Pages

* যত গোপনে ভালোবাসি পরাণ ভরি... *

  'সখি কেমনে বাঁধিব হিয়া'-এই কাতরতা ঝরে পড়বে আজ হিয়ার মাঝে। প্রতিদিনের মতই প্রাচীন সূর্য আজ প্রভাতেও দশদিগন্তে আলোর নাচন তুলে চোখ মেলবে । তবে দখিন হাওয়া আজ হূদয়বনে ছড়িয়ে দেবে উতোল-চঞ্চল গুঞ্জরণ। গ্রিক অমর কথায় অমরাবতীর তীর ছুঁয়ে স্বর্ণরেণু পালকে মেখে ভেসে আসবে বর্ণিল প্রজাপতি আর ভ্রমরের ঝাঁক। আজ দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা । বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আজ। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে। 'যত গোপনে ভালোবাসি পরান ভরি/পরান ভরি উঠে শোভাতে/যেমন কালো মেঘে অরুণ-আলো লেগে/মাধুরী উঠে জেগে প্রভাতে'...গহীনের ভালোবাসা প্রকাশের দিন আজ। মনের যত বাসনা,অব্যক্ত কথা তার ডালপালা-পত্র-পল্লব মেলে ছড়িয়ে পড়বে বসন্তের উতোল মধুর হাওয়ায়। প্রাণে প্রাণে লাগবে দোলা, মুখ রেখে দখিনা বাতাসে, চুপি চুপি বলার দিন 'সখী, ভালোবাসি তারে'..। আজ হূদয় গহনে তারাপুঞ্জের মত ফুটবে চণ্ডিদাসের সেই অনাদিকালের পদ- "দুঁহু তার দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া/ অর্ধতিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া/সখি কেমনে বাঁধিব হিয়া...। আকুতি ঝরবে -'তুমি কি দেবে না সাড়া প্রিয়া বলে যদি ডাকি? হেসে কি কবে না কথা হাত যদি হাতে রাখি'। শচীনকর্তার গানের মতোই বুকের আগল খুলে বলার দিন 'প্রেম করেছি আমি'। চিরচেনা প্রাণের বসন্ত নতুন রঙ দিয়েছে আজ। প্রকৃতি সেজেছে ভালোবাসার আবেশে। পাতায় পাতায় লেগেছে রঙ। দুলছে মধুর আরতি। এই তো সেই ক্ষণ ভালোবাসিবার। পৃথিবীর সব সাহিত্য ডুবে আছে ভালোবাসা নিয়ে কাব্য-মহাকাব্য,গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাসের অতলান্তে। তারপরও ভালোবাসা কি এই প্রশ্নে খেই হারিয়েছেন রথি-মহারথিগণ। কেউ বলেছেন, প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ, প্রেমের বিরহ থাকে সমস্ত জীবন। আবার কেউ বলেছেন, 'ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী।' কবিগুরুর ভাষায়, 'তোমরা যে বল দিবস-রজনী, ভালোবাসা, ভালোবাসা, সখী ভালোবাসা কারে কয়। সে তো কেবলই যাতনা নয়।' অতুল প্রসাদ তার গানের ভাষায় বলেছেন, 'আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, মনে পড়ে ওগো প্রিয়, চাঁদ হয়ে রব আকাশেরও গায়, বাতায়ন খুলে দিও।' চন্ডিদাস বারো বছর ছিপ ফেলে বসে থেকেছেন রজকীনির এক পলক চোখাচোখির জন্য। চন্ডিদাসের ভাষায় 'রজকীনি প্রেম -নিকষিত হেম।' আধুনিক কবির চিরন্তন কণ্ঠে প্রেয়সিকে বলা: 'পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী'। আজ বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতা আর ভালোবাসার উত্সবে মুখর হবে জনপদ। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের গবেষকদের অনেকে বলে থাকেন, ফেব্রুয়ারির এই সময়ে পাখিরা তাদের জুটি খুঁজে বাসা বাঁধে । নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে ওঠে। তীব্র সৌরভ ছড়িয়ে ফুল সৌন্দর্যবিভায় লাজুক আর ঢলঢলে হতে থাকে। বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে বসন্ত উত্সব সেই অনাদিকাল থেকেই যাপিত হচ্ছে। সনাতন ধর্মআচারিরা দোল যাত্রা, বাসন্তি পূজা, হোলি উত্সবে প্রণয়কে মুখ্য করে রেখেছিল। প্রচারণা দাক্ষিণ্যে আমাদের বসন্ত উত্সবকে পাশ্চাত্য ভ্যালেন্টাইন ডে'র মোড়কে অধিকার করে নিয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ার ফোরটিন্থ ফেব্রুয়ারীর এই প্রেম উত্সব তারুণ্যের ভেতর এক অদেখা ভুবনের উত্তেজনা ছড়ায়। এ দিনে মুঠো ফোনের ক্ষুদে ভ্যালেন্টাইন ডে পালনের এই রীতিটি মূলত ইউরোপীয় ঘরানার। আমাদের দেশে প্রায় দুই দশক ধরে এ দিবস পালন করছে তরুণ-তরুণীরা। ওদিকে পাশ্চাত্যে সেই খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপিত হয়ে আসছে। এক্ষণে এটা বিরাট উত্সবের রূপ পাচ্ছে। প্রাচীন দুটি রোমান প্রথা থেকেই দিবসটির সূত্রপাত। এক পাদ্রি ও চিকিত্সক ফাদার সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে দিনটির নামকরণ হয়েছে 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে'। যুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিত্সার অপরাধে রোমান সম্রাট গথিকাস ২৭০ খৃস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লিখে রেখে যান। চিঠির ওপর লেখেন 'ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন'। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। অপর গল্পটি হলো- রোমের চিকিত্সক তরুণ যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের চিকিত্সায় দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল নগর জেলারের দুহিতা। সেই থেকে জন্ম নিয়েছিল তাদের ভালবাসার অমরগাঁথা। ভালবাসার অপরাধে তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ফেব্রুয়ারির এই ১৪ তারিখে। অতঃপর এই ভালবাসাকে স্বীকৃতি পেতে দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করতে হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে। ৪৯৬ খ্রীষ্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। গ্রিক ও রোমান উপকথার মতই ভালবাসা দিবসের উত্পত্তি নিয়ে আরো গল্প-কাহিনী ছড়িয়ে আছে । গতকাল ছিল বাঙালির বসন্ত বরণের দিন। একদিকে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন অপরদিকে আজ এসেছে ভালোবাসা দিবসের ছোঁয়া। ফুল দোকানে থরে থরে সাজানো মল্লিকা, জুঁই, গাঁদা উঠে আসবে ললনাদের খোঁপায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি কেবল যে তরুণদের তা নয়, এদিনে পিতা-মাতা-সন্তানের ভালবাসাও দিবসকে বড়মাত্রায় উদ্ভাসিত করে। অনেকে বলে থাকেন, 'প্রেমের দিন থাকে না, ভালবাসলেই ভ্যালেন্টাইন, সেলিব্রেট করলেই ভালেন্টাইনস ডে'।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন