Pages

প্রথম লাভ লেটার (বাঁশি)


বৃষ্টি,

আমি খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি তোমাকে একটা সত্য কোনো ভাবেই বোঝাতে না পেরে। একটা মানুষ আর কতো কদর্য ভাবে বলতে পারে আমি জানি না। আমি তোমাকে ভালোভাবে বলেছি, আবার অনেক কদর্যভাবেও বলেছি। কোনোভাবে বলেই যখন কাজ হচ্ছে না তখন আমি সত্যিই দিশেহারা। তুমি প্রতিদিন কষ্ট পাচ্ছ, আমার কারণে, আমার ব্যবহারে। অথচ আমি এটা চাই না। এভাবে কষ্ট পাওয়া তোমাকে মানায় না। আজকাল তোমার কথা ভাবতে গেলেই বারবার সেই বিখ্যাত আমেরিকান গল্পটা মনে পড়ে। গল্পটা শোনো। তোমার জন্যে খুব প্রযোজ্য। এক বালকের খুব বাঁশি বাজানোর শখ। সে স্কুল যাবার সময় পথে একদিন এক বংশীবাদককে বাঁশি বাজাতে দেখে। সেই বাঁশি ওয়ালা হয়তো অতো চমৎকার বাঁশি বাজায় নি; কিন্তু জীবনে প্রথম শোনা সেই বাঁশির মিষ্টি সুর ভীষণ মুগ্ধ করে তাকে। হঠাৎ করেই বাঁশির প্রতি এক দুর্নিবার টান অনুভব করে সে। তারপরেই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সেও বাঁশি বাজানো শিখবে।


সেদিন বাসা ফিরেই সে তার বাবাকে সেই বঁশিওয়ালার কথা বললো। তারপরেই চেয়ে বসলো তার নিজের জন্যে একটা বাঁশি। বললো, সেও সেই রকম সুন্দর করে বাঁশি বাজানো শিখবে। বাবা তার কথা শুনলেন। হাসলেন। কিন্তু ছেলের পড়াশুনার ক্ষতি হবে বা এসব ঠুনকো আবেগকে পাত্তা দেয়া উচিৎ নয় ভেবে বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক বাঁশি কিনে দিতে রাজি হলেন না।


কয়েক সপ্তাহ ধরে চেয়ে চেয়ে বাবার কাছ থেকে বাঁশি কিনে না পেয়ে মনের দূ:খে সে সিদ্ধান- নিলো যে সে নিজেই একটা বাঁশি কিনবে। স্কুলে টিফিন খাবার জন্যে প্রতিদিনই মা তাকে কিছু পয়সা কড়িদিতেন। সে টিফিন খাওয়া বন্ধ করেদিয়ে সেইটাকা জমাতে লাগলো বাঁশি কিনবে বলে। এদিকে বাঁশি কেনার দুশ্চিন্তায় তার দিন কাটেনা,রাত কাটে না। কখন তার টাকা জমবে, আর কখন সে বাঁশি কিনবে! মহা অস্থিরতা মনে মনে। প্রতিদিনই সে টাকা গুনে দেখে আর টাকা বেশি করে জমছে না দেখে মন খারাপ করে বসে থাকে। বাঁশির দাম সে জানে না, কিন্তু যে বাঁশিতে এতো সুন্দর প্রাণ উতলা করা সুর ওঠে সে বাঁশির দাম নিশ্চয়ই কম নয়- এমনই তার ধারণা।


মাস দুয়েক পর একদিন সকালে সে স্কুল ফাঁকি দিয়েবাঁশি কিনতে বেরিয়ে পড়লো। সংগে দুই মাসে জমানো সমস্ত টাকা। কিছুদিন আগে সে তার এক বন্ধুর সংগে গিয়ে শহরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত একটা বাঁশির দোকান চিনে এসেছিলো। এখন ছুটলো সোজা সেই দোকানে। একটা কালো লম্বা সরু বাঁশি তার পছন্দ হলো। এরকমই একটা বাঁশি সে সেই বাঁশিওয়ালাকে বাঁজাতে দেখেছিলো। সেই মোহনীয় সুর তুলতে হলে তাকেও এই বাঁশিই কিনতে হবে।


বালক বাঁশিটি হাতে নিয়ে দোকানীর সামনে গেলো। তারপর তার প্যান্টের পকেট উল্টে সবগুলো টাকা আর কয়েন ঢেলে দিলো মেঝেতে। তারপর বললো, আমি এই বাঁশিটা কিনবো। দেখুন তো এই টাকার হয় কিনা।


দোকানী দেখলো অনেকগুলো খুচরো কয়েন। বললো, আমি গুণে দেখি, তুমি ততোক্ষণে অন্য বাঁশিগুলোও দেখতে পারো।


