Pages

প্রেম করার আগে যা জানা দরকার

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
পৃথিবীর কোন কিছুই যদি অবিনশ্বর না হয়, তো নর-নারীর প্রেম সম্পর্ক অবিনশ্বর হবে কেন? প্রেম, নারী ও পুরুষের হৃদয়কে কিছুদিন একত্রে ধরে রাখতে পারে মাত্র। তবুও গভীর প্রেমে পড়ার পর একজন অন্যজনকে বলে, তুমি আমার চিরদিনের, জন্ম-জন্মান্তরের ধরনের সংলাপ। কেন বলে? বলে, সঠিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার অভাবে। বলে, ভয় থেকে। বলে, প্রেম সম্পর্ককে স্থায়ী করার অলিখিত চুক্তি আর নিশ্চয়তা হিসেবে। যখন সে এসব কথা বলছে, তখন সে বুঝতেও পারছে না, আজ যাকে এত ভালো লাগছে, পরিবর্তনের স্রোতে মন বা হৃদয়ের চাহিদা বদলে গেলে, কাল তাকে আর ভালো লাগবে কি না। এক মুহূর্ত পরে কী ঘটবে তা জানার উপায় যেখানে মানুষের নেই, সেখানে জন্ম-জন্মান্তরের নিশ্চয়তা দেবার পরে যখন সম্পর্কের ভাঙ্গন শুরু হয় এবং তা অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন একজন অন্যজনকে কি বলে? ‘মিথ্যেবাদী’ ‘অবিশ্বাসী’ ‘ভ-’ ‘প্রতারক’সহ এ ধরনের যত শব্দ আছে সবই কী ব্যবহার করে না? অবশ্যই করে। ভেতরের সবটুকু ঘৃণা বের করে দিতে, বিক্ষত মনটাকে সুস্থ করে তুলতে এসব শব্দ টনিকের মতোই কাজ করে তখন। নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে এটা তাদের নিয়তি এবং আরও মর্মান্তিক নিয়তি হচ্ছে, তাদের আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না । কিন্তু কেন তাদের আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। গবেষকদের মতে, মানুষের অন্য অনেক নেশার মতো, প্রেমও এক বিশেষ ধরনের নেশা। তবে এই নেশা অন্য নেশার তুলনায় অল্পায়ু। প্রেম হচ্ছে এনজামিন, ইথাইল, ফিনাইলের জৈব রাসায়নিক নেশা। কারও প্রতি প্রেম আকর্ষণ অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে, মাথা থেকে এই রাসায়নিক জোয়ার, স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে রক্তকে নির্ভর করে, সারা শরীরে প্রসবিত হয়। আর তা থেকেই বিভিন্ন রকম প্রেম উপসর্গ দেখা দেয়। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে এই রসায়ন শরীরের ভেতরে একটা টলারেন্স তৈরি করে এবং তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এর সঙ্গে লড়ার মতো প্রেমের নেশা, শরীর আর তৈরি করতে পারে না। যার ফলে প্রেমানুভূতি তার তীব্রতা হারাতে শুরু করে। টলারেন্স যত বাড়ে, তত কমে আসে প্রেম। কমতে কমতে শিথিল হয়ে যায় এই সম্পর্ক। প্রেম অভিলাসী মানুষেরা বিচলিত, বেদনাহত হয়ে পড়েন। তবুও জীবন্ত করে তুলতে পারেন না এই নিষ্ক্রিয়তা, শিথিলতা। প্রেম সম্পর্কের এক পর্যায়ে নর-নারী দেহ স্পর্শের যে সুখ পেতে চান, তার কারণও অঙ্গস্টেটাসিন নামের এক জৈব রাসায়নিক, যা মানুষের রক্তে মাত্রাভেদে মিশ্রিত থাকে। অধিকাংশ প্রেম সম্পর্কের নির্ধারিত গন্তব্য হচ্ছে দেহজ সুখ। প্রেম অনুভূতি দেহের বা যৌন সুখের মধ্যে তার গন্তব্য খুঁজে না পেলেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে এই সম্পর্কের জোয়ারে ভাটা পড়তে থাকে। প্রতিটি প্রেমের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে প্রকৃতি। গড়ে প্রায় চার বছর। বিয়ে নামের প্রথার বাঁধনও কোন শক্তিময় ভূমিকা রাখতে পারে না এ ব্যাপারে। বরং দ্বৈত জীবনকে, প্রেম সম্পর্ককে করে তোলে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। সুদীর্ঘ সময় যৌথ জীবনযাপন করা মানেই প্রেমানুভূতির মাধুর্যে স্নাত জীবন নয়। অনেক রকম দায়-দায়িত্বের জটিল শেকলে আবদ্ধ হয়ে একত্রে থাকার অভ্যেস মাত্র। প্রেম ও যৌনতা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ লেখালেখি করা মানে সমাজের মানুষকে যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, বা অবাধ যৌনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করা নয়। বরং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এসব বিষয়ে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ সুন্দর আলোচনা থেকেই সম্ভব হবে, সমাজের মানুষকে বিকৃতির হাত থেকে বাঁচানো। প্রেম ও যৌনতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। সত্য, যৌক্তিক, সুন্দর ও সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, সেই শিক্ষাকে নিজের জীবনে যিনি প্রয়োগ করতে পারেন, মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করার সনদপত্রটি তারই হাতে তুলে দেয় প্রকৃতি। মানুষের প্রতিষ্ঠিত বিধানের কাঁচি, মানুষের হৃদয়ের ওপর চালানো যায় নি। যায় নি বলেই, প্রেমে পড়লে প্রতিটি মানুষ তার প্রেমিক, প্রেমিকার সঙ্গে আচরণ করেন তার নিজের স্বভাব মতো। তারপরও আমার ধারণা, পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রেমিক-প্রেমিকা প্রবল আবেগায়িত অবস্থায় একে অন্যকে যেসব কথা বলেন, অধিকাংশ প্রেমের গানে, কবিতায়, সাহিত্যে যে প্রেমাবেগ প্রকাশ করেন তার ধরন অনেকটা একই রকম। ‘তুমি আমার’ ‘তোমাকে পেলে আমার আর কিছুই চাই না’ ‘তোমার চেয়ে বেশি সুন্দর আর কেউ নয়’ ‘আমি কোন দিন তোমাকে ছেড়ে যাব না, ‘সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসব’ ‘আমি তোমাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি’ ধরনের সংলাপ কী সব প্রেমিক-প্রেমিকাই কোন না কোন সময় বলেন নি? হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এ রকম সব কথা, আমার মতে অজ্ঞানে অসচেতনে করা প্রতারণা। কিভাবে? বলছি। এই যে প্রেমের সংলাপ লিখলাম, এগুলোর সবই কি চূড়ান্ত কথা বলে দেয়া নয়? কিন্তু আমরা তো জানি, প্রকৃতিতে এ্যাবসলুট বা চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। তাহলে এ রকম চূড়ান্ত কথা বলা বা লেখার অধিকার আমাদের থাকে কী করে? ‘তোমাকে পেলে আমার আর কিছু চাই না’ বলার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করা দরকার, সত্যিই কি তাই? তাকে পেলেই কি অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, অর্থসহ অন্য সব অভাব মিটে যায়? যায় না। যায় না বলেই যদি এভাবে বলা যায়, ‘আমার জীবনের সুখকে সমৃদ্ধ করার জন্য তোমাকে চাই’ তাহলেই কি প্রেমের সংলাপ যুক্তিসঙ্গত হয়ে ওঠে না? ‘তোমার চেয়ে বেশি সুন্দর আর কেউ নয়’ তাকে খুশি করার জন্য এ রকম কথা না বলে যদি বলা হয়, ‘তোমাকে আমার কাছে ভারি সুন্দর লাগে’ তাহলেই কি তা সত্যতায় অনন্য হয়ে ওঠে না? ‘আমি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না’ না বলে, যদি বলা হয় ‘যত দিন সম্ভব তোমার কাছেই থাকব’ তবে কী তা মিথ্যা বলা হবে? ‘সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসব’ বলার মতো নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি কী কেউ কাউকে দিতে পারেন আসলে? পারেন না। কারণ মানুষের জীবনের সব কিছুই হচ্ছে রিলেটিভ। প্রায় সব কিছুই নির্ভর করে অন্য কিছুর ওপরে। যাকে মানুষ ভালোবাসে, তার প্রতিমুহূর্তের আচরণের ওপর নির্ভর করে, তাকে কতটা ভালোবাসা যায় এবং কতদিন। তাই, সঠিক হয়ে উঠবে সংলাপ, যদি বলা হয়, ‘এই মুহূর্তে তোমাকে আমি আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে ভালোবাসি, এখন এটাই সত্যি। ‘আমি তোমাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি’ এ কথা কাউকে বলা মানেই হচ্ছে, অচেতনে মিথ্যেবাদী হওয়া। মনে রাখা ভালো, ৯৮ ভাগ মানুষ বেঁচে থাকে, মূলত তার নিজের প্রতি প্রবল প্রেমের ভিত্তিতে। তাই নিজের চেয়েও বেশি ভালো সে কাউকেই বাসতে পারে না। মা তার সন্তানকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন বলে আমার মনে হয় না। যদি তাই হতো, তাহলে সন্তানের মৃত্যুর পরও মা বেঁচে থাকতে পারতেন না। এ রকম কথা যারা বলেন, তাদেরকেই ভেবে দেখতে বলছি, এসব কথা সত্য এবং সঠিক কি না। যা মিথ্যে তা বিশ্বাস করলে কি ঠকতে হয় না? হবে না এক সময়? ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা, সুচিন্তিতভাবে সঠিক এবং যৌক্তিক করে তুলতে পারলে, এই সম্পর্ক সমৃদ্ধ এবং যথার্থ হয়ে উঠবে সততায়। এক সময়ে যে কোন কারণে প্রেম সম্পর্কের মৃত্যু হলেও একজনের প্রতি অন্যজনের শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাবে না। অসততা বা মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে না কাউকেই। বন্ধুত্ব রূপান্তরিত হবে না ভয়াবহ শত্রুতায়। প্রেম না থাকুক, পরিচয়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যাবে। আর সেটাই কী হওয়া উচিত নয়? সংলাপ ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে মনোযোগী হলে প্রেম সম্পর্কের স্থায়িত্ব বাড়ানো যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্য দিন