Pages

ভালোবাসি কিন্তু বলতে পারিনি!

14403
RAFIQ SIR

মেয়েটি দাড়িয়ে আছে আমার পাশে। সে পড়েছে সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ। তার ফর্শা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। লিপিষ্টিকহীন পাতলা ঠোট, লম্বা নাক আর মায়াভরা দু’চোখ সব মিলিয়ে এক কথায় তাকে অর্পূব লাগছে।
এমন অপরুপ সুন্দরী কাউকে ২৭ বছরের এ জীবনে দেখিনী। আড় চোখে তাকে বার বার দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি।
দাড়িয়ে আছি শনির আখড়া বাস কাউন্টারে। টিকিট কেটেছি ৩৫ মিনিট হল অথচ বাস আসার কোন লক্ষনই দেখছি না। কাউন্টারে বসে থাকা লোকটাকে তৃতীয় বারের মত জিজ্ঞাসা করলাম,ব্যাপার কি? গাড়ি কৈ..?
তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে আমাকে অগ্রাহ্য করে বললেন
- মন্ত্রী সাহেব আসবেন তাই রাস্তা ফাকা করে রাখা হয়েছে। গাড়ি আসতে দেরী হবে। সময় না থাকলে টিকিট ফেরত দিয়ে দেন।
এরপর আর কি বলার থাকে?
হাতে সময়ও নেই এক ঘন্টার মধ্যে আমাকে অফিসে গিয়ে রির্পোট জমা দিতে হবে। ইতিমধ্যে যাত্রীদের লাইন মানব বন্ধনের মত রাস্তার ফুটপাত দিয়ে সাপের মত একে- বেঁকে বেড়েই চলছে।
না …হ , শেষ পযন্ত টিকিট ফেরত দিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। হটাৎ পেছন থেকে
- “ এই যে শুনছেন..”
নারী কন্ঠ শুনে দাড়িয়ে পিছনে তাকালাম। দেখি আমার পাশে দাড়িয়ে থাকা সেই তরুণী আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমার পাশে এসে বললো আপনাকে দেখে আমিও টিকিট ফেরত দিলাম, কিভাবে যাবেন?
: দেখি সিএনজি পাই কিনা আমিতো বাংলামটর যাব, আপনি কোথায় যাবেন?
: আমি শাহবাগ যাব।
ও আচ্ছা। তাহলে আপত্তি না থাকলে চলেন একসাথে যাই।
তরুনী হেসে মাথা নাড়ালো। দুজন পাশাপাশি হাটছি।
কিছুদুর যাবার পর একটা সিএনজি পেলাম তবে ভাড়া চাইলো দ্বিগুন। কি আর করার রাজি হয়ে উঠলাম।
তরুণীর শরীর থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিনা সুন্দর এই গন্ধটা কি কোন দামী পাফিউমের?
সে খুব আনমনা কি যেন ভাবছে। এমন সুন্দরী তরুণীর সাথে ভ্রমন করতে পেরে ভাল লাগছে। ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। অনেক দ্বিধা মনের ভেতর। ভেবে পাচ্ছিনা কি বলবো।
হটাৎ করে তার চোখে চোখ পড়লো। সে হাসলো তার হাসি আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করলো। প্রতিত্তরে আমিও হাসলাম। বললাম
: কি নাম আপনার?
- আমি শিমুল, আপনি ?
: আমি ওয়াহিদ।
-কি করছেন ? সে প্রশ্ন করে।
তার চোখে আমার প্রতি আগ্রহ দেখে আমি পুলকিত হই।
: আমি বাংলা মটর যাচ্ছি, ওখানে আমি একটি বেসরকারী ব্যাংকে মাকেটিং অফিসার পদে কাজ করছি।
: ও আচ্ছা।
সে বাইরে তাকায়। ততক্ষনে আমরা সায়দাবাদ এসে পড়েছি। আমদের সামনে বিশাল জ্যাম। খুব গরম লাগছে। বাতাশে আগুনের তাপ বয়ে আসছে যেন। থেমে থাকা গাড়ির জ্বালানী পোড়া কার্বন যুক্ত বিসাক্ত ধোয়া, আর তার সাথে মিশে যাওয়া ধুলো-বালি এক হয়ে শরীরে কাটার মত লাগছে। নিচু হবার কারনে সিএনজি অটোরিক্স গুলোতে রাস্তার এই ধুলো-বালি বেশি লাগে। তাই খুব বেশি বিপদে না পড়লে আমি এর যাত্রী হইনা। মেয়েরা জন্ম সূত্রে গরম সহ্য করার মত অসিম শক্তি নিয়ে জন্মেছে। আমার ছোটবোন টাকে দেখি গরমের দিনে বিদুৎ না থাকলেও দিব্বি ঘুমুচ্ছে!
তবে শিমুল ঘামছে। শিশির কনার মত সেই ঘাম টিস্যু পেপার দিয়ে মুছলো সে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভাল লাগছে। কোন নারীকে এতটা আগ্রহ নিয়ে কখনো দেখিনি। এতটা ভালও কাউকে লাগেনী। ওর সব কিছুতেই আমি মুগ্ধ হচ্ছি। এই ভাললাগার মানে কি? এতটুকু দেখেই কি সারা জীবনের দেখা মেয়ে গুলির চেয়ে তাকে বেশি ভাল লাগাটা ঠিক হচ্ছে? ব্যপারটা কেমন সিনেমার গল্পর মত নাটকীয় মনে হচ্ছে না? সে কি ভাবছে? কি জানি !
শিমুলের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করলো। হটাৎ করেই তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চিৎকার করে বললো “ কখন… !”
এরপর জ্ঞান হারিয়ে আমার উপর ঢলে পড়ল শিমুল। এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটল যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওর মোবাইলটা হাত থেকে ছিটকে পড়লো।
ড্রাইভারকে বললাম রাস্তার একপাশে নাও।
হকারের কাছ থেকে পানি নিয়ে ওর চোখে মুখে ছিটালাম। কিন্তু জ্ঞান ফিরছেনা। কি করি? আমি কিংর্কতব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম।
এমন বিব্রতকর অবস্থায় কখনো পড়িনি। ড্রাইভার এগিয়ে এসে বললো ভাবীকে কোলের উপর শোয়ান, জ্যাম ছাড়ছে তাকে সামনের কোন হাসপাতালে নিতে হবে।
সিএনজি চলছে।
শিমুলের সর্বশেষ ডায়াল কলে ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। এবার ফোন বুক হতে বড় আপা নামের নাম্বারে ডায়াল করলাম। বেশ কয়েক বার রিং বাজার পর কেউ একজন ফোন রিসিভ করে বললো তুই তারাতারি হাসপাতালে আয়। লাইন কেটে গেল।
হচ্ছে টা কি?
টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ। পকেটে বেশ কিছু টাকা থাকায় হটাৎ করেই মনে হল অজ্ঞান বা মলম পার্টির কবলে পড়ছি নাতো!
শুনেছি ঐ পাটির লোকেরা নাকি আওমীলীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির চেয়েও শক্তিশালী! টেনশনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই রুপসী তরুণীকে এক হাতে শরিরের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেও কোন আলাদা ফিলিংস হচ্ছিল না।
এবার আমার মোবাইলে রিং বাজলো , রিসিভ করতেই আমার ম্যানেজার স্যার গম্ভীর গলায় বললো কি – ব্যাপার ওয়াহিদ সাহেব আপনি কৈ? এত দেরী করছেন কেন? দুই ঘন্টা যাবত রশিদ সাহেব আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তারাতারী অফিসে পৌছান।
রাগে দু:খে নিজের চুল নিজে ছিড়তে ইচ্ছা হল। কেন যে এমন হয়!
অফিসের এই বসটা ভয়ানক বাজে। কথায় কথায় ভুল ধরা ছাড়া তার যেন আর কোন কাজ নেই। কক্ষনই আমার ভাল কাজের প্রসংসা করতে তাকে শুনিনী। সে আমার পিছনে সর্বদা লেগে থাকে। অফিসে গেলে তার রামঝাড়ি যে মিস নেই তা বুঝতে পারছি।
শিমুলের দিকে তাকালাম ওমা ওরতো দেখি জ্ঞান ফিরেছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই দেখি ও শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
ও উঠে বসলো। ওড়না দিয়ে মুখে জমে থাকা পানি মুছলো। তাকে বিধস্ত আর ক্লান্ত লাগতে ছিল।
আমি বললাম কি হলো আপনার? হটাৎ করে এভাবে জ্ঞান হারালেন আমিতো ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম। আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
সে বেশ কিছুক্ষন নিরুত্তর রইল। তারপর আবার কেদে উঠল। চোখ থেকে অশ্রূ গড়িয়ে পড়ল।একসময় ও বলে
: কিছুকক্ষন আগে পিজি হাসপাতালে আমার বাবা মারা গিয়েছে। বাবা আমাকে এত ভালবাসতো অথচ তার মৃত্যুর সময় আমি তার পাশে থাকতে পারলামনা! সে আমাকে দেখতে চেয়েছিল …!
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল শিমুল।
তাকে সান্ত¦না দেবার চেষ্টা করলাম না। এতবড় শোকের কোন সান্তনা পৃথিবীতে নেই। মৃত্যুর শিতল পরশ শুধু লাশ নয় তার প্রিয়জনদের হৃদয়কেও শিতল করে দেয়।
সিএনজি চলছে। পাশাপাশি দুজন চুপচাপ বসে আছি। অচেনা অজানা মেয়েটার বাবার মৃত্যু শোকে আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। খারাপ লাগছে। আমার চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। শিমুল দেখার আগেই আমি দ্রুত চোখ মুছলাম।
শিমুল আমার দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো
- আমাকে কি আপনি একটু হাসপাতালে বাবার ওর্য়াড পযন্ত পৌছে দিবেন? কেন যেন মনে হচ্ছে আমার শরিরে একবিন্দু শক্তি নেই। বুকের ভেতর শূন্য শূন্য লাগছে। গলা শুকিয়ে আসছে।
আমি ওর হাত ধরে বললাম চিন্তা করবেন না আমি আছি।
হাসপাতালে ওর বাবার কক্ষে যখন পৌছালাম দেখি চারদিকে স্বজনেরা সবাই কান্না-কাটি করছে। আমি কিছুকক্ষন দাড়িয়ে রইলাম। বুঝতে পারলাম না আমার এখন কি করা উচিৎ! এদিকে ম্যানেজার স্যারের ফোন আসছে বার বার। শিমুলের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ওর কোন হুস আছে বলে মনে হরন, ও পাগলের মত বাবার শিয়রে বসে কাদছে। বাবার মত এমন বট বৃক্ষর চলে যাবার শোক যে কতটা ভারি তা কেবল যার যায় অনুভব করতে পারে।
আমি নিরবে লিফট দিয়ে নেমে পিজি হাসপাতাল হতে হেটে হেটে আমার অফিসে চলে আসলাম।
অফিসে এসে রশিদ সাহেবের সাথে কথা শেষে আরো কিছু প্রয়োজনীয় কাজ করলাম। কিন্তু কোন কিছুই ভাল লাগতে ছিল না। বারবার শিমুলের কথা মনে হচ্ছিল। তার মুখটা মনের ভেতর ভেসে উঠছে বার বার। হটাৎ করেই মনে হল হায় আমিতো ওর ঠিকানা বা মোবাইল নাম্বার কিছ্্্্্্্্্্্ইু জানিনা! ভীষণ মন খারাব হল। কাজ বন্ধ করে দ্রুত পিজি হাসপাতালে ছুটলাম।
তিন তলার সেই কক্ষ দুই ঘন্টার ব্যাধানে অনেক বদলে গেছে। শুনশান নিরবতা। ওয়ার্ড বয়কে ওদের কথা জ্ঞিগাসা করতেই বললো তারা চলে গেছে আধাঘন্টা আগে।
ভংগ্ন মন নিয়ে বাসায় ফিরলাম। নিজের বোকামীর জন্য ভাগ্যকে বার বার দোষারোপ করলাম।
কোন কিছুই ভাল লাগছেনা। বারবার শিমুলের কথা মনে পড়ছে। কেন এমন হচ্ছে?
ভালবাসার অপেক্ষায় থাকা আমার স্বচ্ছ হৃদয়টাকে ভাগ্য বিড়ম্বনার দরুন আহত হতে হল। কি পোড়া কপাল আমার ২৭ বছরের এই জীবনে প্রথম যারে ভাল লাগলো তাকে ভালবাসি বলার সুযোগ পেলাম না!
লাইট বন্ধ করে শূন্য ঘরে একাকি বসে রইলাম।

1 comment:

আপনার মন্তব্য দিন