দোকানীর কথামতো সে গ্যালারীর সামনে এসে অন্য বাঁশি গুলো দেখতে লাগলো। কিন্তু আর বাঁশি দেখে কি হবে? সে তো স্থির করেই ফেলেছে যে হাতের কালো বাঁশিটিই সে কিনবে, অন্য বাঁশি নয়। তাতে দাম যতোই লাগুক।


দোকানী গুণে দেখলো যে প্রায় পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু সেই বাঁশির দাম তো মাত্র পাঁচ টাকা। দোকানীর সন্দেহ হলো। এতো টাকা এই বাচ্চা ছেলে পেলো কোথায়? নিশ্চয়ই তার বাবা মা তাকে বাঁশি কেনার জন্যে এতো টাকা দেয় নি? তাদের তো মোটামুটি দাম জানা থাকার কথা। তাহলে কি এই বালক বাসা থেকে টাকা চুরি করে এনেছে?


এ কথাই জিজ্ঞেস করার জন্যে দোকানী ডাকলো বালটিকে, “এই যে বাবু, এদিকে এসো।” বালকটি ভাবলো, বোধায় টাকা কম আছে। দামে হচ্ছে না। কিন্তু আমার কাছে তো আর কোনো টাকা নেই। কিন্তু এ বাঁশি তো আমার কিনতেই হবে। আজ এবং এক্ষুণি। সে তৎক্ষনাৎ ঠিক করে ফেললো যে সে আর দোকানীকে কোনো টাকাও দেবে না, দোকানীর কোনো কথাও শুনবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। দোকানীর দিকে না গিয়ে সে বাঁশি নিয়ে দিলো দৌড়। দোকানী প্রথমে থতোমতো খেয়ে গেলো। একি! ছেলেটা কি পয়সা ফেরত নেবে না?


পর মুহূর্তে দোকানীও দৌড়ে এলো। কিন্তু ততোক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বালকটি দৌড়ে দিয়ে সোজা রাস্তায় না গিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়েছে। দোকানী আর দেখতে পেলো না তাকে।


সেদিন বালকটি আর স্কুলে গেলো না। স্কুল ছেড়ে দূরের এক মাঠে গিয়ে মনের আনন্দে ইচ্ছে মতো বাঁশি বাজালো। বাঁশি বাজানো হচ্ছে না, সুর উঠছে না, তবু খুশিতে সে আত্মহারা। মনে মনে স্বপ্ন দেখছে সেও একদিন সেই বংশীবাদকের মতো মধুর সুর তুলবে বাঁশিতে। দুপুর পার করে বিকেল পর্যন্ত সে সেই নির্জন মাঠে বাঁশি বাজালো। না খেয়ে কোনো খাবার, না পিয়ে কোনো পানীয়। ক্ষুধা তৃষ্ণার সব উপলব্ধি যেনো নিঃশেষ হয়ে গেছে বাঁশি পেয়ে।


স্কুল ব্যাগে বাঁশিটি ভরে নিয়ে ব্যাগ কাঁধে প্রতিদিনের মতো যথাসময়ে বাড়ি ফিরলো সে। প্রথমে ভেবেছিলো যে বাবা মাকে বাঁশি কেনার কথাটা বলবে না। কিন্তু পরে ভাবলো, সে তো আর টাকা চুরি করে বাঁশি কিনে নি, বরং টিফিন খাওয়ার নিজের পয়সা বাঁচিয়ে কিনেছে। এটা তো তার গর্বেরই বিষয়। এই গর্বে সে আর কথা চেপে রাখতে পারলো না। রাতে খাবার পরে সে তার বাবা মাকে বাঁশিটি দেখিয়ে বললো, এই যে দেখো, আমার বাঁশি; আমি নিজেই কিনেছি।


বাবা মা আঁৎকে উঠলেন, সে কী! টাকা পেলে কোথায়?


“হূঁহ্‌হু! হেহহে!” বেশ আত্মতৃপ্তির ভাব করলো সে। তারপর বললো,


“গত দুমাসে তোমরা টিফিন খেতে যতো টাকা দিয়েছিলে তার সব টাকা জমিয়ে আমি এটা কিনেছি।”


“কী বলছো? দুমাসের সব টাকা?”


“ইয়েস পাপা, ইয়েস ম্যাম। সব টাকা।”


তার মা হিসেব করলেন যে দুমাসের সব টাকা জমালে সেটা পঞ্চাশ টাকার কাছাকাছি হবে। কিন্তু এ বাঁশির দাম তো আট দশ টাকার বেশি হবে না। এবার মা তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বললেন,


“আচ্ছা বাবা, সত্যি করে বলো তুমি কি সব টাকা দোকানীকে দিয়ে এসেছো।”


“হ্যাঁ মম, সব দিয়ে দিয়েছি।”


বলেই সে বাঁশি কেনার সব গল্প শুনিয়ে দিলো।


এবার তার বাবা বললেন, “তুমি তো মহা বোকার মতো কাজ করেছো। এ বাঁশির দাম তো দশ টাকার বেশি নয়।”


শুনে বালকটির সমস- আনন্দ মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেলো। সে কান্না জুড়ে দিলো। হায় সে কী করেছে! সে তো আরো ছটি বাঁশি কিংবা অন্য খেলনাও অনেকগুলো কিনতে পারতো। এক বাঁশি কিনতে গিয়ে সে তার সব টাকা ফুরিয়ে দিয়েছে!

 

বৃষ্টি, তোমার খারাপ লাগলেও আমি বলবো তুমিও সেই বালকের মতো ঠকে যাওয়া এক বোকা বালক। বাঁশি চিনতে ভুল করার মতো তুমি এখনো মানুষ চিনতে ভুল করে যাচ্ছ! ভুল করে বারবার কষ্ট পাচ্ছো। প্রথম জীবনে তুমি বোকামি করে অথবা আবেগের কাছে ধরাশয়ী হয়ে একটা ভুল করেছিলে, যা তোমাকে অনেকদিন ভুগিয়েছে। এখন তুমি আমাকে ভালোবেসে, আমাকে চেয়ে, আরেকটা ভুল করছো। তুমি আমাকে মনেপ্রাণে চেয়ে আসলে বেশি দামে শস্তা বাঁশি কিনতে চাইছো। আমি যদিও নিজেই সেই রঙিন চকচকে অথচ শস্তা বাঁশি, তবুও আমি তোমাকে বাঁচাতে চাচ্ছি যাতে তুমি আমাকে চেয়ে আমাকে পেয়ে কখনো না ঠকো। তোমার মতো সুন্দরী চমৎকার একটা মেয়ের আসলে অনেক সুখী শানিত্মময় জীবন প্রাপ্য, যা তুমি কখনোই আমার কাছে এসে পাবে না। সত্যি কথা কি, তুমি দেখো না, আমি কীভাবে তোমার সাথে কথা বলি? যতোটা কদর্যভাবে এবং কাঠখোট্টা সুরে আমি তোমার সাথে কথা বলি, আমার ভেতরটা তারচেয়েও কদর্য। আমার মনটা যে সংকীর্ন, অনুদার, এটা আমি জানি। এতে আমার বেশি কষ্ট নেই। পৃথিবীতে অনেক মানুষেরই মন খুব ছোটো। আমার সমস্যা হলো এই ছোট্টো মনটা আবার নানা কুটিলতা আর জটিলতায় ভরা। আমার মনের এই চরিত্রের কথা আমি কাউকে বলি না। তোমাকে বললাম, কারণ তোমার কোনো ক্ষতি আমি চাই না। তোমার মতো প্রকৃতি প্রেমী নরম মনের একটা মানুষ আমার মনের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আটকা পড়ুক এটা আমি মেনে নিতে পারি না।


বৃষ্টি, আমার অনুরোধ, তুমি ফিরে যাও। দয়া করে ফিরে যাও। মনে রেখো, পৃথিবীটা কিন্তু আমার মতো এতোটা খারাপ, এতোটা নিষ্ঠুর হয়ে যায় নি। আমার কাছ থেকে একটু মুখ ফিরিয়ে দেখো। পৃথিবী তোমার জন্যে ভালোবাসার দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তুমি ফিরে যাও। আমি তোমাকে বললাম, তুমি দেখো, আমাকে না পেলেও অন্য অনেক ভাবে তুমি এতো ভালোবাসা, এতো আদর আর সুখ পাবে যে, ভুলেও আমার কথা তোমার আর মনে পড়বে না। কারণ, তুমি এ রকমই। কখনো আধো আধো ভালোবাসা বাসতে জানো না। ভালোবাসলে সবটুকু দিয়েই ভালোবাসো। আজ আমাকে ভালোবাসো বলে মনে হচ্ছে আমাকে ছাড়া তোমার চলবে না। আসলে এটা তোমার আবেগ। আমাকে ছাড়াই তোমার বিগত বছরগুলো কী দিব্যি চলে গেছে না, বলো? ভবিষ্যতটাও চলে যাবে। এবং আমি আশা করবো বেশ আনন্দেই যাবে।


বৃষ্টি, আমি নিশ্চিত আমার এই চিঠি পড়ে তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি ততোধিক নিশ্চিত যে একদিন তুমি আমার উপর খুশি হবে এই ভেবে যে, আমি তোমাকে একটা ভুলের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। যখন একদিন কোনো এক রোদপোড়া অলস দুপুরে অথবা এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় অথবা আকাশ ভরা তারার মোহ ধরা অস্পষ্ট আলোয় মধ্যরাতে অথবা পূর্ণিমার ভরা চাঁদের জোসনায় ভেসে যাওয়া রাতের শেষ প্রহরে কোনো এক ভালোবাসাময় সুপুরুষ পরম মমতা আর আদরে তোমাকে বুকে টেনে নেবে সেদিন তুমি ঠিক বুঝবে আমার মতো রোবোট তোমার জন্যে কখনোই উপযুক্ত ছিলো না।

 
ইতি-রফিক স্যার

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন