Pages

শেষ দেখা

বৃষ্টি হচ্ছে খুব । জেরিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে । বৃষ্টির শীতল ফোঁটা তীরের মতো ওর মুখে এসে বিঁধছে । কাল
কয়েকদিন আগেও ওরা দুইজন অনেক ভালো বন্ধু ছিল , যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ডস । কিন্তু এখন কেউ কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে না ! একটি ঘটনা তাদের মধ্যে দূরত্বের বিশাল দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ।
ভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা , অথচ তার কোন চিন্তা নেই । সে দাঁড়িয়ে আবরারের কথা ভাবছে । আবার ওর সাথে দেখা হবে !
ঘটনা শুরু হয়েছিলো একমাস আগে । যেভাবে বলা হচ্ছে আসলে তেমন গুরতর বিষয় নয় । থাক, আসল কথায় আসা যাক । জেরিন একটা ম্যাগাজিনে লেখালেখির কাজ করে , মোটামুটি ভালোই পরিচিত সে । খুব অল্প সময়েই ভালো একটা পরিচিতি লাভ করেছে সে । এদিকে আবরার নিজে নিজে কবিতা , গল্প লিখলেও সেগুলো প্রকাশের সুযোগ এখন পর্যন্ত পায়নি । ওদের দুজনের মধ্যে পরিচয়ও তেমন ছিল না তবে আবরার জেরিনকে চিনতো স্বাভাবিকভাবেই ।
জেরিন যে ম্যাগাজিনে লিখত তার একটা মাসিক মিটিং হল এবং ওরা দুইজনই সে মিটিংএ ছিল । এভাবেই ওদের ভালোমতো পরিচয় , ফেসবুকে অ্যাড ইত্যাদি হয়ে গেলো । প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো ওদের , খুব অল্প সময়ই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে । যাই হোক না কেন আবরার জেরিনের প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে । একসময়ে ভালোবেসে ফেলে জেরিনকে । কিন্তু এবিষয়ে কিছুই বলে না জেরিনকে , পাছে বন্ধুত্ব না ভেঙে যায় ! একদিন কথা বলার মাঝে আবরার ওকে জিজ্ঞেস করলো ,
- আচ্ছা ! আমার ব্যাপারে তোমার ফিলিংস কি ?
- তোমার ব্যাপারে আমার ফিলিংস খুব ভালো ।
- বুঝিয়ে বলো ।
- তুমি খুব ভালো একটা ছেলে । অল্প সময়ই তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছ ।
- ও আচ্ছা !
- তোমারটা বলো ।
- আমি একটা কথাই বলব । আমি তোমার সাথে থাকতে চাই ।
- এক্সপ্লেইন করবে , প্লিজ ?
- আমি তো তোমার কাছ থেকে না শুনতে পারব না ।
- হাহাহাহা । তুমি কি আমাকে প্রপোস করলে ?
- না , বাদ দাও । তবে প্রপোস হলে কি করতে ?
- বলতাম , ‘আমি এখনো কিছু ভাববো না । ওয়েট করতে পারলে করো , নাহলে রাস্তা মাপো !!
- ও আচ্ছা !! বাদ দাও !
এরপর আবরার এ নিয়ে আর কিছুই বলতে পারেনি । কিন্তু জেরিনের মনে আসলে কি ছিল তা বোঝা গেলো না । মেয়েদের স্বভাবটাই এমন । কিছু বলতে না চাইলে হাতে পায়ে ধরেও সেটা বলানো যায় না ! হাসিখুশি স্বভাবের আবরার ভেতরে ভেতরে শুধু অশান্তি আর দুশ্চিন্তার মাঝে দিন পার করতে লাগলো । আর জেরিন তো আগের মতোই আছে , কোনো পরিবর্তন নেই ।
এর মাঝে ম্যাগাজিনে আবরার একটা লেখা জমা দিলো , সে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল যে ওর লেখাটা ছাপা না হয়ে যাবেই না !! জেরিনকেও জানালো , জেরিনও ওকে বেস্ট উইশ জানালো ।
দেখা গেলো ওর লেখাটা ছাপা হলো না । খুব দুঃখ পেলো আবরার , নিজের প্রতিই রাগ হলো । এদিকে হতাশা নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলে জেরিনেরও ব্যাপারটা চোখে পড়লো । ও তৎক্ষণাৎ আবরারকে ফোন দিলো –
- তোমার লেখাটা আমাকে একটু দেখাতে পারবে ?
- কেনো ? লেখা দেখে কি করবে ?
- দাও না ! আমি একটু দেখবো ।
- দেখা লাগবে না ।
আবরার ঠাস করে ফোন রেখে দিলো । কিছুই ভালো লাগছে না ।
এর কয়েকদিন পরেই ওদের মাসিক মিটিং হলো । আবরার অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অনেকেই ওর সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করছে । ঠিকমতো কথা বলছে না , বললেও আজগুবি ব্যাপার নিয়ে খোঁচা দিচ্ছে । এমনকি জেরিন ওর সাথে কথা না বলেই মিটিং শেষে চলে গেলো , একবার তাকালো না পর্যন্ত ! এর মাঝে ফারহানের সাথে ওর দেখা হলো । ফারহান ওদের সাথেই ম্যাগাজিনে টুকটাক কাজ করে । তবে ইদানীং ফারহান অনেক পরিচিতি লাভ করছে , আবরারের চাইতেও বেশি । আর ফারহান খুব খোঁচা মেরে কথা বলে , তাই আবরার ওকে একটু সাবধানী দৃষ্টিতে দেখে । ফারহান এসেই ওর পিঠে থাবা মেরে বললো –
- কীরে রোমিও !! কি খবর ?
- হুম । এইতো !
- শুনলাম তোর একটা লেখা নাকি খুব ভালো হইসে কিন্তু ছাপায়নাই !! তাই নাকি তুই খুব কষ্ট পাইসিশ ??
- তেমন কিছু না । এই আর কি !!
- আসলে তোর লেখাতো ছাপা হবে না রে !!
- মানে ?? কি বলতেসিশ ??
- হুম !! শুনলাম তুই আমাদের টিমের অনেক মেয়েদের সাথে ফিল্ডিং মাইরা বেড়াস ! উপর থেকেই বলা হইসে । এমন করলে তোর কোনো কাজই কোনো কিনারা পাবে না !
- আমি গেলাম ।
ঝড়ের বেগে চলে আসলো আবরার । এগুলো ও কি শুনছে ?? ছি ছি !! লজ্জায় মাথাটা উঠাতেও পারছে না সে । শেষপর্যন্ত এমন অভিযোগ ! আর ভাবতে পারছে না । বাসায় ফিরে চিন্তা করলো আবরার । জেরিন ছাড়া তো কোনো মেয়ের সাথেই সেভাবে কথা বলে না ও ! তাহলে কি জেরিনই সব বলে দিয়েছে ? তাতে ওর কি লাভ ? না , ওকে অবিশ্বাস করতে পারছে না আবরার । আবার বুঝতেও পারছে না কে অভিযোগ করেছে ওর বিরুদ্ধে ।
সিদ্ধান্ত নিলো আবরার । জেরিনের সাথে প্রতিদিন কথা বলা বন্ধ করে দেবে । কথা বললেও কাজের কথাই বলবে , এর বাইরে আর একটা কথাও নয় ।
প্রায় দুই মাস পার হয়ে গিয়েছে । আবরার ম্যাগাজিনের মাসিক মিটিংএ যায় নি এরপর । জেরিনের সাথেও ভালোভাবে কথা হয় নি । এখন ও ভাবলো , ‘জেরিনের সাথে কথা বন্ধ রেখে কি লাভ ?? ওকে তো আমি ভালোবাসি । আর ওর সাথে কথা বন্ধ রেখেই কি কোনো লাভ হবে ?’
জেরিনকে ফোন করলো । ওপাশ থেকে জেরিনের কণ্ঠ শোনা গেলো –
- হ্যালো ।
- আমি আবরার । আচ্ছা আমাদের মাঝে কথা কেন বন্ধ হলো ?
- জানি না । হয়তো এরজন্য আমিই দায়ী ।
- আচ্ছা থাক । চলো , আগের সময়ে ফিরে যাই ।
- হাহাহা ! ওকে ।
এরপর থেকে আগের মতোই ওদের কথা হতে থাকলো । জেরিন দুইমাসে আর বদলায় নি । একসময়ে আবরার ভাবলো ওর মনের কথা সোজাসুজি জেরিনকে বলবে । এমন অশান্তি আর সহ্য করতে পারছে না সে । একদিন আবরার বলতে শুরু করলো –
- জেরিন , তোমাকে একটা কথা বলতে চাই ।
- হুম । বলো ।
- কাউকে বোলো না ।
- আচ্ছা ঠিকাছে । বলো ।
- আসলে !! আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
- কি !! কবে ? কিভাবে ?
- হয়ে গেছে । আমি জানি না । তিনমাস আগে থেকেই ।
- তখন কেনো বলনি ?
- ভেবেছিলাম তোমার মন জিতে নিয়ে বলবো , তাই বলি নি ।
- আসলে এসব কথার কোনো অর্থ নেই । আমি আরকজনকে ভালোবাসি ।
- কি ?? তবে যে বলেছিলে তুমি এগুলো নিয়ে ভাবছো না ? ওয়েট করতে হবে !!
- আমি কারো প্রেমে পড়লে ভাববো সেটা নিশ্চয়ই বলেছি ।
- না । বলনি । তুমি মিথ্যা বলছো ।
- মিথ্যা কেনো বলবো ? আমি সত্যি আরকজনকে ভালোবাসি ।
- ভালো থেকো । আর তোমার সাথে কথা হবে না ।
এরপর থেকে আবরার জেরিনের সাথে আর কোনোদিন কথা বলেনি । এরমাঝেই দুই বছর কেটে গিয়েছে । একই ভার্সিটিতে পড়ার কারণে মাঝে মাঝেই দুইজনের দেখা হয়ে যায় , তবে কেউই কারো সাথে কথা বলে না । আবরার আসলে এখন জেরিনকে ভয় পায় , জেরিনও অস্বস্তিতে ভোগে ওর সাথে দেখা হলে । তবে এক বিচিত্র কারণে আবরার বিশ্বাস করে যে জেরিন ওকে ভালোবাসে , কোনো এক কারণে ওকে মিথ্যা বলেছে । আবরার এ বিশ্বাস নিয়েই এতদিন ছিল । কিন্তু এখন আর থাকতে পারে না , খুব কষ্টে থাকতে হয় তাকে । খুব অগোছালো জীবন পার করছে সে , কেউই তা বুঝে না । পৃথিবীতে মানুষের কষ্ট দেখার সময় কোথায় ?? সবাই ছুটে চলছে নিজের গতিতে , কেউ সফল হতে আবার কেউ তাদের সফলতাকে ধ্বংস করতে ।
একদিন অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় হাঁটার সময় প্রবল বেগে ছুটতে থাকা একটা দোতলা বাসের সাথে ধাক্কা খায় আবরার । ঘটনাস্থলেই মৃত্যু !! কে জানে ! শেষ মুহূর্তে হয়তো নিজের মনের মানুষটার দুষ্টু হাসিটাই কল্পনায় দেখেছিলো !!
আবরারের মৃত্যুর খবর পেয়ে সবাই এসেছিলো । এমনকি ম্যাগাজিনের মানুষগুলোও এসেছিলো সবার সাথে । কেউ কেউ কষ্ট পেয়েছিলো ঠিক , আবার অনেকের মনেই কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি । একসময় যে যার মতো চলে গেলো । ব্যস্ত সবাই , এতো সময় তো নেই !!
শুধু সবার আড়ালে একজন এসেছিলো ভালোবাসার মানুষকে শেষ দেখা দেখতে । অনেক কেঁদেছিল সে । নিজের ভুলের জন্য মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার অমানবিক কষ্টে । সে যে মুখ ফুটে বলতে পারে নি ভালবাসার কথা । কারণ সে চেয়েছিলো মানুষটা কোনো বিপদে না পড়ুক , চেয়েছিলো মানুষটা ভালো থাকুক । কিন্তু কই ?? সে তো চলেই গেলো । এভাবে শেষ দেখা হবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি !
আবরারের বিশ্বাস সত্যি হয়েছিলো । কিন্তু ততদিনে সবকিছু শেষ । আবরার স্থান নিয়েছে পৃথিবীর বাইরে , অনেক দূরে ! আর জেরিন ? সে ভালো আছে । তবে আবরারের মৃত্যু তাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়ায় , প্রতিদিন !

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন