Pages

ভালবাসলে কখনোই দুঃখিত বলতে নেই...

অসাধারণ এই বাক্যের জন্ম জগৎজুড়ে আলোড়িত, প্রশংসিত ও আলোচিত। ভালবাসার একটি গল্প কাহিনী "লাভ স্টোরি" থেকে। লাভ স্টোরি সম্ভবত বিশ্বজুড়ে
গল্পের মূল চরিত্র অলিভার, সে গল্পে আমাদের জানায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা। কিভাবে অলিভার জীবনের প্রিয় সেই মানুষটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়, কিভাবে তাদের মাঝে ভালবাসার জন্ম এবং অবশেষে জেনিফারের মৃতু্য।
গল্পের সাফল্যের পর জনপ্রিয় এই কাহিনী পরবতর্ীতে কিছুটা কাটসাট করে চিত্রনাট্যে রূপ নেয়। ছবিতে অভিনয় করে এলি ম্যাকগ্রে এবং রিয়ান নীল। এই ছবি পরবতর্ীতে ৭টি বিভাগে অস্কার মনোয়নসহ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য এবং ছবি হিসেবে অস্কার জিতে নেয়। গল্পের শুরম্নটা অসাধারণ। এখন একটি চমৎকার শুরম্ন সত্যিই চমকপ্রদ।
"একজন পঁচিশ বছরের তরম্নণীর মৃতু্য আপনার মনে কি রেখাপাত করে? যখন আপনি জানবেন সে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। পাশাপাশি সে মোর্জাট এবং বিটলস শুনতেও খুব ভালবাসে এবং ভালবাসে আমাকে..."
ধ্রূপদী এই সূচনা গল্পের কাহিনীকে আজীবন অমস্নান করে রাখবে পাঠকের হৃদয়ে। কিছুটা অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অলিভার খুব দ্রম্নত এবং সহজে প্রেমে পড়ে পাশর্্ববতর্ী আরেকটি কলেজের সঙ্গীত বিভাগের ছাত্রী জেনিফারের। অলিভার বেরেট পড়েন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পাশাপাশি সে বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্টেও অংশগ্রহণ করে। গল্পের অন্য চরিত্র জেনিফার প্রথম দিকে কিছুটা সঙ্কোচবোধ করলেও পরবতর্ীতে দেখা যায় তাদের ভালবাসা সঠিক পথে এগোয়। প্রথম দিকে অলিভার ভাবে জেনিফার হয়ত তার ওপর কিছুটা বিরক্ত কিনত্মু পরবতর্ীতে অলিভার জেনিফার সম্পর্কে সবকিছুই জানতে পারে। অলিভার তার পড়ালেখা নিয়েও কিছুটা হতাশাগসত্ম ছিল। প্রথম দিকে জেনিফারের সঙ্গে প্রথম যখন তার দেখা হয় তখন সে কিছুটা কৌতুকছলে এই কথাটি জানায়।
অন্যদিকে জেনিফার ছিল প্রাণবনত্ম এবং নিজের প্রতি আসত্মাশীল। পুরো গল্পজুড়ে তাদের দু'জনের মাঝে যে বাক্যবিনিময় হয় তা সত্যিই চমৎকার। অলিভার যতই জেনিফারকে বোঝানোর চেষ্টা করত তত দ্রম্নতই জেনিফার সে ব্যাপারে তার মতামত ব্যক্ত করত। তাদের এই ভার্বাল ডুয়েল বা তর্কযুদ্ধ তাদের বিয়ের পরও চলতে থাকে। গল্পের সবচেয়ে চমৎকার অংশটি হলো অলিভার যখন জেনিকে বিয়ের প্রনত্মাব দেয়। আর অন্যদিকে এই প্রসত্মাবে জেনিফার সব শানত্ম মেজাজে নিজের ইচ্ছার কথা জানায়। জেনিফারের চরিত্রটি সত্যিই পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যখন সে অলিভার এবং তার পিতার মধ্যে যে দূরত্ব তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। গল্পের অলিভারের হকি গেমসেরও কিছু ছবি পাওয়া যায়, যেখানে জেনিফার অলিভারের প্রতিটি গেমসে তাকে প্রেরণার পাশাপাশি সাহস দেয়। অলিভারের চরিত্রটিও চমৎকার এবং মজার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই ছাত্র যখন জেনিফারকে তাদের সম্ভাব্য সনত্মানের নাম ঠিক করার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করে। অলিভারের রম্নমমেটদের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তাও পাঠকদের খুব মজা দেয়। সবচেয়ে মজার কিংবা হাসির ব্যাপার হলো তাদের সনত্মানদের যখন নাম ঠিক করা হয়।
অলিভার চায় তাদের পুরম্নষ সনত্মানের নাম হবে বোজো। এবং জেনিফারকে কনভিন্স করতে অলিভার অনেক হাস্য-কৌতুকের জন্ম দেয়।
যদিও গল্পের শুরম্নতেই পাঠক জানতে পারে কেন্দ্রীয় চরিত্র জেনিফারের মৃতু্য তবুও গল্পের যে ধারাবাহিকতা সে ধারায় যখন পাঠক এগোতে থাকে তখন সে নিজেই সম্পৃক্ত হতে চায় এই কাহিনীতে। পাঠক জানতে পারে জেনিফার খুব দ্রম্নত মৃতু্যমুখে পতিত। জেনিফারের শেষ সংলাপ ছিল "ধন্যবাদ অলি"। এই সংলাপের পরবতর্ী সংলাপের মাধ্যমেই জন্ম শতাব্দীর প্রেম সংলাপ "ভালবাসলে কখনোই দুঃখিত বলতে নেই" এই ছিল অলিভারের উত্তর।
গল্পের শেষ দিক ছিল খুবই সহজ কিনত্মু বেদনাদায়ক। প্রতিটি পাঠক গল্পের শেষ দিকগুলো বার বার উল্টিয়ে পড়ে ফিরে পেতে চায় সেই জেনিফারকে। অনেক মানুষ এই অনবদ্য গল্পের শেষ দিকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন গল্পের বেদনাদায়ক পটভূমির কারণে। একদম শেষ দিকে দেখা যায় অলিভার তার পিতার কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
খুব সংপ্তি এই গল্প খুব দ্রম্নত শেষ করা গেলেও এর আবেগ পাঠক হৃদয়ে চির অমস্নান থাকে সারাটা জীবন। এর পূর্বে এত সংপ্তি কিনত্মু জনপ্রিয় ভালবাসার গল্প সৃষ্টি হয়নি। এই গল্পের আকর্ষণীয় দিকটি হলো গল্প-উপন্যাসের তথাকথিত সংলাপকে বাদ দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে বানত্মবজীবনের কথোপকথন। ট্রেজিক এই অনবদ্য ভালবাসার গল্প সবার মনকে ছুঁয়ে যায়।
একটি সময় মনে করা হতো সাবেক মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোরের জীবনের কাহিনীকে ঘিরে এই গল্পের পটভূমি। কিনত্মু পরবতর্ীতে লেখক নিজেই এক সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যাপারটির সুরাহা করেন। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে এরিক সেগাল জানান, গল্পের কাহিনী আল-গোরকে ঘিরে নয় বরং লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় সময়কালীন সহপাঠী টমি লি জোনসের জীবনের সত্যিকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই গল্প।
লাভ স্টোরি গল্পের সাফল্যের পর ইরিক সেগাল পরবতর্ীতে অলিভারের জীবনের গল্প নিয়ে আরেকটি লেখা প্রকাশ করে। খুবই সংপ্তি এই গল্পের শুরম্ন জেনিফারের মৃতু্য দুই বছরের পর। এই গল্পের নাম "অলিভার'স স্টোরি"।

আলোচিত এমন একটি গল্প যার তীব্র আবেগ ছুঁয়ে যায় পাঠকের হৃদয়ে এবং এর ব্যাপ্তি ঘটে প্রত্যকের ব্যক্তিগত জীবনে। এই ধরনের একটি গল্প সম্পর্কে বলতে যাওয়া সত্যিই মুশকিল। সত্তর দশকের আলোচিত এই গল্প মূলত একটি ছবির চিত্রনাট্য থেকে উঠে আসে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো গল্পের নায়কের কাহিনী তৈরি করা হয় লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় রম্নমমেট টমি লি জোনকে কেন্দ্র করে।
এরিক সেগাল -এর জীবনী
এরিক সেগালের জন্ম একটি ইহুদী ধর্ম যাজকের পরিবারে। পরবতর্ীতে তিনি ব্রম্নকলিনের মিডওড হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং সেই স্কুলের গ্রীষ্মকালীন কোর্স করতে মাঝে মাঝে ইউরোপ ঘুরে আসতেন। পারিবারিক ঐতিহ্যগত কারণেই খুব অল্প বয়স থেকেই এরিক সেগাল পরিচিত হন পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের সঙ্গে। এরিক সেগাল কাসিক্যাল কবিতা এবং লাতিন সেলুটেটোরিয়ান এই দুই বিষয়ে স্নাতক করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। ডক্টরেট করেন সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে। ১৯৬৫ সালে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনের পর সেগাল শিৰকতাকেই তার পেশা হিসেবে বেছে নেন এবং এর পাশাপাশি চলে তার লেখার কাজ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক এবং লাতিন সাহ্যিতের অধ্যাপক নিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তিনি রেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিৰকতা করেন। এর পাশাপাশি সেগাল ছিলেন ওলফসন কলেজ, অক্সফোর্ডের অনারারি ফেলো। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন বিখ্যাত রক ব্র্যান্ড বিলটসের ইউলো সাবমেরিনের চিত্রনাট্য দিয়ে তার লেখক জীবনের যাত্রা শুরম্ন। লি মিনোফের লেখা বই ইউলো সাবমেরিনের চিত্রনাট্যের ওপর ভিত্তি করেই বিটলস তাদের প্রথম ছায়াছবি ইউলো সাবমেরিন।
ষাট দশকের শেষ দিকে অন্যান্য চিত্রনাট্যকারের সহায়তায় সেগাল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী এবং রেডকিফ কলেজের এক ছাত্রীর বাসত্মবজীবনের কাহিনীকে ঘিরে চিত্রনাট্য লেখেন। কিন্তু চিত্রনাট্যটি বিক্রি করতে সেগাল ব্যর্থ হন। যাই হোক তার এক এজেন্ট তাকে পরামর্শ দেয় চিত্রনাট্যটি গল্পে প্রকাশ করার। এরপর চিত্রনাট্যটি গল্পাকারে প্রকাশ করা হয় এবং পুনরায় সেই একই চিত্রনাট্য দিয়ে তৈরি করা হয় চলচ্চিত্রে। লাভ স্টোরি গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিউইয়র্ক টাইমসের সর্বোচ্চ বিক্রীত বই হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৭০ সালে এই কাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রেষ্ঠ গল্প হিসেবে পুরস্কৃত হয়। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ৩১টি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। লাভ স্টোরি গল্প নিয়ে নির্মিত ছায়াছবিটি ১৯৭০ সালের বক্স অফিসে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ১৯৭৭ সালে এই গল্পের ধারাবাহিক আরেকটি গল্প তিনি লেখেন এবং গল্পের নাম দেয়া হয় অলিভার্স স্টোরি।
এরিক সেগাল তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য পা-িত্যপূর্ণ কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এরিক সেগাল ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গ্রীক এবং লাতিন সাহিত্য নিয়ে অসংখ্য লেখা লিখেছেন। তার লেখা বই সাগা ফ্রান্স এবং ইতালীয় সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করে। এছাড়া ডক্টরস তার অন্যতম অনবদ্য উপন্যাস।
১৯৭৫ সালে সেগাল কেরেন জেমসকে বিয়ে করেন। কেরেন জেমস একজন ফ্রি লেন্স সাংবাদিক এবং সাহিত্য সমালোচক। গত ১৭ জানুয়ারি রবিবার ৭২ বছর বয়সে হার্টএ্যাটাকে আক্রানত্ম হয়ে মৃতু্যবরণ করেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তার কন্যা ফ্রান্সসিসকা সেগাল জানান, তার পিতা লন্ডনের নিজ বাসগৃহে মৃতু্যবরণ করেন। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর পারকিনসন রোগে ভুগছিলেন। তার শেষকৃত অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনের একটি ইহুদী কবরস্থানে এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার সেই বিখ্যাত উক্তি ভালবাসলে কখনই দুঃখিত বলতে নেই_ এখন রীতিমতো আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকার প্রিয় একটি উক্তি। এই বিখ্যাত উক্তি নিয়ে গায়ক জন লেলন বলেন, "এই উক্তি অবশ্যই আমাদের আধুনিক প্রেমময় জীবনের একটি বিখ্যাত সংলাপ, তবে আমি মনে করি ভালবাসা মানে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর দুঃখিত বলা।" ১৯৭০ সালের সেই বিখ্যাত গল্প সেগালকে পরিণত করে একজন সেলিব্রেটি হিসেবে। এর পাশাপাশি অলিম্পিক গেমসের ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তাকে বিভিন্ন টিভি শোতে দেখা যায়।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন