Pages

অসম ভালবাসা’

দেয়ালে হেলান দিয়ে একমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে একটি ছেলে।পরনে একটি ময়লা হাফপ্যান্ট, ছেড়া শার্ট, চুলগুলো উসকো খুসকো।তার
বয়স আনুমানিক ১৪-১৫ হবে। অনেকক্ষণ ধরেই এভাবে ঠায় দাড়িয়ে রয়েছে সে। তার দৃষ্টি রাস্তার উপর, কর্মব্যস্ত শত শত মানুষ রাস্তার উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে, শুধু সেই স্থির দাড়িয়ে আছে।
 ‘আইজ অনেক গরম পড়ছে, তাই না রে?’

মাসুদের কথা শুনে যেন সম্বিত ফিরে পেল জামাল, ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার রাস্তার দিয়ে চোখ ফিরিয়ে উত্তর দিল, ‘ হ অনেক গরম।’


‘কামে যাবি না?’

 ‘নাহ, আইজ ভালা লাগতাসে না রে। তুই যা। ‘ চোখ না সরিয়েই কথাগুলো বলল জামাল।
 ‘তোর হইসে টা কি আমারে ক তো? গত এক সপ্তাহ ধইরা কামে জাস না, মাহাজন কিন্তু তোর উপর বেবাক খেপছে।

‘ হটাত কি যেন মনে পড়ল জামালের। সে তার ঝোলা থেকে একটা পুরানো রংচটা ঘড়ি বের করল। কিছুদিন আগে এক ডাস্টবিন থেকে সে কুড়িয়ে পেয়েছিল এই ঘড়িটা।পরে অনেক চেষ্টা করে মেরামত করেছিল। ১০টা বাজতে আর ৫ মিনিট বাকি।


‘ওই, কি হইল? কথা কস না কেন?’ মাসুদেরকথায় ঝাঁজ।


‘আমার একটু কাম আছে,যাই’ বলেই হাটা শুরু করল জামাল।


পিছন থেকে মাসুদ জোরে জোরে চিৎকার করে কি যেন বলছে, তা আর কানে ঢুকল না জামালের। রাস্তার উপর একটি সুদৃশ্য বাড়ি। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো। বিশাল বড় গেট। গত এক সপ্তাহ ধরে জামাল নিয়মিত এই বাড়ির সামনে এসে দাড়ায়। কয়েকবার বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করল।নাহ, আজকে মনেহয় বের হবে না। যখনই সে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল ঠিক তখনি গেট খুলে গেল। সাথে সাথে হৃদস্পন্দন থেমে গেল জামালের। হ্যাঁ, এই তো সেই মেয়েটি, যাকে দেখার জন্য তার প্রতিটা সময় কাটে পরম ব্যাকুলতায়। সে গত কয়েকদিন ধরে অতি সাবধানে এই মেয়েটিকে ফলো করছে। মেয়েটিকে যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয় জামাল। তাকে সে প্রথম দেখেছিল যখন মেয়েটি তার বাবার সাথে এসেছিল তাদের বস্তিতে, শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য। অইদিন নিজ হাতে বস্তির সবার হাতে গরম কাপর তুলে দিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটি। সে সময় তার চোখ মুখে যে আনন্দ খেলা করছিল তা আজও ভুলতে পারেনি জামাল। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় মেয়েটিকে। এরপর অনেক খুঁজে খুঁজে তাদের বাড়িটা খুঁজে বের করেছে।

মাঝে মাঝে মেয়েটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে তার। পরক্ষনেই নিজেকে শাসিয়ে নেয় সে। জামালের বাবা মা নেই, অনাথ। শহরের কাছেই একটি বস্তিতে তার চাচার সাথে থাকে সে। সংসারের অভাব অনটন তাকে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিতে বাধ্য করেছে। বস্তির আর ৮/১০ টা ছেলের মত সেও ভিক্ষা করে। সে জানে, যে চিন্তাভাবনা সে এই মুহূর্তে মেয়েটি কে নিয়ে করছে টা পুরাপুরি অবাস্তব এবং অসম্ভব। তাদের মধ্যে পার্থক্যটা অনেক বেশি। অনেকবার চেষ্টা করেছিল মেয়েটির চেহারা ভুলে যেতে, কিন্তু পারেনি। নিজেকে মনে মনে অসংখ্যবার মানা করেছে সে, অনেকবার পণ করেছে যে আর আসবেনা এই বাড়ির সামনে। কাজ হয়নি, নিজেকে আটকাতে পারেনি জামাল।
 মেয়েটা রাস্তার more এ অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছে রিক্সার জন্য। মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে রিক্সা খুজছে মেয়েটি। মেয়েটিকে এখন আরও সুন্দর লাগছে দেখতে। আনমনে হেসে ওঠে জামাল। তার জীবনের যে কোন কিছুর বিনিময়েও সে এই মুখ বারবার দেখতে চাইবে।
 মেয়েটা ব্যাগ থেকে তার মোবাইল ফোন টা বের করল, হয়ত ফোন এসেছে। হাত পা নাড়িয়ে কাকে যেন একটানা নালিশ করেই যাচ্ছে মেয়েটি। একমনে সেই দিকে তাকিয়ে আছে জামাল। আহ, একবার যদি কথা বলতে পারত তার সাথে, মেয়েটি যদি একবার তাকাত তার দিকে!

এমন সময় জামাল খেয়াল করল, তার বিপরিত দিক থেকে মাসুদ মেয়েটির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। মাসুদের দৃষ্টি মেয়েটির উপর। চমকে উঠে জামাল। সে জানে মাসুদ কি করতে যাচ্ছে। ভিক্ষার পাশাপাশি তারা মাঝে মাঝে আশেপাশের এলাকায় ছোটখাটো চুরি, ছিনতাইও করে। মাসুদ মেয়েটির একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় জামালের। জামাল কি করবে বুঝতে পারে না। মুহূর্তের মধ্যে মাসুদ একটা হ্যাঁচকা টান মেরে মেয়েটির মোবাইল কেড়ে নিয়ে দৌড় দেয়। জামাল চিৎকার করে মাসুদ কে ডাকে, ‘মাসুদ!’ মাসুদ জামালকে দেখতে পেয়ে তার দিকে দৌড়াতে শুরু করে।


মাসুদ এখন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার পিছনে মানুষের ঢল। জামালের কাছে এসে তার হাতে মেয়েটির মোবাইল ফোনটি ধরিয়ে দেয়, ‘দৌড়া ব্যাটা, তুই ওই গলিতে ঢুইকা পড়, আমি এইটাতে ঢুকলাম।‘ এই কথা বলেই মাসুদ একটা গলিতে ধুকে হারায় গেল। সামনে তাকিয়ে দেখল জামাল। বিশাল জনসমুদ্র তার দিকে ‘চোর’ ‘চোর’ বলতে বলতে ধেয়ে আসছে। জামাল নড়ল না। স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। সবাই এসে চোর ভেবে জামালকে এলপাতারি পেটাতে শুরু করল। অসহ্য ব্যথায় কেপে উঠলো জামালের পুরো শরীর। এক সময় তার সকল অনুভূতি ভোতা হয়ে আসলো, শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তি ছাড়া। তাকে সবাই আঘাত করছে, কিন্তু তার ব্যথা লাগছে না। জামাল বুঝতে পারল যে, সে মারা যাচ্ছে। এমন সময় সে দেখল ভিড় ঠেলে একজোড়া ভীত চোখ তার দিকে এগিয়ে আসছে।

 এই তো জামালের সেই ডানাকাটা পরীটা। যাক!!! একবার হলেও তো তার দিকে তাকিয়েছে মেয়েটি। জামালের স্বপ্ন পুরন হয়েছে। যদিও মেয়েটির চোখে সে অন্য কিছু দেখবে আশা করেছিল, তার পরিবর্তে সেখানে ভয় আর ঘৃণা খেলা করছিল, তবুও জামালের একটা সান্ত্বনা- সে অন্তত তার সবচেয়ে প্রিয় মুখ টা দেখতে দেখতে মরতে তো পারছে। মুখে একটা সুক্ষ হাসির রেখা নিয়েই শেষবারের মত চোখ বন্ধ করে সে।

 শেষকথা ঃ আমাদের চারপাশের জামালদের মত এমন অনেক ছেলেরই প্রেমকাহিনী অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেকের ভালবাসাই থেকে যাচ্ছে অব্যক্ত। জামালের মত গরিবদের হয়ত ভালবাসার অধিকার নেই, নেই স্বপ্ন দেখার অধিকার। এটা আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা তাদের দিতে পারেনি। ধিক্কার এই সমাজকে!ধিক্কার!ধিক্কার!

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন