নিলাম। পুরো সময়টাই কেউ কারুর দিকে তাকাই নি।
খাওয়া দাওয়া শেষে, সবাই যে যার নিজের কাজে চলে যায়। বর কনে কে নিয়ে সুব্রতর বন্ধুরা বাসর জাগতে চলে গেল। পরীকে সাথে নিয়ে কনের মা চলে যান।
আমি একা একটা চেয়ার টেনে বিয়ের জায়গায় বসে থাকি। ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা কিন্তু আমার যেরকম মনের অবস্থা, তাতে ঠাণ্ডা বিশেষ লাগেনা। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে, নিভে যাওয়া আগুনের থেকে নির্গত ধোঁয়ার পানে এক ভাবে চেয়ে বসে থাকি। মাথার মধ্যে যেন কিছুই নেই, কোন চিন্তা নেই একদম খালি।
জানিনা রাত কটা বাজে, ঘড়ি থাকলেও সেটা আর দেখা হয়ে ওঠেনা। এমন সময়ে নাকে এসে লাগে জুঁই ফুলের গন্ধ, কাঁধে ওপরে আলতো ছোঁয়া, এসেছে তাহলে আমার কাছে, আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো আর আসবে না। আমি একটা চেয়ার টেনে পাশে বসার ইশারা করি। পরী চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমার সামনে বসে পরে। ভাবলেশহীন চোখে ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকি। ওর লাল ঠোঁটে মিষ্টি একটা বাঁকা হাসি মাখা।
আমায় জিজ্ঞেস করে “ঠাণ্ডা লাগছে?”
অনেক ক্ষণ পরে ওর আওয়াজ শুনে মনে হল যেন কিছু ফিরে পেলাম আমি। মাথা নাড়াই “হ্যাঁ ঠাণ্ডা তো লাগছে।”
“আমি আর একটা শাল এনেছি তোমার জন্য।”
“আমার শাল টা আমাকে দেবে না?”
মাথা নাড়িয়ে চোখে হাসে মাখিয়ে বলে “না, এই শাল আমি দেব না, এটা আমার। চিরদিনের জন্য আমার।”
মৃদু হেসে বলি আমি “ঠিক আছে, আমার রানীর যা ইচ্ছে তাই হোক।”
বকে দিল আমাকে “অনেকক্ষণ ধরে দেখে যাচ্ছি, শুধু সিগারেট খেয়ে চলেছ।”
আমি আঙ্গুল থেকে সিগারেট টা মাটিতে ফেলে বললাম “ঠিক আছে বাবা, এই নাও আর খাচ্ছিনা।”
“তুমি আজ রাতে এখানে থাকলে কেন?”
“আমি কোনদিন কোন কাছের আত্মীয়র বিয়ে দেখিনি তাই পুরোটা এঞ্জয় করতে রয়ে গেলাম।”
আবার বকে দিল আমাকে “তাহলে তুমি আমার জন্য থাকনি?”
আমি অবাক “কোন লেডিস রাতে স্টে করেনি, তো আমি কি করে জানবো যে তুমি স্টে করবে কি করবে না।”
আমার হাতের ওপরে মৃদু চাপর মেরে বলে “তুমি একটা আস্ত গাধা। আমাকে একবারের জন্য জিজ্ঞেস করলে না কেন? একবারের জন্য ভেবে দেখলে না আমি অতটা রাস্তা একা একা কি করে ফিরব?”
“তোমাকে বোঝা বড় দায়, পরী। আমি সত্যি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনা তোমাকে। বাসে সবাই তোমার চেনা জানা, তুমি একা কেন হবে?”
অভিমানীনি পরী বলে ওঠে “তোমরা ছেলেরা কখন বুঝবে না আমাদের।” রেগে আমার সামনে থেকে উঠে যায়।
আমি ওর হাত দুটি হাতের মধ্যে নিয়ে কাতর স্বরে বলি “প্লিস যেওনা। বস একটু।”
“কেন বসতে যাবো আমি? তুমি তো এখানে আমার জন্য বসে নয়। একা একা বসে থাকো।”
“প্লিস মাফ করে দাও। সরি। রিয়ালি সরি।”
আমি টেনে ওকে আমার বাঁ পাশে বসিয়ে দিলাম, আমার বাঁ কাঁধে মাথা রেখে আমার হাতে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আমার আঙ্গুল গুলো নিয়ে নাড়াচারা করে।
ফিসফিস করে বললাম আমি “পরী, আমি সত্যি জানিনা, আমাদের সম্পর্কে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। আমি জানিনা এর কি পরিণতি।”
কাঁপা গলায় বলে “আমি জানতে চাই না এর পরিণতি, অভি। আমি বর্তমানে বাঁচতে চাই, জীবন টাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে চাই। আমি ভবিষ্যৎ দেখিনি, দেখতে চাইনা।”
আমি বাঁ হাত দিয়ে পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে কোমল কটিদেশে আঙ্গুল বুলাতে থাকি, আস্তে আস্তে হাত চলে যায় কোমল পেটের পাশে। পরী আমার গা ঘেঁসে বসে আমার শরীরের উষ্ণতা টুকু নিজের শরীরে অনুভব করার জন্য। ডান হাতে ওর ডান হাত নিয়ে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসি আমি। হাতের উলটো দিকে আলতো করে একটা চুমু খাই আমি। আমার দিকে অর্ধ নিমিলত নয়নে তাকিয়ে, দু’চোখ দিয়ে যেন ভালোবাসার অশ্রু ঝরে পড়ছে। গায়ের গন্ধে আমার বুকের ভেতর টা আনচান করে ওঠে, আমি ওর তর্জনীটা ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে আলত করে চুষি।
মিষ্টি স্বরে কঁকিয়ে ওঠে “উমমম…… প্লিস এরকম করো না, আমার ভেতরটা কেমন যেন চিনচিন করছে, অভি।”
আঙ্গুলে বের করে নিতে চেষ্টা চালায় পরী, কিন্তু সাথে সাথে আমার ঘাড়ে গর্দানে নাক আর ঠোঁট ঘসতে শুরু করে দেয়। আমার সারা শরীরে কেমন যেন একটা আগুন ধরে যায়। আমি ওর আঙ্গুল নিয়ে ক্রমাগত চুষে যাই, থামিনা। আমার প্রগার বাহু বন্ধনে সাপের মতন আড়ামড়া খেয়ে চলে “প্লিস… দুষ্টুমি করে না সোনা।”
আমি আমার চোয়ালে পরীর নরম ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করি, আলতো করে জিব দিয়ে আমার চোয়াল চেটে দেয়, মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো চুমু খেতে থাকে। দু’জনের মাঝে ভালবাসার বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠে।
আমি ওর হাত ছেড়ে ওর মুখপানে তাকিয়ে থাকি, ও আমার পাঞ্জাবির কলার হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে থাকে। ডাগর কালো নয়নে আবেগের শিখা জ্বলে ওঠে, সেই নয়নের আগুন যেন আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। আমি ডান হাতের তালু ওর বাম গালের ওপরে রেখে কপালে আলতো করে একটা চুমু খাই।
কেঁপে ওঠে পরী, আমার ঠোঁটের পরশে। ধিরে ধিরে আমার ঠোঁট নিচে নামে, ধনুকের মতন বাঁকা ভুরুর ওপরে আলতো করে চুমু খাই, চোখ বন্ধ করে নেয় পরী। আমি চোখের পাতার ওপরে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াই। নাক দিয়ে ঘন ঘন উষ্ণ নিঃশ্বাস নির্গত হয়। নাকের ডগায় আলত করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেই আমি। দু’জোড়া ঠোঁটের মিলনের আসন্ন সময় নিকটবর্তী, উৎকণ্ঠায় কেঁপে ওঠে পরী আমার নিবিড়ঘন বাহু বন্ধনে।
অবশেষে ঠোঁট জোড়া মেলে, প্রথমে মৃদু স্পর্শ। ঠোঁটের ওপরে আমার স্পর্শ অনুভব করে আমার কলার নিজের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে থাকে। আমার ওপরের ঠোঁট কামড়ে ধরে পরী, আমার বুকের ওপরে ওর কোমল বুক পিষে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে, ঠোঁট জোড়া নিয়ে খেলা শুরু হয়ে যায় দু’জনার। আমি আমার ঠোঁটের ওপরে মখমলের মতন জিবের ছোঁয়া অনুভব করি, আমার সারা শরীরে খেলে বেড়ায় এক শিহরণ।
সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের চারপাশে, পৃথিবীর আজ যেন শেষ দিন, কালকের সূর্য যেন উদয় হবেনা। আমি ওর কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নেই। আমার মুখটি নিজের হাতের মাঝে অঞ্জলির ন্যায় তুলে ধরে। আমরা এই প্রথম চুম্বন টাকে শেষ করে দিতে চাই না, প্রানপনে চাইছিলাম যেন সময় শেষ না হয়। কনকনে ঠাণ্ডা রাতে, প্রেমের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ থেকে থেকে ঠিকরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আমি ডান হাত নিয়ে যাই ওর মাথার পেছনে, আবেশের বশে, চুলের ক্লিপ খুলতে চেষ্টা করি।
কি যে ভুল করেছিলাম, আমার ঠোঁট ছেড়ে হেসে বলে “প্লিস আমার খোঁপা খুলো না। আমি চাই না আমাদের দেখে কেউ কিছু ধরে বসে।”
দীর্ঘ চুম্বন আর সোহাগের আদরে আমাদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল যেন, উত্তাল সমুদ্র তিরে দুই কপোত কপোতী অনাবিল আনন্দে তরী ভাসানোর প্রস্তুতি করছে। আমার মন খুশীতে ভরে গেল, পরীর চোখে ভালোবাসার পরশ দেখে। আবার যেন খুঁজে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া রমণীকে। ওর দু’চোখে জেগে ওঠে সেই হারিয়ে যাওয়া রোমাঞ্চ, পুরানো সেই দুষ্টু মিষ্টি পরী আমার সামনে বসে।
আমি ইচ্ছে করে ঠোঁট চাটি, আমার ঠোঁটে ওর লিপস্টিকের রঙের সাথে ওর পরশ লেগে, জিব দিয়ে সেই মিষ্টি ছোঁয়া টাকে অনুভব করে নিতে চেষ্টা করি।
“উমমমমম… তোমার ঠোঁট দুটো যা মিষ্টি না, কি যে বলি তোমায়।”
“হ্যাঁ অনেক হয়েছে, যাঃ দুষ্টু ছেলে তুমি, সেটা আর বলতে।”
মন আমার খুশীতে ভরে যায় সেই পুরানো পরী কে দেখে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে ও, আমার হাত ধরে টান দেয় “দেখো প্রায় চারটে বাজে। রেস্ট নেওয়া দরকার। তুমি কি কখন টায়ার্ড হও না?”
আমি মজা করে বলি “তুমি কাছে থাকলে টায়ার্ডনেস থোরি আমার কাছে আসে।”
“হ্যাঁ অনেক আদিখ্যেতা হয়েছে। আচ্ছা, শোন, মাসিমা বরযাত্রীর রেস্ট নেওয়ার জন্য একটা রুমের ব্যাবস্থা করেছিলেন। যাবে নাকি সেখানে শুতে? ছোড়দার বন্ধুরা তো ছোড়দার সাথে বাসর জাগছে, কেউ নেই ঐ রুমে।”
“হুম, কিন্তু তোমার বড়দা তো ঐ রুমে থাকতে পারেন?”
“যাঃ বাবা, আমি একদম ভুলে গেছিলাম। তো কি করবে, এই ঠাণ্ডার মধ্যে বসে থাকবো নাকি আমরা?”
আমি ওর হাত ধরে টান মেরে কোলের ওপরে বসিয়ে দেই “তুমি তো কাছে আছো, তাহলে কি ঠাণ্ডা কি ক্লান্তি। সবাই কে তাড়িয়ে দেব আমি।”
আদুরে গলায় বলে ওঠে পরী “কিন্তু আমাদের এইরকম অবস্থায় যে কেউ দেখে ফেলতে পারে। ব্যাপারটা তাহলে খুব সাঙ্ঘাতিক হয়ে যাবে যদি ধরা পরে যাই।”
“তাহলে তুমি কি বল করতে?” আমি ওর ক্ষীণ কটিদেশ দু’হাতে জড়িয়ে আর নিবিড় করে নেই ওকে আমার বুকের কাছে।
“আমাকে কোল থেকে তো উঠতে দেবে নাকি? না সারা রাত আমরা এই রকম ভাবে গল্প করে যাবো?” দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে, প্রগাড় হয়ে যায় বাহুবন্ধনি “আমি চাই না আজকের রাত টা শেষ হোক, চাই না সকালের সূর্য ওঠা।”
দু’হাতে ক্ষীণ কটিদেশ প্রগাড় বাহুবেষ্টনীতে আবদ্ধ করে ধরি, রমণীর কোমল নিতম্বের চাপে পিষ্ট হয়ে যায় আমার দুই জঙ্ঘা।
দুহাতে গলা জড়িয়ে, মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে। আমার কানে ফিস ফিস করে অনুরোধ করে “প্লিস একটা গান গাও?”
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠি “ড্যাম সিট্* পরী, রাস্তার কুত্তা গুলো আমাকে গান থামাতে বলবে তাহলে।”
“উম, তুমি না বাসে গান গেয়েছিলে? এবারে আমার জন্য গান গাও।”
“চলো অনেক হয়েছে, ছেলেখেলা। সূর্য উঠবে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে।”
“হ্যাঁ গো, আমাদের এবারে ভেতরে যাওয়া উচিৎ।”

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন